আমাদের গ্রামটা বাংলাদেশে বৃহত্তম গ্রামগুলির মধ্যে অন্যতম। কিন্তু এখানে মাত্র একটি বাড়ীতে তিনটি হিন্দু পরিবার বাস করত। তাদের একজন দফাদার ও দুইজন চৌকিদার। আমার বাল্যকালের অধিক সময়ই তাদের বাড়ীতে কেটেছে। সে বাড়ীটি তিন দিকই ছিল খোলা। খেলাধুলা শেষে ক্লান্ত হয়ে গাছের গুড়িতে বসে উন্মুক্ত বাতাসে ঠান্ডা হতাম। সে বাড়ীতে ছিল একটি পেয়ারা গাছ ও একটি চালতা গাছ। পাকা পাকা পেয়ারা ও চালতার মজা আজও মনে আছে। আমরাই নয় , তাদের কাছে মই ও লাঙ্গল বানাতে আসা গ্রামের সব লোকরাই এভাবে আপ্যায়িত হত,তারা সবাইকে হাসিমুখে গ্রহন করেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের সাথে গণিত বিভাগে পড়ত আনন্দ চন্দ বৈদ্য । আমার বন্ধুদের মধ্যে হাশেম , রেজাউল ও আনন্দ ছিল ঘনিষ্ঠ।শরিয়তপুর কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ থাকাকালীন শিক্ষার্থীদের এক শিক্ষা ভ্রমণে বরিশাল গেলে কিছুক্ষনের জন্য হলেও বরিশাল কলেজে তৎকালীন কর্মরত আনন্দের বাসায় গিয়ে দেখা না করে আসতে পারি নি। সেদিন সে কি যে খুশি হয়েছিল তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না।
আমার প্রথম কর্মস্থল মহসিন কলেজের সহকর্মী অনিল চন্দ্র বনিক, সুমঙ্গল মুৎসুদ্দী, রিতা দত্ত ও অজয় কিশোর হোড়ের সাথে আমার সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত আন্তরিক।স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রথম দিকে অনিল বাবু বউদিকে বোরকা পরিয়ে পাক বাহিনী হতে বাঁচার জন্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে পালিয়ে বেড়াতেন । তিনি তাঁর বাসার গুরুত্বপূর্ণ জিনিস আমার মেসে রেখে গিয়েছিলেন এবং মাঝে মাঝে যোগাযোগ রক্ষা করতেন।
অধ্যক্ষ মহোদয়ের মেয়েকে বিয়ে দেয়ার জন্য যখন মুৎসুদ্দি বাবুকে চাপ দেয়ার পরও তিনি রাজী হচ্ছিলেন না তখন অধ্যক্ষ মহোদয়ের সাথে কিছু ঝামেলা হলে তাঁর সহকর্মীরা যার অধিকাংশই ছিল মুসলমান তাঁর পক্ষ অবলম্বন করে অধ্যক্ষের প্রতিপ্ক্ষ হবার মত দু: সাহস দেখিয়েছিলাম।
স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাক বাহিনীর ভয়ে কিছুদিন রাঙ্গুনিয়া কলেজ প্রাঙ্গণে অবস্থান করতে হয়েছিল। তখন আমি তাঁর বাড়ীতেও গিয়েছি। আমাদের সম্পর্ক এত মধুর ছিল যে কেবল আমার বদলীই আমাদেরকে বিচ্ছিন্ন করতে পেরেছিল। তিনি যখন চট্টগ্রাম বোর্ডে এবং আমি খাড়াছড়িতে কর্মরত তখন তাঁর তথায় কিছু সমস্যা হলে তিনি মিউচুয়াল বদলির অনুরোধ জানালে আমি সাড়া দিলেও শেষ পর্যন্ত তা হয় নি। অবসর নেয়া পর্যন্ত তার সাথে যোগাযোগ ছিল।
রিতা দত্ত অত্যান্ত অমায়িক ছিল। তাঁকে আমরা ছোট বোনের মতই আপন করে নিয়েছিলাম। আমাদের জনৈক মুসলিম প্রকৌশলী বন্ধু তাঁর ব্যবহারের মুগ্ধ হয়ে বিয়ের প্রস্তাবও দিতে চেয়েছিল। অবশ্য পরে তাঁর বিয়ে আমাদেরই অপর সহকর্মী রঞ্জিত বাবুর সাথে হয়। অবসরগ্রহণ করা পর্যন্ত তার সাথে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক ছিল।
