জগতে আনন্দযজ্ঞে আমার নিমন্ত্রণ: সিরাজুল ইসলাম মুনির
আপডেট সময়:
রবিবার, ৩১ অক্টোবর, ২০২১
১৫৮
দেখেছেন
উত্তরের শীত কেটে সিলেট মেইল ছোটে।ছোট্ট মাইজগাঁও স্টেশনের প্লাটফর্মে রেলের পাটাতনে পা রাখার আগে গল্পগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল সহপাঠীদের কাছে। তখন ভোরবেলার মিষ্টি রোদটা পশমি চাদরের মতো জড়িয়ে থাকে সবার গায়ে।
হুইশেল দিয়ে রেলগাড়িটা আসে,কী দর্প তার! আমরা সভয়ে সরে দাঁড়াই। এই প্রথম আমাদের বাঁধন ছাড়ার দিন। আমাদের গল্পগুলোকে আমরা সঙ্গে নিয়ে এসেছি। কিন্তু ফেলে এসেছি লাল টিনের ছাউনি দেওয়া আমাদের বিশাল স্কুল, পাওয়ার হাউসের গম্ভীর শব্দতরঙ্গ,উঁচু ইউরিয়া টাওয়ার, টাওয়ারের মাথায় অদ্ভুত প্রকৌশলে বানানো ঘর, সেখান থেকে পলকা মেঘের মতো বের হওয়া ধোঁয়া, তারপর আকাশের মেঘের সঙ্গে তাদের মিশে যাওয়া, সবুজ আচ্ছাদিত আমাদের খেলার মাঠ, মাঠময় আদুরে সবুজ ঘাস, ছবির মতো সুন্দর আমাদের কলাবাগান, আমবাগান, হাউজিং কলোনি, নানারঙের ফুল,মওসুমী সবজি আর ফলসম্ভারে সেজে থাকা কলোনির সারিবাঁধা লাল টিনের বাড়ি। পাতা ঝরার দিন শেষ হলেই নতুন দিন আসে বসন্তের, সবুজ পাতা ও ফুলের সমারোহে জাগে দিন,আসে বর্ষা, দুর্দান্ত তার প্রতিযোগিতার খেলা,মেঘ ও বর্ষণ একেকদিন একেক রূপময়তা ও ক্ষমতার পেশীবিস্তার করে আগমণ করে, শরৎ যখন আসে, মনে হয় পাহাড়ের সবুজ রং হলুদ ও লাল আবীর মেখে আকাশের নীলে ভেসে থাকা সাদা মেঘের ওড়নায় চেপে নেমে আসে আমাদের আঙিনায়,আমাদের কাছে শীতও আসে কুয়াশা, শিশির ও স্কুলছুটির মজা এবং খেলাধুলার আনন্দ নিয়ে।
আমাদের গল্পগুলোও আমাদের মতো বড় হতে থাকে। একেকজনের একেক বয়স। কারো বয়সের গল্প আট-ন, কারো বা চার-পাঁচ। তারপর সবগুলো গল্প একাকার হয়ে যায় সবার মধ্যে।
যেদিন আমাদের এসএসসি পরীক্ষা শেষ হলো,আমরা উদ্দাম সংগীতে ভাসলাম,’আজ আমাদের ছুটি ও ভাই, আজ আমাদের ছুটি, আহ হা হা হা’। কিন্তু যেদিন ফল বেরুল, আমরা বুঝে গেলাম,আমাদের আনন্দের দিনগুলো, আমাদের খুশিগুলো সব গল্প হয়ে গেছে। আমাদের চলে যেতে হবে অন্য কোনো ভূবনে,আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবো অনেকে,একেকজন চলে যাব একেক অচেনা পথের রেখা ধরে।
আমরা লাফঝাপ করেই রেলগাড়িতে উঠলাম, একই কম্পার্টমেন্টে। আজ আমাদের ‘সাবধানে ওঠো’ বলে কেউ খবরদারি করলো না। আমরা আজ থেকে স্বাধীন। আমাদের সহপাঠীদের অনেকেই এরইমধ্যে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। কেউ চলে গেছে বন্দর নগরীতে, কেউ রাজধানীতে, কেউ গেছে নিজেদের মফস্বল শহরে। আমরা সাত-আাটজন রয়ে গেলাম সিলেট শহরের কলেজগুলোয় পড়ব বলে। আমাদের সবার লক্ষ্য এমসি ডিগ্রী কলেজ, সেখানে ব্যর্থ হলে মদন মোহন অথবা এমসি ইন্টারমিডিয়েট কলেজ তো রয়েছেই।
