আমার থাকার জায়গা হলো ফার্স্ট ব্লকে। আমাদের কলেজে আবাসিক হোস্টেলের ছয়টি ব্লক। এরমধ্যে একটি ব্লক হিন্দু ছাত্রদের জন্য।
এমসি কলেজ অর্থাৎ মুরারী চাঁদ কলেজের প্রতিষ্ঠাতা হলেন দানবীর ও শিক্ষানুরাগী রাজা গিরিশচন্দ্র রায়। তিনি তাঁর প্রপিতামহ মুরারি চাঁদের নামে ১৮৯২সালে এই কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। সিলেট শহরের প্রাণকেন্দ্র বন্দর বাজারে তাঁর নিজের নামে প্রতিষ্ঠিত রাজা জি সি হাইস্কুলের পাশেই ছিল এই কলেজ। ১৯০৭ সালের ভয়াবহ ভূমিকম্পে স্কুল-কলেজ এবং রাজবাড়ির স্থাপনা ভেঙে পড়ে। পরের বছর রাজা গিরিশচন্দ্র রায় মৃত্যু বরণ করলে কলেজটি আর্থিক অনটন ও অস্তিত্ব সংকটে পড়ে। সে সময় সৈয়দ আবদুল মজিদ, তিনি কাপ্তান মিয়া নামেই সমধিক পরিচিত, একজন জনদরদী ব্যক্তি এবং বাবু দুলাল চন্দ্র দে নামের অপর সুহৃদ কলেজটি রক্ষায় এগিয়ে এলেন। তাঁদের আর্থিক অনুদানে কলেজটির আবার স্বাভাবিক যাত্রা শুরু হয়। কাপ্তান মিয়ার উদ্যোগ ও প্রচেষ্টায় শহর থেকে তিন মাইল দূরে বর্তমান টিলাগড়ে কলেজের জন্য ১২৪ একর জায়গা একোয়ার করা হয়। ১৯১২ সালে আসামের চিফ কমিশনার স্যার আর্চডেল আর্চ কলেজটিকে প্রথম শ্রেণিতে উন্নীত করেন। ১৯২১ সালে আসামের গভর্নর স্যার উইলিয়াম মরিস নতুন ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন । ছাত্রদের জন্য হোস্টেল ব্লকও তখন নির্মাণ করা হয়। ১৯২৪ সালে নতুন কলেজ ক্যাম্পাসের উদ্বোধন করেন আসাম গভর্নর স্যার উইলিয়াম রীড। দেশবিভাগের আগে কলেজটি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত ছিল।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সিলেট এমসি কলেজে এসেছিলেন ১৯১৯ সালে। মজার ব্যাপার হলো, তাঁকে সংবর্ধনা জানানোর জন্য যে অভ্যর্থনা কমিটি করা হয় তার আহবায়ক ছিলেন এমসি কলেজ পূনরুজ্জীবনের নায়ক কাপ্তান মিয়া।
এমসি কলেজকে সবাই এমসি ডিগ্রি কলেজ বলে। ইন্টারমিডিয়েট সেকশনে কেবল বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্ররা ভর্তি হয়। কলেজের পাশেই এমসি ইন্টারমিডিয়েট কলেজ নামে আরেকটা কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে ১৯৬৪ সালে। সেখানে ইন্টারমিডিয়েটের সব বিভাগের ছাত্র ভর্তি হয়। আমাদের এনজিএফএফের কেউ এখানে ভর্তি হলো না। শহরের লামাবজারে আরেকটা ডিগ্রি কলেজ আছে,মদন মোহন কলেজ।সেটাও প্রাচীন কলেজ,প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৪০ সালে।