অজয় বাবু ও তাঁর স্ত্রী আধুনিক গানের শিল্পী ছিলেন। তাঁরা আমাদের প্রথম বিবাহ বার্ষিকীতে সুন্দর সংগীত পরিবেশন করে সবাইকে মুগ্ধ করেছিল।
নাসির কলোনীতে থাকার সময় আমাদের পাশের কক্ষে আজিজ সাবের সাথে থাকতেন স্বপন বাবু। তাঁর সাথে হৃদ্যতার অভাব ছিল না। চক বাজার পুলিশ বিটে অনুষ্ঠিত আমাদের ছাত্রী কৃষ্ণার সাথে তাঁর বিয়েতে আমরা মুসলমানরাও অংশগ্রহণ করি। সেই কলোনীতে বাস করতেন দুই দিদি, বড় দিদি দুটি শিশু পুত্র এবং অবিবাহিত ছোট দিদিকে নিয়ে থাকতেন। তাদের সাথে কলোনীর সবাইর সুসম্পর্ক ছিল। সবাই তাদেরকে নিজের বোনের মতই ভাবত।
চট্টগ্রাম কলেজে গণিত বিভাগে সহকর্মী হিসাবে পাই হরিনারায়ন দত্তকে , তার সাথে সম্পর্ক মধুর হয়ে উঠে। তিনি ভোলার অধিবাসী। তিনি তথায় জমি সংক্রান্ত সমস্যায় পরেন । তখন ভোলা মহকুমা প্রশাসক ছিল আমার চাচাত বোনের স্বামী ও আমার সহপাঠি । সমস্যা সমাধানের জন্য তার সাহায্য চাইলে আমি আন্তরিকতার সাথে সাড়া দিয়াছিলাম ।
নোয়াখালী কলেজে প্রথম দিকে পেয়েছিলাম যোগেশ চন্দ্র সরকার, অম্লান কুসুম রায়, স্বপন বাবু ও অর্জুন বাবুকে। যোগেশ বাবু নড়িয়া কলেজের অধ্যক্ষ থাকাকালীন তাঁর সাথে শেষ কথা হয়। তাঁর সাথে পারিবারিক সৌহার্দ্য গড়ে উঠে ছিল। তিনি বাল্যকালে কত কষ্ট করে মানুষ হয়েছেন সে গল্প আমার মেয়েদেরকেও বলতেন । বাকি তিনজন এখন স্বায়ীভাবে কুমিল্লায় বসবাস করছেন। আমি কুমিল্লা গেলে স্বপন বাবুর অতিথি হই। নোয়াখালী হতে কুমিল্লা শহরে তাঁর বিয়েতে উপস্থিত ছিলাম। কুমিল্লার প্রত্যন্ত গ্রামে গিয়ে অর্জন বাবুর বিয়েতেও উপস্থিত হয়েছি।
নোয়াখালী কলেজে দীর্ঘকাল অবস্থানের কারণে অনেক হিন্দু সহকর্মীর সংস্পর্শে আসি। তাদের সবার তালিকা অতি দীর্ঘ। সংক্ষিপ্ততার কারণে গণিত বিভাগের রমা নাথ সেন ও মনোরঞ্জন বাবু র নাম উল্লেখ করছি। মনোরঞ্জন বাবুকে বেশী দিন না পেলেও তাঁর আন্তরিক ব্যবহারের আমি মুগ্ধ হয়েছি। রমা বাবুর সাথে সম্পর্কের কথা দীর্ঘ । তিনি আমার রচিত দেশাত্মক গানটির এবং একটি হামদের সুরই নয় কন্ঠও দিয়েছেন। আরও কিছুদিন বেঁচে থাকলে হয়ত আমার সব কতটা হামদ ও নাত আত্মপ্রকাশ ঘটত।
জীব বিজ্ঞানের আরতি ধরের কথা না বললেই নয়। আমি তখন খাগড়াছড়ি কলেজে অধ্যক্ষ। একদিন আরতি ম্যাডামের স্বামী আমার অফিসে এসে জানাল যে, নোয়াখালী কলেজের অধ্যক্ষের বার্ষিক রিপোর্টে তার মাঝে মাঝেই অনমুদিত কলেজে অনুপস্থিত থাকার অভিযোগের কারণে পদোন্নতি বন্ধ হয়ে আছে, সেই রিপোর্ট পাল্টিয়ে পদোন্নতির যোগ্য বলে সনদ না দিলে পদোন্নতি দেয়া যাচ্ছে না । অধ্যক্ষ মহোদয় মৃত্যুবরণ করাতে তৎকালীন উপাধ্যক্ষ আমাকেই এই সনদ দিতে হবে ডিজি অফিস থেকে পরামর্শ দেয়া হয়েছে। কিন্তু এ কারণে দীর্ঘ কাঙ্খিত পদোন্নতি আটকে গেছে শোনে মনটা সহানুভূতিশীল হয়ে উঠল।