আমরা কি কখনো ভেবেছিলাম, আমাদের জোটবদ্ধ গুচ্ছজীবন এভাবেই ভেঙে যাবে? একটি সার কারখানা,একটি স্কুলকে ঘিরে আমাদের এই যুথবদ্ধ জীবন ছিল। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ এই সার কারখানার চাকরিজীবী। কারখানার ছোট শ্রমিক থেকে সবার উপরের জেনারেল ম্যানেজার পর্যন্ত সকলে মিলে একটা বিশাল পরিবার। যার পদবি যেমনই থাক,সেটা কোথায় কীভাবে প্রটোকল হতো,আমরা জানি না। আমাদের কাছে তাঁরা সবাই ছিলেন অবিভাবক, বাবা অথবা চাচা। কেউ খালু বা ফুপা ছিলেন না। এ যেন বিশাল এক চৌহদ্দির মধ্যে আমাদের একটা সুন্দর বাড়ি,সে বাড়িতে বাস করে বিশাল এক পরিবার।
আমাদের এই সার কারখানা বাংলাদেশের প্রথম ও বৃহত্তম ইউরিয়া সার উৎপাদনের কারখানা। এর নাম এনজিএফএফ অর্থাৎ ন্যাচারাল গ্যাস ফার্টিলাইজার ফ্যাক্টরী। জাপানি বিশেষজ্ঞ ও শ্রমিকরা এই কারখানা নির্মাণ করেন। আইউব খান উনিশশো একষট্টি সালে এই কারখানার উৎপাদন কাজ উদ্বোধন করেন। আমাদের বাবা-চাচারা সবাই পরিবার-পরিজন নিয়ে কলাবাগান কলোনি,আমবাগান কলোনি,হাউজিং কলোনি,জাপানি টিলা,অফিসার্স কোয়ার্টারের বাড়িগুলোয় বসবাস করেন। কলোনিগুলো বিশালায়তন। রাস্তার দুপাশ জুড়ে সুন্দর করে বানানো কলোনির বাড়িগুলো, বাড়িগুলোর ফ্রন্টইয়ার্ড-ব্যাকইয়ার্ড আছে। সুসজ্জিত এইসব বাড়িতে আমরা বেড়ে উঠেছি।
আমাদের লেখাপড়ার জন্য বাষট্টি সালেই প্রতিষ্ঠা করা হয় এনজিএফএফ স্কুল। প্রথমদিকে কর্মকর্তা-কর্মচারীগণ নিজেদের ছেলেমেয়ে আর নিকট স্বজনদের স্কুলে ভর্তি করাতেন। কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যেই দেখা গেল কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ছেলেমেয়েরাই স্কুলের আসনসংখ্যা পূর্ণ করে ফেলেছে। তখন নিকটাত্মীয়দের ভর্তি করার নিয়ম রহিত হয়। বিকল্প হিসেবে এনজিএফএফ সীমানার বাইরে পুরাণ বাজারে আরেকটা স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হয়। নাম দেওয়া হয় পিপিএম উচ্চ বিদ্যালয়।
আমাদের স্কুলটা প্রথমে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল হিসেবে যাত্রা শুরু করে। দুই বছরের অভিজ্ঞতা ও বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে দেশে বিদ্যমান শিক্ষা ব্যবস্থার ধারায় স্কুলকে ফিরিয়ে আনা হয়।
আমাদের সার কারখানার উৎপাদিত পণ্যের নাম ইউরিয়া সার। এর প্রধান কাঁচামাল প্রাকৃতিক গ্যাস। হরিপুর থেকে গ্যাস উত্তোলন করা হয়, তারপর পাইপের মাধ্যমে এই গ্যাস এখানে সরবরাহ করা হয়।
