আমরা ভর্তি হওয়ার কিছুদিন পরেই একটা সিনেমা মুক্তি পেল,ওরা ১১ জন।মুক্তিযুদ্ধের উপর নির্মিত প্রথম সিনেমা। আমরা এখন মুক্ত-স্বাধীন, আমরা ইচ্ছা করলেই যে কোনোদিন সিনেমা দেখে আসতে পারি। আমাদের ইচ্ছার বিপক্ষে দাঁড়ায় কে? আমরা বড় হয়ে গেছি না! আমাদের এনজিএফএফে ছায়ানীড় নামে জাপানি টিলার উপর একটা হল ছিলো। সেখানে কারখানার কর্মকর্তা কর্মচারীরা বছরে একটা-দুটো নাটক করতেন। নাটকের বিশাল মঞ্চ আছে ছায়ানীড়ের। নাটক দেখতে আমাদের বারণ ছিলো না।আমরা পরিবারের সবার সঙ্গেই নাটক দেখতে যেতাম। কিন্তু আমাদের সিনেমা দেখার সুযোগ ছিলো না।
‘ওরা ১১ জন’ মুক্তিযুদ্ধের বাস্তব ঘটনা নিয়ে নির্মাণ করা চলচ্চিত্র। আমাদের হোস্টেলে অনেক বড় ভাই দৈনিক পত্রিকা রাখেন। তারা সবাই ডিগ্রি অথবা অনার্স ক্লাসের ছাত্র । সেসব পত্রিকার মাধ্যমে আমরা নিয়মিতই সিনেমা জগতের খবরা-খবর পাই।
ওরা ১১ জন নিয়ে আমাদের আগ্রহের কারণ এই সিনেমাটি বাস্তবের কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে করা হয়েছে। পাকিস্তানি সৈন্যদের বিরুদ্ধে কীভাবে তারা গেরিলা যুদ্ধ করেছেন,সেটারই বাস্তব চিত্ররূপ এই সিনেমা। ছাত্রনেতা মুক্তিযোদ্ধা খসরু এই সিনেমার প্রধান নায়ক। অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধারা হলেন মুরাদ, ফিরোজ, আতা,হেলাল, বেবি, নান্টু, ওলীন, মঞ্জু, আবু, আলতাফ।
সিলেটের প্রেক্ষাগৃহগুলোতেও মহাসমারোহে মুক্তি পেল ওরা ১১ জন। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশের তরুণ ও যুবসমাজ আমরা, আমাদের উন্মাদনা স্বাভাবিকভাবেই একটু বেশি, বিশেষ করে বাস্তবে মুক্তিযোদ্ধারা কিভাবে যুদ্ধ করেছেন, সেটা দেখতে পাবার একটা আকাঙ্খা তো রয়েছেই।
সিনেমা হলে নতুন সিনেমা মুক্তি পায় শুক্রবার ম্যাটিনি শো-তে। শুক্রবার জুম্মার নামাজের দিন। নামাজ পড়ে এসে দুপুরের খাবার খেতে খেতে সময় খুব একটা থাকে না। আবার হোস্টেল থেকে রিকশা করে হলে পৌঁছে টিকেট করে সিটে বসতে বসতে দেখা যাবে জাতীয় পতাকা উড়তে শুরু করেছে।
শুক্রবারে সিনেমা মুক্তি পাওয়া নিয়ে আমরা একদিন কথা বলছিলাম। শুক্রবার একটা পবিত্র দিন, এইদিনে সিনেমার মুক্তি হয়, এটা কেমন কথা! আবার দ্যাখো,সিনেমার শুরু হয় ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ বলে। জাতীয় পতাকাইবা কেন ওড়ায়, কোন্ যুক্তিতে,যেখানে মানুষ বসা থেকে উঠতে চায় না। কেউ কেউ উঠে দাঁড়ায় যখন জাতীয় সংগীত শেষ হয়ে যায়, তাহলে এই পতাকা ওড়ানোর বিলাসিতা কেন!