একজন মহিলার পক্ষে লক্ষীপুর থেকে এসে নোয়াখালী কলেজে দায়িত্ব পালন যেমন দুরহ ছিল তেমনি পরিবারের সবাইকে রেখে একা একা নোয়াখালীতে বাসা করে থাকাও কষ্টকর ছিল। কিন্তু তিনি পাঠদানের ব্যাপারে আন্তরিক ছিল , এই সব বিবেচনায় এনে তাঁর অনিচ্ছাকৃত দায়িত্ব পালনে কিছু ব্যত্যয় ঘটাকে সহানুভূতির দৃষ্টিতে এনে তাঁর পদোন্নতি দেয়ার সুপারিশ করেছি।” এরূপ কিছু একটা লিখে ( কি লেখে ছিলাম সঠিক আজ মনে নেই) তাঁর স্বামীকে আমার সাথে মধ্যাহ্ন ভোজ খাইয়ে সম্মানের সাথে বিদায় করি। আমি অবসর নেবার পর কিছুদিন চট্টগ্রামস্থ বাসায় অবস্থান কালে মেয়েদের সার্টিফিকেট সত্যায়নের জন্য তাঁর কাছে (তখন তিনিচট্টগ্রাম কলেজের জীববিজ্ঞানের প্রধান) গেলে কি যে খুশি হতেন!
খাগড়াছড়ি কলেজে আমি অধ্যক্ষ হিসেবে বদলী হলে আমার চাচাত বোনের স্বামী ও প্রখ্যাত শিল্পপতি মাহবুবুর রহমানের উক্তি ছিল, “পাহাড়ীরা এবার তোমাকে খাবে।” আল্লাহর উপর ভরসা করে যোগদান করলাম । উপাধ্যক্ষ পেলাম চিত্ত রঞ্জন হালদারকে ও আরো পেলাম জনপ্রিয় শিক্ষক বোধি সত্ত্ব দেওয়ানকে। প্রত্যেহ সকালে আমরা হেঁটে চলে যেতাম দূর থেকে দূরে। মুসলি, হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মালম্বীদের কি অপূর্ব মিল! ছুটির দিন হাঁটতে হাঁটতেই চলে গেলাম আলুটিলায় । জঙ্গলের ভিতর সরু রাস্তা দিয়ে ফেরার সময় বন্য প্রানীর ভয় পাচ্ছিলাম। ভাগ্য ভাল তেমন কিছু অঘটন ঘটে নি। কিন্তু পরদিন খবর পেলাম সেখানেই তিনটি বাঘ ধরা পড়েছে। শোনে শরীর শিউরে উঠল। অমুসলিম সহকর্মী হিসাবে আরো পেলাম সুধীন কুমার চাকমা, শিশির কুমার বড়ুয়া, সুকান্ত ভট্টাচার্য , অরূপ কুমার বড়ুয়া ও দীন নাথ দে কে। পরে আরো পেয়ে ছিলাম শেখর দস্তগীরকে । বিভাগীয় শহরের প্রধান কলেজে অধ্যক্ষ হওয়া যেখানে আমার মত তদবীরবিমুখ লোকের জন্য কল্পনাতীত সেখানে তিনি চট্টগ্রাম কলেজের অধ্যক্ষ হয়েছিলেন।
২০০৩ সালে অবসর নেয়ার পর কানাডা প্রবাসী হবার পর ২০১০ সালে বাংলাদেশ আসলে আমার দুটি ধর্মীয় বই বের হয় । তা বিতরণের জন্য বিভিন্ন স্থানের ঘুরার এক পর্যায়ে চট্টগ্রাম কলেজে অধ্যক্ষের বাসভবন পারসিভিল হিলে যাই শেখর বাবুকে বই দুটি দিতে। কিন্তু সেখানকার নিরাপত্তা বেষ্টনী ডিঙ্গানো খুবই কষ্টকর ছিল। ভাগ্যিস আমি চট্টগ্রাম কলেজে কর্মরত অবস্থায় পারসিভিল হিলের শিক্ষকদের একটি বাসায় সপরিবারে বাস করেছিলাম। শুধু তাই নয় তৎকালীন অধ্যক্ষ মোশাররফ হোসেনের বাসায় কয়েকবার গিয়েছি এবং এক সাথে কোরবানীও দিয়েছিলাম। তাই দারোয়ানের সব প্রশ্নের সন্তোষজনকভাব জবাব দিয়ে ঢুকতে পেরেছিলাম। শেখর বাবু এসে সাদর সম্ভাষণ জানান এবং তাঁর স্ত্রীর