নিরবেই গেল ‘হোটেলে খেয়ে বিল না দেওয়া কবির মৃত্যু দিন : জহুরুল ইসলাম রুবেল
আপডেট সময়:
শনিবার, ২৭ নভেম্বর, ২০২১
১০৩
দেখেছেন
কবি আবুল হাসান, স্কেচ: মাসুক হেলাল
রাজ্য জয় করতে চান পদ্য দিয়ে কিন্তুু ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী তখন গদ্যময় থাকায় ক্ষুধার জ্বালা মেটাতে পকেটে টাকা না থাকা দুই বোহেমিয়ান কবি গুলিস্তানের একটি হোটেলে খেয়ে দৌঁড়ে পালিয়ে আসেন। এই দুই কবির একজন নির্মলেন্দু গুণ,আরেকজন আবুল হাসান।
আবুল হাসানকে স্মরণ করে আমার কন্ঠস্বর’ এ নির্মলেন্দু গুণ লিখেছেন –
‘হাসান সঙ্গে না থাকলে ওর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আমার কবিতা লেখা হতো না। কে জানে, আমি হয়তো শুধু জুয়াড়িই থেকে যেতাম।’ জুয়াডি না হলেও কবিতার জন্য বেছে নিয়েছেন তাঁরা উম্মুল জীবন। ছেড়ে দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথাগত পড়াশোনার পাঠ। একাডেমিক বিদ্যার অধ্যয়ন ছেড়ে দেওয়া আবুল হাসান এর সাথে প্রেম হল বিদুষী, সুন্দরী রমণী ক্যামব্রিজে পড়া সুরাইয়া খানম এর সাথে যিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের একজন নামকরা শিক্ষক ছিলেন। এই আবুল হাসান তাঁর পারিবারিক নাম ‘ আবুল হোসেন মিয়া’ বাদ দিয়ে নাম ধারণ করলেন আবুল হাসান। ‘ আবুল হোসেন ‘ মিয়া’ আরেকজন প্রখর, মুখর কবি ‘ আবুল হোসেন’ থাকায় আবুল হাসান নামে কবিতা লিখে পাথরে লাবণ্যে ধরিয়ে মায়াবী করুণ বিউগল বাজালেন বাংলা কবিতায়।
আবুল হাসান কবিতায় লিখলেনঃ
‘ সে এক পাথর আছে কেবলি লাবণ্য ধরে উজ্জ্বলতা ৷ ধরে আর্দ্র।
মায়াবী করুণ।
এটা সেই পাথরের নাম নাকি? এটা তাই?’।
নিজ নামে লাবণ্যের কবিতা লিখে সাহসের সাথে করে উচ্চারণ -‘ সব ভালো কবিতাই আমার কবিতা।’
এ বাক্যের দুটো অর্থ হতে পারে -(১) তিনি যেসব কবিতা পড়েছেন, তন্মধ্যে ভালো সব কবিতায় তার মনের কথা বলা আছে অথবা (২) তিনি যা লিখেছেন সব কবিতায় কালের মানোর্ত্তীণ।
আমি দ্বিতীয়টাই ভাবি ,তাঁর সব কবিতাই ভালো কবিতা। হবেনা কেন – তিনি তো শৈশবের বাতজ্বরে আক্রান্ত হয়ে নীরবে সহে বাংলায় কবিতায় মুক্তোর ফলন দিয়েছেন। তাঁর কবিতার ভাষায়-
‘ ঝিনুক নীরবে সহো, ঝিনুক নীরবে সহে যাও।
ভিতরে বিষের বালি, মুখ বুুঁজে মুক্তা ফলাও।’
নীরবে সহ্য করে ফুল, ফসলের হাওয়ার ঘ্রাণ নিয়ে নগর ঢাকায় আসলেন কবি হতে।
বোহেমিয়ান কবির প্রতিটি মুহূর্ত ছিল কবিতায় ভরপুর। তাঁকে নিয়ে শামসুর রাহমান ‘ আবুল হাসান রচন সমগ্র’ এর ভূমিকায় লিখেছেন
‘একজন খাঁটি কবির জন্ম হলো, এই কবির জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত কবিতায় ভরপুর ছিল। যেন হাওয়ায়, ধুলোয়,গাছের পাতায় পাখির ডানায়, নদীর জলে, দিনের কোলাহলে,রাত্রির নিস্তব্ধতায় তিনি কবিতা পেয়েছেন অবলীলায়। যিনি সর্বক্ষণ কবিতার ধ্যানে মগ্ন নন তার পক্ষে অসম্ভব এই কবিতা আহরণ।’ কবিতার ধ্যানে মগ্ন কবি জীবন- জীবিকার জন্য কাজ করেছেন দৈনিক ইত্তেফাক,জনপদ , গণকন্ঠ সহ আরো বিভিন্ন পত্রিকায়।
১৯৪৭ সালের ৪ঠা আগষ্ট গোপালগঞ্জের বর্ণি গ্রামে নানাবাড়িতে জন্মগ্রহণ করা কবি -‘ কোনদিন কারো প্রেমিক হবোনা’ কবিতায় লিখেছেন-
আমি ফিরবনা আর
আমি কোনদিন কারো প্রেমিক হবোনা;
প্রেমিকের প্রতিদ্বন্ধী চাই আজ
আমি সব প্রেমিকের প্রতিদ্বন্ধী হবে’।
তিনি বাস্তবে আর ফিরে আসবেননা জানি কিন্তুু সব প্রেমিকের প্রতিদ্বন্ধী হয়ে প্রেমিকা- রমণীকে নিয়ে লিখেছেনঃ
‘অতটুকু চায়নি বালিকা
অত শোভা,অত স্বাধীনতা।
চেয়েছিল আরো কিছু কম।
আয়নার দাঁড়ে দেহ মেলে দিয়ে
বসে থাকা সবটা দুপুর,
চেয়েছিল মা বকুক,বাবা তার বেদনা দেখুক।
অতটুকু চায়নি বালিকা।
অত হৈ,রৈ,লোক,ভীড়
অত সমাগম।
চেয়েছিল আরো কিছু কম
একটি জলের খনি
তাকে দিক তৃষ্ণা এখনি,
চেয়েছিল একটি পুরুষ তাকে বলুক রমণী’।
বসে থাকা সবটা দুপুর প্রার্থিত রমণীকে কবিতায় জলের খনি দিয়ে,তৃষ্ণা বাড়িয়ে দিয়ে তাঁর জীবদ্দশায় প্রকাশিত হয়েছে তিনটি কাব্যগন্থ,যথাক্রমে (১) রাজা যায় রাজা আসে (২) যে তুৃমি হরণ করো (৩) পৃথক পালঙ্ক।
তাঁর মৃত্যু দিবস নিরবেই চলে গেল। ১৯৭৫ সালের ২৬ নভেম্বর মৃত্যুবরণ করেন তিনি। তাঁর এপিটাফ কবিতার লাইন দিয়ে ‘ বৈরী বর্তমান’ এর কবি আবুল হাসানকে স্মরণ করি শ্রদ্ধায়-
‘ যতদূর থাকো ফের দেখা হবে।
কেননা,মানুষ যদিও বিরহকামী,কিন্তুু তার মিলনই মৌলিক’।
Leave a Reply