রাজধানী ঢাকার সবচেয়ে অভিজাত আবাসিক এলাকাগুলোর তালিকা করতে বলা হলে একদম শুরুতেই উচ্চারিত হবে গুলশানের নাম।
তবে আমার দেখা ৮০’র আগের গুলশান এবং বর্তমান গুলশানের পার্থক্য আকাশ আর পাতাল । এখন আর আগের পরিবেশ নাই বললেই চলে ।
বিভিন্ন ধরনের মার্কেট , ফ্যাক্টরি , হাইরাইজ বিল্ডিং , এপার্টমেন্ট , রেস্টুরেন্ট, যানজট, গাড়ির হর্নের কানফাটা শব্দে বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পরেছে এক কালের শান্ত স্নিগ্ধ সবুজ অভিজাত আবাসিক এবং diplomatic zone গুলশান ।
আবার এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার পিছনে কিছু কিছু স্বার্থান্বেষী মানুষ সম্পূর্ণভাবে দায়ী , সেই প্রসঙ্গে এখন আর যাচ্ছি না ।
গুলশান থানা
আসল প্রসঙ্গে আসি;
অত্যাধুনিক জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজনীয় সকল অনুষঙ্গই যথেষ্ট পরিমাণে মজুদ রয়েছে এই গুলশান এলাকায় । রাস্তায়ও সাধারণ প্রাইভেট কারের চেয়ে হ্যামার, রেঞ্জ রোভার, মার্সিডিজ বেঞ্জ, বিএমডব্লিউ, ল্যান্ড ক্রুজার প্রাডো কিংবা রোলস রয়েসের মতো বিলাসবহুল গাড়িই চোখে পড়ে বেশি, যা এখানকার অধিবাসীদের আর্থিক সামর্থ্যের দিকটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়।
কিন্তু বিস্ময়কর ব্যাপার কী, জানেন? গত শতকের প্রায় মাঝামাঝি পর্যন্তও এই এলাকার না ছিল অভিজাত দশা, না ছিল এর গালভরা ‘গুলশান’ নামটি। বরং এটি ছিল নিতান্তই একটি গণ্ডগ্রাম। স্থানীয়রা যে গ্রামকে চিনত ‘ভোলা গ্রাম’ নামে।
গুলশান পোস্ট অফিস
বর্তমান গুলশানে গিয়ে এ নামের অস্তিত্ব হয়তো খুঁজে পাবেন না অনেকেই। সবেধন নীলমণি হিসেবে রয়েছে কেবল দক্ষিণ বাড্ডায় স্থানান্তরিত ভোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।
কিন্তু না, ভোলা গ্রামের অস্তিত্ব পুরোপুরি মহাকালের অতল গহীনে বিলীন হয়েও যায়নি। গুলশানের স্থানীয় তহশিল অফিসে তল্লাশি চালালে খুঁজে পাওয়া যাবে ‘ভোলা সামাইর’ নামক মৌজার উল্লেখ, যেটিরই বহুল প্রচলিত ডাকনাম ছিল ভোলা গ্রাম।
এ গ্রামটি যখন মূল ঢাকার বাইরে ছিল, তখন তা ছিল মূলত একটি কৃষিপ্রধান এলাকা। আর এখানে যারা চাষবাস করত, তাদের অধিকাংশই এসেছিল ভোলা দ্বীপ ( বর্তমানে ভোলা জেলা ) থেকে। ভোলা দ্বীপের বাসিন্দাদের আধিক্যের কারণেই ঢাকা শহরের মানুষদের মুখে মুখে গ্রামটি ভোলা গ্রাম নামে পরিচিত হয়ে ওঠে।
পাখির চোখে গুলশান এভিনিউ
আদি ভোলা গ্রামটি গাছপালায় ঘেরা সুনসান নীরব এক জনপদ ছিল । রাতে ঝোপঝাড় থেকে ভেসে আসত শেয়ালের ডাক, ঠিক যেমনটি হতো আবহমান গ্রামবাংলার আর দশটা প্রত্যন্ত অঞ্চলে।
এমনকি ষাটের দশকের শুরুর দিক পর্যন্ত এই গ্রামের বনে-জঙ্গলে মেছো বাঘের দেখা পাওয়া যেত বলেও কথিত রয়েছে।
কিন্তু পাকিস্তান আমলের এক পর্যায়ে ছায়া সুনিবিড় এই গ্রামটির দিকে নজর পড়ে যায় ঢাকার ধনাঢ্য সৌখিন মানুষদের। বসবাসের জন্য তারা তো এমনই একটি নিরিবিলি এলাকার খোঁজে ছিল। এদিকে তৎকালীন শাসকগোষ্ঠীরও মনে ধরে যায় গ্রামটি।
তাই ১৯৬১ সাল নাগাদ গ্রামটিকে অধিগ্রহণ করে সেখানে একটি পরিকল্পিত আবাসিক এলাকা গড়ে তোলার প্রকল্প হাতে নেন ঢাকা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট (ডিআইটি)-র ( বর্তমানে যার নাম রাজউক ) প্রথম চেয়ারম্যান, পাকিস্তানি আমলা জি এ মাদানি (ICS ) ।
উল্লেখ্য যে, জি এ মাদানি নামে বারিধারায় একটি রাস্তার নামকরন করা হয়েছে ।
যেহেতু সৌখিন, সম্পদশালী মানুষেরা একত্র হয়ে যে আধুনিক উপশহর গড়ে তুলতে চাইছে, সেটির নাম কি আর ‘ভোলা’ রাখা যায়? তাই খোঁজ চলতে থাকে নতুন কোনো ‘আধুনিক’ নামের। এবং শেষমেষ তার সন্ধানও মেলে।
গুলশানে দ্য গ্লাস হাউস
পাকিস্তানের করাচিতে ছিল গুলশান নামের একটি অভিজাত এলাকা।
মাদানি সাহেব মনস্থির করেন, ঢাকাস্থ অভিজাত এলাকাটির নামও রাখা হবে গুলশান, যার বাংলা অর্থ দাঁড়ায় ‘ফুলের বাগান’।
তবে শুধু নাম গুলশান রেখেই ক্ষান্ত হয়নি তৎকালীন প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ। তারা চেষ্টা চালাতে থাকে নতুন এই গুলশানের চেহারাও হুবহু করাচির গুলশানের মতো করে তোলার।
সে উদ্দেশ্যে তখনকার দিনের অভিজাত মানুষেরা মোটা অঙ্কের টাকায় এখানে জমি কিনে এক-দোতলার ছবির মতো সুন্দর সব বাড়ি তৈরি করতে থাকে।
কেউ কেউ আবার বাড়ির সামনেটা সাজিয়ে নেয় গল্প-আড্ডা ও খেলাধুলার উপযোগী করে। অনেকে বাড়ির সামনে গড়ে তোলে ফুলের বাগানও। এভাবেই অভিজাত মানুষদের হাত ধরে গুলশান হয়ে ওঠে আক্ষরিক অর্থেই গুলশান।
Leave a Reply