প্রাকৃতিক গ্যাস থেকে সার উৎপাদন করা হয় বলে এই কারখানার নাম প্রাকৃতিক গ্যাস সার কারখানা, ইংরেজিতে ন্যাচারাল গ্যাস ফার্টিলাইজার ফ্যাক্টরি বা এনজিএফএফ। ফেঞ্চুগঞ্জের মাইজগাঁও রেলস্টেশন থেকে দুই কিলোমিটার দক্ষিণে সবুজ পাহাড় ঘেরা আর ঢেউখেলানো বিস্তৃত চা বাগানের প্রচ্ছদপটে এক বিশাল সমতল ভূমিতে গড়ে ওঠা এনজিএফএফ আরেকটা নামে অধিক পরিচিতি পায়,সেটা হলো রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সরকারি সংস্থা পিআইডিসি-র নামে। পিআইডিসি হলো পাকিস্তান ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর এর নাম হলো বিআইডিসি অর্থাৎ বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন। বিআইডিসি নাম পরিবর্তন হয়ে বিসিআইসি অর্থাৎ বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশন হওয়ার পরও সবার মুখে মুখে বিআইডিসি নামেই পরিচিত থাকে আমাদের এনজিএফএফ। এনজিএফএফ যেন আমাদের বাপ-চাচা আর আত্মীয় পরিজনে ভরা বিশাল বাড়ি,সে বাড়িতে আমরা অনেকগুলো ভাইবোন। আমাদের বাড়িটা কারখানার অনুচ্চ গম্ভীর শব্দ আর আমাদের সবার কলহাস্যে মুখর হয়ে থাকে।
এনজিএফএফের চাকরিজীবীরা এসেছিলেন দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে, সেকারণে বলা চলে আমাদের সহপাঠীরাও ছিল বিভিন্ন জেলার। এতদিন আমাদের একথাটা একবারও মনে হয়নি আর এখন টুকরো টুকরো অস্তিত্ব নিয়ে আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছি। কেবল আমাদের গল্পগুলো আমরা সঙ্গে নিয়ে চলেছি।
রেলগাড়ির চাকার ঘর্ষণ শুনতে পাচ্ছি ,ধীরে ধীরে ঘর্ষণের শব্দ বিশেষ কোনো শব্দের মায়াজালে একটানা মুখর করে রাখে।আমার মন বলল,’যাই যাই’,অমনি রেলগাড়িটা ‘যাই যাই’ শব্দতরঙ্গে ফেটে পড়ল। আমি বললাম, চিনু-মিনু,অমনি রেলগাড়িটা বলল,’চিনু-মিনু’। চিনু-মিনু হলো আমার সহপাঠী, লিকলিকে গড়নের সুন্দর সুন্দর দুইবোন। ওদের বাবা ব্যাংকের ম্যানেজার।
রেলগাড়ির সঙ্গে আরো কিছুক্ষণ শব্দতরঙ্গের খেলা খেললাম। চোখগুলো নতুন করে অবাক বিস্ময় নিয়ে পৃথিবীকে দেখছে। আমার কানের কাছে শব্দরা থাকে না, কুশিয়ারা নদীর জলে ভাসমান নৌকাগুলো আমার মুগ্ধ চোখে ছবি আঁকতে থাকে। নদীর জলে ভেসে আছে কুয়াশা, রেলগাড়িটা এখন রেলব্রিজের লাল স্ট্রাকচারের ভিতর ঢুকে পড়েছে, সূর্যের আলো কেটে কেটে যাচ্ছে লোহার গরাদে বাড়ি খেয়ে। আলোছায়ার খেলাও শেষ হয়ে যায় নিমেষে, তখন রেল লাইনের দুইপাশে জল নেমে যাওয়া খেতজমিগুলোর সবুজ ধানের চারা শীতের ছুটন্ত বাতাসে আলুথালু কাঁপতে থাকে।
দুইপাশের বাড়িগুলোর গাছগাছালির পাতাগুলো থেকে রাতভর ঝরে পড়া কুয়াশা এখন বাষ্পীভূত হচ্ছে সুর্যের আঁচ পেয়ে। বকের ঝাঁক উড়ে যাচ্ছে পাতার আড়াল ছেড়ে, ধানের মাঠে তিরতির পানি,পানিতে খলবল করে মাছ,বকের ঝাঁক জানে সে কথা।