এমসি কলেজে আমার বাল্যবন্ধুদের মধ্যে ভর্তি হলো তারা মিয়া, আসাদ,খালেক,বাবুল আর মালিক। মালিক হোস্টেলে থাকতো না। শহরে কোনো আত্মীয়ের বাসায় থাকতো। লতিফ গিয়ে ভর্তি হলো সিলেট পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে। শহরের জিন্দাবাজারে আছে সিলেট ওমেনস কলেজ। সেখানেও ভর্তি হলো আমাদের সহপাঠী জাহানারা আর সেজু। ওদের বাড়ি সিলেটেরই কোথাও। ঢাকা ইডেনে গিয়ে ভর্তি হলো মঞ্জু, চিনু আর নুরজাহান। সুফিয়া,শেফুর কথা পরে শুনেছি, ওদের বিয়ে হয়ে গেছে। সুলতান,আয়েশা-তারা ভাইবোন, চলে গেল নিউইয়র্ক, আমেরিকা। মাহমুদ সামাদ চৌধুরী, আবদুল মইদ,হাবিব চলে গেল বিলাতে। বিলাতে তাদের ভাই থাকেন, বোন থাকেন। পড়াশোনা করার আকাঙ্খার চাইতে স্বজনের সংখ্যা ভারী করাও কারো কারো বিধেয় ছিল সম্ভবত। বিলাতে ইন্ডাস্ট্রিয়াল ম্যানেজমেন্টে উচ্চশিক্ষা নিয়েছিল আমাদের সুদর্শন বন্ধু মাহমুদ সামাদ চৌধুরী। বহুবছর পর দেশে ফিরে এসে সে কুশিয়ারা কম্পোজিট নামের একটা ইন্ডাস্ট্রি করল,তারপর ব্যবসা সম্প্রসারণ করে করল সামাদ গ্রুপ। তারও পরে সে সিলেট-৩ আসন অর্থাৎ ফেঞ্চুগঞ্জ, বালাগঞ্জ, সিলেট দক্ষিণ সুরমা থেকে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয় জনপ্রতিনিধি হিসেবে তিনবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলো। আমাদের সবাইকে কাঁদিয়ে আমাদের বাল্যবন্ধু ২০২১ সালের মার্চে কোভিড আক্রান্ত হয়ে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে যায়।
বিলাত যাওয়ার পর আর কোনোদিন মইদের খবর পাইনি। আর সবার চেয়ে লম্বা ছিপছিপে হাবিবও হারিয়ে গেল পাশ্চাত্য সংস্কৃতির উদ্দাম হাওয়ায়। শুনেছি, সে নাকি ব্রিটিশ ললনাদের বোহেমিয়ান জীবনের সঙ্গী হয়ে গেছে।
আমাদের কয়েকজন বন্ধু চলে গেল ঢাকাসহ তাদের নিজেদের জেলা শহরে। এমদাদ গেল ঢাকায়, আজিজ গেল ভেড়ামারা, রাজ্জাক ইটনায়,আরিফ আর মোহাম্মদ আলী গেল চাঁদপুর। সালেহ ছিল আমার প্রাণের বন্ধু। সে চলে গেল হবিগঞ্জ ভাইয়ের বাসায়, ভর্তি হলো বৃন্দাবন সরকারি কলেজে। এ ভাবেই আমাদের কৈশোর ফুরোবার আগেই আমাদের শৈশবের খেলার সাথী, বাল্যবন্ধু, সহপাঠীরা হারিয়ে যেতে থাকল,আমাদের আর যুথবদ্ধ হয়ে থাকা হলো না।
এই প্রথম আমরা ছোট্ট পাখির বাচ্চার মতো ডানা মেলে উড়তে শুরু করলাম। আমাদের কেউ কেউ সেই বয়সেই ডানা গুটিয়ে বসে পড়ল, স্বাধীনতাত্তোর সময়ের উত্তাল আবেগী বাতাসে পড়ে কারো কারো ডানা ভেঙে গেল,আবার কারো কারো ওড়ার জন্য আকাশ তার বিশাল সামিয়ানা উন্মুক্ত করে দিল।
পিপিএম স্কুলের কথা তো আগেই বলেছি। পিপিএম স্কুলের পূর্ণ নাম পুরাণবাজার পাবলিক মাল্টিলেটারাল হাই স্কুল। সেখানে যারা পড়তো তাদের অধিকাংশই ছিল এনজিএফএফের শ্রমিক-কর্মচারী,কর্মকর্তাদের নিকট-স্বজন। আমাদের সহপাঠীরা ছাড়াও পিপিএমের সহপাঠীরাও আমাদের বন্ধু। আবার আমাদের একক্লাস উঁচুতে পড়ুয়া অথবা একক্লাস নিচে পড়ুয়ারাও আমাদের বন্ধু। পিপিএমে পড়ত আমদের বন্ধু অমর আর সগীর। অমরের দাদা অরিজিত নাথ,আর সগীরের দূলাভাই মাহফুজ খান, দুজনই কাকুর কলিগ, তিনজনই কারখানার রেস্পন্সিবল উর্ধ্ধতন কর্মকর্তা।