আন্তরিক আপ্যায়নে মুগ্ধ হই। দীর্ঘ আলোচনার পর বই দুটি দিলে তিনি তা সাগ্রহে গ্রহণ করেন। আমার বিশ্বাস আরেকবার বদ্ধমূল হল যে, ক্ষমতার অপব্যবহার না করলে সবার মনজয় করা যায়, পক্ষান্তরে ক্ষমতার অপব্যবহারে ভুক্তভোগীই নয় সবার মনে যে ক্ষোভ সৃষ্টি হয় তা সাময়িকভাবে সহ্য করতে বাধ্য হলেও ক্ষমতাচ্যুত হবার সাথে সাথে সুযোগ আসলে প্রতিশোধ নেবে আর সুযোগ না পেলে মনে মনে হলেও ঘৃণা করবে।
আরো পেয়েছিলাম মং শানু চৌধুরী, রঞ্জিত কুমার মজুমদার, বীরেন্দ্র বিজয় চাকমা ও মধু বাবুকে। সকলেই বয়ষ্ক ছিলেন বলে সম্পর্কটা গভীর হয়েছিল। মং শানু বাবুর স্ত্রীর অকাল মৃত্যুতে ব্যথিত হয়ে রাঙ্গামাটিতে গিয়ে সহানুভূতি প্রদর্শন করি।
কুমিল্লাতে বাসা ঠিক করার জন্য রঞ্জিত বাবুর বাসায় গেলে তাঁর স্ত্রী আমাকে দুপুরের খাবার না খাওয়ায়ে ছাড়েন নি। উল্লেখ্য যে তখন উভয়েই অবসর গ্রহন করেছি।
দীর্ঘ ছয় বছর তথায় অবস্থান কালে ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে কোন সহকর্মী তো নয়ই, কোন শিক্ষার্থী কিংবা কর্মচারীর সাথেও অসৌজন্যমূলক আচরণ করতে হয় নি। খাগড়াছড়ি কলেজে অবস্থান আমার কর্মজীবনের শ্রেষ্ঠ সময় মনে করি; যেখানে সহকর্মী, ৩য় ও ৪র্থ শ্রেণীর কর্মচারী, শিক্ষাথীর অধিকাংশই ননমুসলিম। অবসর গ্রহনে পর বোধি বাবুর আতিথেয়তাও গ্রহণ করেছি।
এই সমস্ত আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার উল্লেখ করে অনেকের ধৈর্যচ্যুতি ঘটালেও এর পেছনে একটা মহান উদ্দেশ্য ছিল যে ,আমার ক্ষেত্রেই নয় বরং কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া বাংলাদেশের সব লোকই ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে পরম সৌহার্দ্যপূর্ণ সহাবস্থানে আছে। তবে নির্বাচন উত্তর ব্যাপক অনভিপ্রেত ঘটনাও ঘটে। তা অবশ্য ধর্মীয় কারণে নয় বরং রাজনৈতিক কারণ। সব দলই ভোট পকেটস্থ করার জন্য নির্বিচারে বেশী লোক দলে ভিড়াতে চায়, এবং অনৈতিক সুযোগ সুবিধার লোভ দেখায় । এ সুযোগ যারা গ্রহণ করেন তাদেরকেই দেখা যায় নির্যাতিত হতে। একজন অযোগ্য লোক যদি একজন যোগ্য লোককে বঞ্চিত করে কোন পদে আসীন হন তবে বঞ্চিত লোকটির মনে সুবিধাভোগী লোকটির প্রতি প্রতিহিংসা সৃষ্টি হতে পারে।পট পরিবর্তন হলে সে তার বদলা নিবেই।
নির্বাচনের সময় যোগ্য লোককে মনোয়ন না দিলে তার মনে বিদ্বেষ সৃষ্টি হয় । ফলশ্রুতিতে যোগ্য লোক দলীয় শৃঙ্গলা ভঙ্গ করে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয় । এমনও দেখা যায় বিবাদমান লোকের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে প্রানহানি হচ্ছে । এই সংঘর্ষ মুসলিম ও অমুসলিমদের মধ্যে নয়, মুসলমান ও মুসলমানের মধ্যেও হচ্ছে। তখনই কী বলবেন এগুলি ধর্মীয় কারনে? তাই বাংলাদেশ নি:সন্দেহে সম্প্রতির দেশ।
Leave a Reply