আমাদের সমালোচনা শুনে একজন বড়ভাই বললেন, আরে বিসমিল্লাহ তো বরকতের দোয়া। কেউ যখন কিছু বলে না, চুপ মারো তো! শুক্রবার ছুটির দিন তো। সবাই যাতে ছুটির দিনে সিনেমা দেখতে যেতে পারে সেজন্যই এই দিনে ছবি মুক্তি পায়। আর জাতীয় সংগীত, জাতীয় পতাকার কথা বলছ, ওটা তো ভাই উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছি। কেউ দাঁড়াক আর না দাঁড়াক তোমরা ঠিকঠাক মতো দাঁড়াবা।
আমরা দল বেঁধে গেলাম ‘ওরা ১১ জন’ দেখতে। বন্দরবাজার ‘লালকুঠি’তে আমরা সিনেমা দেখলাম। পর্দায় আমার দেখা দ্বিতীয় সিনেমা এটা। এর আগে প্রজেক্টেরের মাধ্যমে আমরা একটা সিনেমা দেখেছিলাম। সিনেমার নাম সুতরাং। সিনেমার পরিচালক সুভাষ দত্ত। সুভাষ দত্ত নিজেই নায়ক আর নায়িকা ছিলেন কবরী।
এখন শুনলে খুব অবিশ্বাস্য মনে হবে যে, এই সিনেমাটা আমরা স্কুলের হলরুমে ছাত্র-শিক্ষকরা একসঙ্গে বসে দেখেছিলাম। তখনকার সিনেমাগুলোই ছিল এমন যে পরিবারের সবাই মিলে সেই সিনেমা দেখা যেত। জানি না,কীভাবে অথবা কাদের পৃষ্ঠপোষকতায় ‘সুতরাং’ সিনেমাটি আমাদের এনজিএফএফে এসেছিল, তবে এটা ছিল আমাদের কাছে এক অত্যাশ্চর্য ঘটনা। এটা ছিল ১৯৬৭ সালের কথা। আমরা তখন ক্লাস সেভেনে পড়ি। বলা যেতে পারে ওই শৈশবেই এই সিনেমাই ছিল আমাদের জীবনের প্রথম বিস্ময়কর বিনোদন। সিনেমার গানগুলো ছিল অসাধারণ সুন্দর। ‘পরাণে দোলা দিল এ-কোন্ ভ্রমরায়’, ‘চাঁদ বাঁকা জানি,নদী বাঁকা জানি, তাহার চেয়ে আরো বাঁকা তোমার ছলনা’,তুমি আসবে বলে, কাছে ডাকবে বলে,ভালো বাসবে ওগো শুধু মোরে’, এই যে আকাশ, এই যে বাতাস, ওরে মন ছুটে চল চেনা ঠিকানায়’, ‘এমন মজা হয় না, গায়ে সোনার গয়না,বুবুমনির বিয়ে হবে বাজবে কত বাজনা’। এইসব গানের কিছু কিছু কলি আমরা অনেকদিন কন্ঠস্থ রেখেছিলাম। এই সিনেমা দেখার আগে আমরা প্রেম কী বুঝতাম না। ওই বয়সে যে দুই-একজনক ভালো লাগত, সে-টা আসলে প্রেম-ট্রেম ছিল না, ওটা ছিল ভালো লাগা। অস্বীকার করার উপায় নেই, আমাদের উপর সিনেমার কিছুটা প্রভাব তো পড়েছিলই। আমাদের অনেকেই সুভাষ দত্তের মতো দিলীপ কাট দিয়ে চুল রাখল। আমিও সুভাষ দত্তের মতো কাট দিয়ে বাসায় ফিরে এলাম। তখন আমাদের জন্য একটাই চুলের কাট ছিল, স্কোয়ার। মাথার পেছন দিকে বেশি চুল রাখা যাবে না। কিন্তু এবার সুভাষ দত্তের মতো কাট দিয়ে বাসায় ফেরার পর পেছন থেকে চুলের গোছা ধরে কাকু বললেন, সুভাষ দত্ত হচ্ছ? যাও ঠিক করে কাটিয়ে এসো।
আমরা এখন বড় হয়ে গেছি। আমাদের চুলেও এসেছে নতুন ফ্যাশন। দিলীপ কাট ছাড়িয়ে আমাদের চুল আরো বড়,আরো ফ্যাশনোবল হয়ে গেছে। কাকু চুলের গোছা ধরে বলেন না,যাও,ঠিক করে কাটিয়ে এসো।
‘ওরা ১১ জন’ সিনেমা দেখে আমাদের মনই খারাপ হলো। আমাদের কল্পনার চেয়েও যুদ্ধ ভয়াবহ, দুঃখ-বেদনায় পূর্ণ। পাকিস্তানি মহাশয়তান সৈন্যগুলো যে এতটাই নির্দয়-পাষাণ ভাবতেই পারিনি।