অমরদের পরিবারের একটা দুঃখবহুল ঘটনা আছে, সগীরদেরও দেরও আছে। দুই পরিবারের ঘটনার প্রেক্ষিত দুই রকম, কিন্তু আখেরে দুঃখের দহন বোধহয় একইরকম।
অমরদের মূলবাড়ি লক্ষীপুর দালাল বাজার। অমরের বাবা একটা মন্দির ও দেবোত্তর সম্পত্তির দেখাশোনা করতেন। তাদের নিজেদেরও কিছু জমিজমা ছিল।১৯৪৬ সালে নোয়াখালীতে দাঙ্গা হলো, গান্ধীজিকে ছুটে আসতে হলো,তিনি হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতির জন্য সবাইকে নিয়ে ধর্মসভা করলেন,শান্তি শোভাযাত্রা করলেন, মানুষ আপাতদৃষ্টিতে শান্ত হলো। কিন্তু স্বাধীনতা নামক এক অাজব জিনিস অল্প কিছুদিনের মধ্যেই মানুষের শান্তি হরণ করতে শুরু করল। একটু সামর্থবান মুসলমানরা ধরেই নিল,হিন্দুদের জন্য ভারত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে,তারা সেখানেই যাবে। ওখান থেকেও বহু বিত্তবান মুসলমান এদেশে এসেছে, ঢাকা শহরে তারা হিন্দুদের সঙ্গে জায়গা বদল করেছে,নয়তো নামমাত্র মূল্যে সম্পদ কিনে নিয়েছে। কলকাতায় গেছে ঢাকার বহু হিন্দুজন, একই তরিকায় সেখানে সম্পদের মালিক হয়েছে। এসব খবর দালাল বাজারের নব্য মুসলিমলীগারদেরও জানা হয়ে যায়। শুরু হলো খেলা। ধীরে ধীরে উচ্ছেদ হতে থাকে হিন্দুজনরা। বিশাল দালাল বাজার,মন্দির, নবীন কিশোর রায় হাই স্কুলসহ বিশাল সম্পত্তির মালিক ছিলেন জমিদার নবীন কিশোর রায়। অমরের বাবা অনুকূল চন্দ্র নাথ ছিলেন জমিদার নবীন কিশোর রায়ের দেবোত্তর সম্পত্তির রক্ষক,পরিচালক। বিশাল দেবোত্তর সম্পত্তি গ্রাস করার জন্য চাই কৌশল, কুটচাল ও ক্ষমতা। এবার দায়িত্ব নিলেন স্বয়ং মনির চেয়ারম্যান নিজে। প্রথমেই অমরের দিদিদের স্কুলে যাবার পথে শুরু হলো টিজ করার ঘটনা। চেয়ারম্যানের পোষা লোকগুলো সম্পত্তির অংশ দাবি করে খাবলে নিতে থাকে সম্পত্তির নানা অংশ। একসময় এনিমি প্রপাটির মামলা ঠুকে দিয়ে একদিন রাতে বাড়ি থেকে জোর করে বের করে দিল। বাড়িতে কেবল অমরের বাবা,মা আর দশ বছরের অমর। ততদিনে ভাইরা পড়াশোনার জন্য গ্রামের বাইরে। এই সব ঝামেলার মধ্যে দুইবোনের অবশ্য বিয়ে হয়ে গিয়েছে।
অমর আর তার বাবা-মা পথের মোড়ে সারাটা রাত অনিশ্চয়তার মধ্যে কাটালেন। পরদিন আইনি ব্যাবস্থার পথে হাঁটলেন অনুকূল চন্দ্র নাথ। পুলিশ এসে পাহারা বসাল। ছয় মাস পাহারা চলল, আর কোনো ঝামেলা থাকলো না। আপাতদৃষ্টিতে মনে হলো, আর কোনো সমস্যা নেই। পুলিশ পাহারা উঠিয়ে নেওয়ার জন্য আবেদন করলেন অনুকূল চন্দ্র নাথ।
পুলিশ যেদিন চলে গেল,সেই রাতেই ঘটল চুড়ান্ত ঘটনা। মাইজদী থেকে চেয়ারম্যানের ভাড়াটিয়া মইত্যা গুণ্ডা এলো। তার নেতৃত্বে একদল গুণ্ডা তাদেরকে বাড়ি থেকে বের করে দিল। বাড়ির জিনিসপত্র লুটপাট করে নিয়ে গেল। একরাতের মধ্যে দেবোত্তর সম্পত্তি দখল করে ষাটটা ঘর তোলা হলো,ষাটজনকে দাবীদার করে সম্পত্তির মধ্যে বসানো হলো।