বাড়িঘরগুলোর বিস্তৃতি শেষ হয়ে গেলে দীর্ঘ প্রসারিত বিল। বর্ষার হাওরের জল আমরা দেখেছি। আমাদের এনজিএফএফের খুব কাছেই হাকালুকি হাওর। আমাদের সহপাঠী আইনুলের বাড়ির কাছাকাছি। একদিন বর্ষায় দলবেঁধে গিয়েছিলাম। সে কী ঢেউ আর বাতাসের মাতামাতি! কুলে এসে আছড়ে পড়ে ঢেউয়ের ফণা। সমুদ্রের মতো বিশাল-বিস্তৃত হাওরের মাঝে টুকরো টুকরো সবুজ,ওগুলোর নাম সোয়াম্প ফরেস্ট। আমরা তখনই এর নাম জেনেছিলাম। ওই ফরেস্টগুলো বিচিত্র সব মাছেদের বাড়িঘর। শীতে যখন হাওরের জল কমে গিয়ে কেবল হাওর-মধ্যস্থিত বহমান নদীগুলো জেগে থাকে তখন মাছেরা হুড়োহুড়ি করে নদীজলে ছুটে যায়। কিন্তু জেলেদের জাল তাদের ঘেরাটোপে আটকে ফেলে। আর সোয়াম্প ফরেস্টগুলো তখন হয়ে ওঠে পাখিদের অভয়ারণ্য।
রেলগাড়ি ছোটে,ছুটতে ছুটতে তার গতি কমে আসে। যাত্রীদের মধ্যে কেউ একজন বললেন, ইলাশপুর ব্রিজ। বিলের মধ্য দিয়ে বেশ চওড়া একটা নদী বয়ে গেছে এখানে, স্রোতের তীব্রতা নেই। ব্রিজের দুপাশ উন্মুক্ত, একটু বাড়তি সতর্কতা নিয়ে রেল ইঞ্জিনের ড্রাইভার গতি কমিয়ে দেন।
ওই ফুরসতে একবার গাড়ির যাত্রীদের দিকে তাকালাম। যাত্রীরা মোটামুটি ঘুমক্লান্ত। ঢাকা থেকে সরাসরি সিলেটের যাত্রী তারা। আখাউড়া জংশনে ইঞ্জিন ঘুরিয়ে রেলগাড়ি সিলেটের পথে ছোটে। সায়েস্তাগঞ্জ, শ্রীমঙ্গল ,কুলাউড়া, মাইজগাঁও স্টেশনে দূরযাত্রার কিছু যাত্রী নেমে যায়।সেই শুন্যস্থান পূরণ করে সিলেটগামী স্থানীয় যাত্রীরা। বেশ জায়গা দখল করে রয়েসয়েই তারা যেতে পারে।
একটা স্টেশনে এসে সিলেট মেইল থামে। এর নাম মোগলা বাজার। আমাদের সহপাঠীদের একজন লতিফ,তার বাড়ি এই স্টেশনের পূর্ব পাশে। বলল, এটা হলো মাইজগাঁও আর সিলেটের মাঝামাঝি। এর পরের স্টেশন সিলেট। লতিফ আমাদের হাত তুলে তার বাড়ির পথ দেখাল।
পরের স্টেশন সিলেট। আমাদের জন্য এটাই শেষ স্টেশন। সেখানে নেমে যাবে সবাই। বাঙ্কারে শুয়েছিল দুজন। তারা তড়িঘড়ি করে নেমে আসে। নেমে যাওয়ার একটা পূর্ব প্রস্তুতি চলতে থাকে।
আমাদের বুকের ভেতর দূরদূর কাঁপতে থাকে। এইটুকুই তো পথ,তবুও। আসলে আমরা তো কখনো মায়ের কোল ছেড়ে একা একা দূরে কোথাও যাইনি,ভয়টা সেকারণে, নিজের অজান্তেই।
অনেক হইচই, কুলিদের হাঁক-ডাক আর শোরগোলের ভেতর একটা রাজকীয় দম্ভ নিয়ে সিলেট মেইল স্টেশনে প্রবেশ করে। আমরা প্লাটফর্মে নেমে দাঁড়ালাম ছয় সহপাঠী। স্টেশন থেকে বেরুবার পথ আমরা চিনি না। রেলগাড়ির দরজা দিয়ে একহাতে হ্যাণ্ডেল ধরে বানরের মতো লাফিয়ে লাফিয়ে মানুষ নামতে থাকে। এতো মানুষ, বিশাল প্লাটফর্ম কিছুক্ষণের মধ্যেই মানুষের সমুদ্র হয়ে যায়।