সিনেমা দেখা শেষ হলে একেকজন একেক দিকে হারিয়ে গেল। আমার সঙ্গে থাকল কেবল সৈয়দ মুজিব। মৌলভিবাজারের ছেলে মুজিব, নালুয়া চা বাগানের ম্যানেজার তার বাবা। মুজিব ভালো ছাত্র। শিল্প সাহিত্যে অনুরাগ আছে। আজকাল তার সঙ্গে আমার সখ্যতা গড়ে উঠেছে। আমরা হোস্টেল থেকে এসেছিও এক রিকশায় চড়ে।
ফেরার আগে একটু আড্ডা তো দিতেই হয়। বন্দরবাজারে দিনভর জমজমাট থাকে হোটেল মডার্ন, হোটেল ইমপেরিয়াল ও হোটেল ওরিয়েন্টাল। এই সন্ধ্যেবলায় তো তিল ধারণের ঠাঁই নেই। মডার্ন, ওরিয়েন্টালে জায়গা না পেয়ে এলাম ইমপেরিয়ালে। একটা কেবিন দখল করে বসে আছে দুই বড়ভাই, দুই ফারুক ভাই। এক ফারুক ভাই ইংলিশ অনার্স পড়েন সেকেন্ড ইয়ারে, তার বাড়ি ঢাকার দিকে যেতে আমাদের মাইজগাঁও স্টেশনের পরের স্টেশন ভাটারায়। আরেক ফারুক ভাই ডিগ্রি ক্লাসে পড়েন,তার বাড়ি বিশ্বনাথ থানায়।
আমাদের দেখেই তারা ডাক দিলেন। তারা কাটলেট খাচ্ছিলেন।বললেন, বসো।
আমাদের জন্যও কাটলেটের অর্ডার দেওয়া হলো। কাটলেট খেতে খেতেই জানলাম, সিনিয়র ভাইয়েরাও সবাই এসেছেন। তারা সবাই ‘দিলসাদ’ হলে ছবি দেখেছেন। ফারুক ভাইদের পয়সায় কাটলেট খেলাম, চা খেলাম। তারপর একসঙ্গেই ফিরে এলাম হোস্টেলে।
কয়েকদিন পরের ঘটনা। আমরা হোস্টেলের সামনে ভলিবল খেলছিলাম।আমরা ইন্টারমিডিয়েটরা একদল, আর বড়ভাইরা একদল। খেলতে খেলতেই একসময় অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাটি ঘটল। একটা বল লব করে উপরে তুলে দিল নুরুল হক; মাধবপুরের ছেলে। আমি যে খুব ভালো খেলি, তা কিন্তু নয়। আমি দাঁড়ানো ছিলাম নেটের পাশে। সুযোগ পেলাম, নুরুল হকের লব করা বলে লাফিয়ে উঠে মারলাম চাপ। বলটা সরাসরি হিট করল আরেক নুরুল হকের কপালে। তিনি পড়ে গেলেন। এই নুরুল হক ভাইয়ের ডাক নাম মনজু।আমরা মনজু ভাই ডাকি। মনজু ভাই লম্বায় একটু খাটো ছিলেন। খেলাধুলা তেমন পারেন না,কিন্তু ভালো বক্তৃতা করেন। ছাত্রলীগের নেতা তিনি।
মনজু ভাই মাটি থেকে উঠেই মারমুখী হয়ে উঠলেন। আঞ্চলিক ভাষায় দুতিনটা অশ্লীল গালি দিলেন আমাকে। তার ধারণা হলো,আমি ইচ্ছা করেই তার উপর বলটা চাপ মেরেছি। আমি বোকা বনে গেলাম। অপমানে আমার মুখটা লাল ও বিষণ্ণ হয়ে উঠল। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, তার বন্ধুরাও তার পক্ষে অবস্থান নিলেন। তারাও উত্তেজিত ভাষায় কথা বলতে থাকেন।
আমাদের দলের সবাই আমরা বিমূঢের মতো দাঁড়িয়ে থাকলাম। দুই গেম খেলা চলছে। আগের গেমে আমরা জিতেছি, এই গেমেও আমরা এগিয়ে আছি। এটাই যদি সিনিয়রদের উষ্মার কারণ হয়, তাহলে এক ভাবনা, কিন্তু যদি তাদের বন্ধু নেতা বলে তার অন্যায় আচরণকে সমর্থন করতে হবে, তাহলে সেটা অন্য ভাবনা। সেটা তো মানা যায় না।
আমার সহপাঠী বন্ধুরা আমার বিষণ্ণ মুখের দিকে তাকাচ্ছিল বারবার। তারপর একসময় সবাই একসঙ্গে বিদ্রোহ করল। সবাই একসঙ্গে হইচই করে মাঠ ছেড়ে আসল।