এরপর আর সেখানে থাকার রুচি অথবা সাহস কোনোটাই হলো না অমরের বাবার। ফেনী এসে অমরের বড়দির বাড়িতে আশ্রয় নিলেন তারা। অমরের মেজদা,সেজদা ভয়ে কলকাতা চলে যায়। বড় ভাই অরিজিত নাথ পড়াশোনা শেষ করে কেমিক্যাল কর্পোরেশনের চাকরিতে যোগদান করলেন। সেই থেকে অরিজিত নাথের সংসার বলতে বাবা-মা আর ছোট ভাই অমরকে নিয়ে। নিজের পায়ের নিচে তাঁর একটুকরো মাটি নেই, আর মাটি কিনলেই যে সে মাটি তার থাকবে,এই গ্যারান্টি তাঁকে কে দিবে,এইসব সংশয় ও ভয় থেকে আমৃত্যু আর কোনোদিন বিয়ে পর্যন্ত করলেন না।
দেশভাগের প্রাক্কালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার শিকার হয়ে ভারতের লক্ষ লক্ষ মুসলমান পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যেতে বাধ্য হয়। সেখান থেকে অনেক সামর্থ্যবান হিন্দু পরিবারও ভারতে চলে আসে। বিহার থেকেও দাঙ্গা কবলিত হয়ে বিপুল সংখ্যক মানুষ আসে পূর্ব পাকিস্তানে। বিহার থেকে আসার কারণে তারা ‘বিহারি’ নামেই পরিচিতি পায়।
‘উর্দু শ্যাল শ্যাল বি দ্য স্টেট ল্যাঙ্গুয়েজ অব পাকিস্তান’-পাকিস্তানের জাতির পিতার এই উদ্ভট ঘোষণা বিহার থেকে আসা মানুষগুলোর জন্য আশার সঞ্চার করে। ভাষাগত একটা মিলের কারণে পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর সঙ্গে তাদের দহরম-মহরম ঘটে। চাকরি এবং অন্য সকল ক্ষেত্রে বাঙালিরা এমনিতেই বৈষম্যের শিকার হয়ে যাচ্ছিল,আর সে কোটাটা দখল করে নিল বিহারিরা। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে বিহারিরা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সহযোগিতা করে এবং বাঙালি নিধনযজ্ঞে অবতীর্ণ হয়। কিন্তু একপর্যায়ে পাকিস্তানিদের পরাজয় নিশ্চিত হয়ে উঠলে বিহারিরাও জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে সংশয়ে পড়ে।
দেশভাগের সময় অনেক আশা নিয়ে মাহফুজ খানরা পূর্ব পাকিস্তানে এসেছিলেন। বিহার থেকে আসা মানুষদের অধিকাংশই ঢাকার মোহাম্মদ পুর,মিরপুর, রংপুর, সৈয়দপুর এবং চট্টগ্রামের পাহাড়তলীতে বসবাস শুরু করে। মাহফুজ খানদের পরিবারও অন্য স্বজনদের সঙ্গে এসে সৈয়দপুরে বসবাস করতে থাকেন।
কারখানার উর্ধ্ধতন কর্মকর্তা হিসেবে মাহফুজ খান সাহেবের একটা আলাদা পরিচিতি ছিল। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে যখন সেনাবাহিনী এনজিএফএফ প্রবেশ করছিল, একটা সংশয়,অনিশ্চয়তা ও মৃত্যুভয়ের মধ্যে সবাই সময় পার করছিল তখন মাহফুজ খানের ভূমিকা ছিল প্রকৃত বন্ধুর মতো।