আমরা মানুষের স্রোতের টানে এগোই। আমাদের গ্রামে বিশাল হা-মুখের বিন্তি জালের শেষ মাথার সরু মুখে বসানো থাকে ‘চাই’, যেখানে মাছগুলো ট্রাপে আটকা পড়ে। আমরাও এক স্টেশন মানুষ যেতে যেতে ছোট্ট একটা গেটের মুখে কালো কোটের একজন টিটিসি সাহেবের দেখা পেলাম। ছোট গেটটা যেন মাছের ট্র্যাপ ‘চাই’। টিকিট কালেক্টর হাত বাড়িয়ে আছেন,সবাই তাঁর হাতে ছোট্ট টিকেটটা গুঁজে দিচ্ছে। তাঁর দেখার অতো সময় কোথায়, মুঠি পূর্ণ হয়ে গেলেই তিনি কোটের পকেটে টিকেটগুলো রেখে দিচ্ছেন।
আমরা ইচ্ছা করে টিকিট দিলাম না। ‘দেব না’ বলে আমরা কিন্তু এর আগে পরামর্শও করলাম না। আশ্চর্য! আমরা ছয় জনই টিকিট না দিয়ে নির্বিঘ্নে বেরিয়ে এলাম।
স্টেশনের বাইরে এসে টিকিট কালেক্টর সাহেবকে ফাঁকি দিয়ে এসে আমরা যেন বিশ্ব জয় করেছি, এমনভাবে হেসে গড়িয়ে পড়লাম। আমাদের সাহসের পারদ যেন এক লাফে অনেকদূর উঠে গেল।
সুরমা নদীর এইপারে সিলেট রেল স্টেশন, ওই পারে মূল শহর। যারা ওই পারের যেখানে যেতে চায় সেই জায়গার নাম ধরে বলতে হবে, জিন্দাবাজার, বন্দর, চৌহাট্টা, তালতলা, দরগামহলা,আম্বরখানা ইত্যাদি।
আমাদের গন্তব্য টিলাগড়, এমসি কলেজ সেখানে।
আমরা বললাম, এমসি কলেজ।
আমরা দুজন করে তিন রিকশায় চড়লাম। ক্রিং ক্রিং বেল বাজিয়ে আমাদের রিকশা ছোটে। সুরমা নদীর উপর উপোল কীনব্রিজ,এপার-ওপারকে যুক্ত করেছে। ব্রিজে ওঠার মুখেই রিকশার পেছনে একজন করে ঠেলাওয়ালা জুটে যায়। তারা ধাক্কা দিয়ে রিকশাকে ব্রিজের মাঝ বরাবর নিয়ে আসে। বিনিময়ে তারা চার আনা পয়সা পায়।
এবার রিকশা ঢালু বেয়ে মূলশহরের প্রান্তে প্রবেশ করবে। আমাদের ড্রাইভার প্যাডেলে চাপ দেন না,হ্যান্ডেল ধরে বসে থাকেন, রিকশা আপন গতিতে নেমে যেতে থাকে। রিকশা ছোটে, নাকি আমরা ছুটি বুঝতে পারি না। আমি দুহাত দুদিকে বাড়িয়ে দিই,আমার মনে হলো আমি উড়ে চলেছি। উড়তে উড়তে দেখলাম, আমার বাম পাশে বিশাল এক ঘড়িঘর,ঘড়ির কাঁটায় সাড়ে নয়টা। ঘড়িঘরের পরেই উঁচু দালান,ডানপাশে বিশাল চত্বরে সাজানো ফুলের বাগান,সেখানেও উঁচু ইমারত,লতিফ বলল,সার্কিট হাউস।
রিকশার একটানা ক্রিংক্রিং, পায়েছোটা মানুষের হইচই,উচ্চকিত কথামালা,ট্রাফিক পয়েন্টের মোড় ঘুরতেই অদ্ভুত গুটগুট শব্দে বেবিট্যাক্সির ছুটে চলা- সবকিছু হঠাৎই শৈশব থেকে দেখা এনজিএফএফের শান্ত-নিবিড় নিসর্গ থেকে আমাকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। আমি এক নতুন গল্পভূবনে প্রবেশ করলাম আর আমাদের ছেলেবেলার গল্পগুলো রয়ে যায় ওই সবুজ পাহাড়ের ছায়াঘেরা এক মায়াময় বিশাল বাড়ির আঙিনায়।
Leave a Reply