আমরা সবাই হোস্টেলের মাঝামাঝি বিশাল করিডোরে এসে দাঁড়ালাম। কেউ একজন বলল, সিনিয়ররা যদি নিজেদের সম্মাম রক্ষা করতে না পারে,আমাদেরও সম্মান দেখাবার দরকার নেই।
সন্ধ্যা নেমে আসছিল। অন্যদিনও আমরা খেলার পরে দলবেঁধে গোসল করতে যেতাম। হোস্টেলের পেছন দিকে আলাদা একটা পাকা দালানে অনেকগুলো টয়লেট ও বাথরুম আছে। বাথরুম ব্যবহার করে সেখানে কেউ কেউ গোসল করলেও অধিকাংশই সামনের একটা রিজার্ভারের চারপাশ ঘিরে গোসল করে থাকে। সিনিয়ররা সেখানে গোসলে থাকলে আমরা সম্মান দেখিয়ে সেখানে যেতাম না। আমরাও গোসলে থাকলে সিনিয়ররা কেউ আসতেন না। আমরা যারা সিগারেট খেতাম, তারাও তাদের লুকিয়ে খেতাম।
আজ আমরা গোসলে গেলাম তো আর আমাদের ওঠার নাম পর্যন্ত নেই। রাত বাড়ছে, সময় যেতে যেতে একসময় ডাইনিং রুমে ঘন্টা বাজল,খাবারের ডাক পড়েছে। আমরা তাড়াতাড়ি করে গোসল সারলাম, তখনো সিনিয়রদের গোসল হয়নি। তারা কয়েকজন উঁকিঝুঁকি দিয়ে গেছে কয়েকবার, তারপর বিরক্ত হয়ে ফিরে গেছে।
ডাইনিং হলেও আমরা আজ ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসলাম। অন্যদিন আমরা দক্ষিণ পাশের টেবিলটা ঘিরে বসতাম,সিনিয়ররা বসতেন বাম পাশের টেবিলে। আজ আমরা দুটো টেবিলই দখল করে বসলাম,হইচই করে কথা বললাম, শিস দিলাম। বড়ভাইদের দুইজন এসেছিলেন। কিন্তু এই নৈরাজ্য দেখে মাথা নিচু করে চলে গেলেন।
রাতের খাবারের পর আমরা করিডোরে এসে দাঁড়ালাম। করিডোরের লাইট নিভিয়ে দিলাম, কিন্তু টানা বারান্দায় ঝোলানো লাইটের আলো এসে পড়ছিল। রাতের খাবার শেষে যখন সিনিয়র ভাইরা বারান্দা ধরে হেঁটে যাচ্ছিলেন,অমনি আমরা সবাই ম্যাচের কাঠি জ্বেলে সিগারেট ধরালাম। আমাদের মধ্যে চার-পাঁচজন সিগারেট খেতো না। কিন্তু আজ পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। তারাও সিগারেট টানছে। আমরা আড়চোখে দেখলাম, বড়ভাইয়েরা মাথা নিচু করে নিঃশব্দে তাদের রুমে চলে যাচ্ছেন। এমনটা দুদিন চলল, আগের মতো হইচই, কখনো আচমকা কারো গান গেয়ে ওঠা কিংবা স্বল্পদৈর্ঘ্য আড্ডায় হাসাহাসি, সেসবের কিছুই ঘটলো না। মনে হচ্ছিল, আমরা যেন সদ্য ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনার শোক বহন করছি।
রাত দশটায় সিনিয়র-জুনিয়র সবার ডাক পড়ল হোস্টেল সুপারিন্টেন্ডেন্ট অধ্যাপক শামসুর রহমান স্যারের অফিস কক্ষে। হোস্টেলের দক্ষিণ প্রান্তে টানা বারান্দা শেষ হলে বারান্দাটা ঘুরে গিয়ে সুপারিন্টেন্ডেন্ট স্যারের কোয়ার্টারের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। সেখানে তিনি তাঁর পরিবার নিয়ে থাকেন। আমরা সুপারিন্টেন্ডেন্ট স্যারকে ‘সুপার’ নামেই জানি। আমাদের সুপার স্যার ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টের অধ্যাপক। শান্ত স্বভাবের মানুষ। অন্যান্য ব্লকের সুপার স্যারদের মতো বেশি খবরদারি করেন না।