মাহফুজ খানের সঙ্গে সেনাবাহিনী আগেই যোগাযোগ করেছিল। তারা কোথাও থেকে ইনফরমেশন পেয়েছিল,কারখানার বিশাল অ্যামোনিয়া ট্যাংক গোলা মেরে ফুটো করে দিলে দুই মাইল রেডিয়াসের মধ্যে সব লোক বিষক্রিয়ায় মারা যাবে। তারা মাহফুজ খানকে তার পরিবার নিয়ে সরে যেতে বলে।
মাহফুজ খান দেখলেন,এ তো ভারি বিপদ! মানুষকে বাঁচাতে হবে। এই এনজিএফএফের সবাই তার আপনজন,সুখে-দুঃখে তারা সবাই চিরআপনের মতো একসঙ্গে বসবাস করেছে।
মাহফুজ খান তাদের বললেন, তোমরা ঠিকই শুনেছ। তবে দুই মাইল নয়,পুরা সিলেট জেলার লোক মারা যাবে। আমাদের যেসব সৈন্য ভইয়েরা এই জেলায় আছে, তারাও মারা যাবে। সৈন্যরা তখন তাদের এই পরিকল্পনা পরিত্যাগ করে।
মে মাসের শুরুতেই পাকিস্তানি সৈন্যরা সিলেট থেকে মাইজগাঁও হয়ে এনজিএফএফ প্রবেশ করে। এখানে যুথবদ্ধ হয়ে কয়েক হাজার মানুষ বসবাস করে। তাদের জীবন ও সম্ভ্রম বাঁচানোর লক্ষ্যে কারখানার মেইন অফিস ও বাসাবাড়ির শীর্ষে উড়তে থাকা স্বাধীন বাংলার পতাকা নামানো হয়। মেইন অফিসে ওড়ানো হয় পাকিস্তানের পতাকা। মাহফুজ খান ও কারখানার শীর্ষ কর্মকর্তারা সৈন্যদের অভ্যর্থনা জানালেন।
আমদের বন্ধু সগীর খান আবার অমরের জানি দোস্ত।গলাগলি ভাব।আমাদের এনজিএফএফে রাজনীতির হাওয়াবাতাস লাগতে শুরু করেছে উনসত্তুরের শুরু থেকেই। তখন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ট্রায়াল চলছে। পত্রিকার কল্যাণে সেই ট্রায়ালের নিয়ন্ত্রিত সংবাদ আমাদের অনেকেরই জানা হয়। তখন থেকেই ছাত্রলীগ,ছাত্র ইউনিয়ন এই নামগুলোর সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটে। আমরা নিজেদের ছাত্রলীগ ভাবতাম। সগীর খানও ছাত্রলীগ।অসহযোগ আন্দোলনের সময়ও সে ছাত্রলীগ। মদন মোহন কলেজে অমরের সঙ্গে সে-ও ছাত্রলীগের মিছিল-মিটিংয়ের সঙ্গী।
স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে অবাঙালি বিহারিদের জন্য সুখবর থাকে না। সৈয়দপুর, মিরপুর, মোহাম্মদপুর,পাহাড়তলী সবখানেই তারা তাদের অতীতের অপকর্মের জবাব পেতে থাকে। তাদের জীবন হয়ে ওঠে অবর্ণনীয় ও অভিশপ্তময়। জাতিসংঘের উদ্যোগে তাদেরকে রক্ষার জন্য সৈয়দপুর ও মোহাম্মদপুরে ‘জেনেভা ক্যাম্প’ খোলা হয়েছে। সৈয়দপুরে সগীরদের আত্মীয়রাও ভালো থাকে না।
মাহফুজ খান আত্মমর্যাদাসম্পন্ন মানুষ। তিনি বুঝে গেলেন, এই দেশকে যতই তিনি আপন করে নিতে চান না কেন বাস্তবতার কারণেই এই দেশে তাদের পক্ষে থাকা আর সম্ভব নয়। থাকতে হলে একদিন জেনেভা ক্যাম্পের জীবন বেচে নিতে হবে। তিনি পাকিস্তান চলে যাওয়ার পরিকল্পনা করলেন।
একদিন আমরা জানলাম,সগীরদের পরিবার করাচি চলে যাচ্ছে। সগীর আমাদের থেকে বিদায় নিয়ে গেল। তার দুচোখ ভরা জলপ্লাবন। সগীরের সঙ্গে সেটাই ছিল আমাদের শেষ বিদায়ের দিন।আর কখনো তার সঙ্গে আমাদের দেখা হয়নি।
আমাদের অমর আর সগীর দুজনের পরিবারই উদ্বাস্তু পরিবার,তবে একেকজনের একেক রকম।
Leave a Reply