আমরা নোটিশ পেয়ে ভয়ে ভয়ে স্যারের অফিসে উপস্থিত হলাম। বড়ভাইয়েরা সবাই মাথা নিচু করে বসে আছেন, আমাদের ঔদ্ধত্য, যা আমরা গত দুদিন ধরে দেখাচ্ছিলাম,সেটার ছিটেফোঁটাও আমাদের মধ্যে নেই, ভদ্রছেলের মতো মাথা নিচু করে আমরাও এককোনায় জড়সড় হয়ে বসলাম।
সুপারিন্টেন্ডেন্ট স্যার গম্ভীর মুখে বসে আছেন। তাঁর পাশে বসে আছেন হোস্টেলের প্রিফেক্ট আজির হোসেন ভাই। তিনি বয়সে সবার বড়,সবার থেকে সিনিয়র। তিনি সর্বদক্ষিণের ১ নম্বর রুমে থাকেন। তিনিই কেবল একা একটা রুমে থাকেন। বাকি ১১ টা রুমের সবকটিতেই একজন সিনিয়রের সঙ্গে একজন জুনিয়রের থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। সব সময় এমনটা হয় না। অনেকসময় অনার্স পড়ুয়া বড় ভাইদের কারণে সিট খালি হয় না,তখন নতুন ভর্তি হওয়াদের জায়গা কম হয়। আজির হোসেন ভাইয়ের বয়স একটু বেশি অথবা তাকে অন্যদের তুলনায় বয়স্ক মানুষ মনে হয়। আমাদের সৈয়দ মুজিব তার একটা নাম দিয়েছে, বৃদ্ধ আজির হোসেন। আমাদের নিজস্ব আড্ডায় তিনি ‘বৃদ্ধ আজির হোসেন’ নামেই চর্চিত হতেন।
সুপার স্যার নিরবতা ভাঙলেন। বললেন, আমি আজির হোসেনের কাছে সব ঘটনা শুনেছি। তোমরা যারা এখানে আছ, বিভিন্ন পরিবার থেকে এসেছ, তোমাদের পরিবেশ ছিল আলাদা আলাদা। কিন্তু এখানে যখন এসেছ,তখন তোমরা সবাই একটা পরিবারভুক্ত হয়েছ। এখানে যে বড়, তাকে মনে রাখতে হবে, ছোট যে তারও একটা সম্মান আছে, মর্যাদা আছে। আর ছোট যে, তাকে মনে রাখতে হবে, বড় যে-জন সে স্বাভাবিক নিয়মেই সম্মান পাওয়ার অধিকার রাখে। কিন্তু তোমরা সবাই মিলে সেই পরিবেশটাকে নষ্ট করে ফেলেছ। আমি খুব দুঃখ পেয়েছি। আমি ইচ্ছা করলে একটা ড্রাস্টিক অ্যাকশনে যেতে পারতাম, কিন্তু আমি প্রথমবারের মতো সবাইকে ক্ষমা করলাম।
স্যার এরপর আমাদের দিকে তাকালেন। বললেন, তোমরা কতজন?
আজির ভাই বললেন, ওরা ১১ জন।
আমরা, এমনকি বড় ভাইয়েরাও চমকে উঠে আজির ভাইয়ের দিকে তাকালাম। সদ্য দেখা ‘ওরা ১১ জন’ সিনেমাটি তখনো আমাদের আচ্ছন্ন করে রেখেছে। হয়তো ক্ষণিকের তরে সবার স্মৃতিতে মুহূর্তের মধ্যেই সিনেমার দৃশ্য-দৃশ্যান্তর চমকবাজির মতো আলো ফেলে গেল।
আরো আশ্চর্য হওয়ার একটা ঘটনা ঘটল তখন,যখন স্যার বললেন, সেজন্যই তাদের এই ঐক্যবদ্ধ শক্তি। কিন্তু মনে রেখো ছেলেরা, একটা অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে নিজেরাও অন্যায় করবে, সেটা হতে পারবে না।
মাথা নিচু করে স্যারের কথাই শুনছিলাম। ‘ওরা ১১ জন’ সিনেমা তাহলে স্যারও দেখেছেন। ‘ওরা ১১ জন’ কেবল একটি মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্রের নাম নয় কেবল, এটা অন্যায়ের বিরুদ্ধে যে কোনো সংখ্যক মানুষের সংঘবদ্ধ মিলিত শক্তির নাম।
আমি উঠে দাঁড়ালাম। আমার দেখাদেখি আমাদের ১০ জন উঠে দাঁড়াল। আমি মনজু ভাইকে দুহাত বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরলাম। আমার দেখাদেখি একেকজন একেকজনকে জড়িয়ে ধরে। বড়ভাইরাও আমাদেরকে বুকে টেনে নিলেন।
স্যারের দুচোখে একটুখানি আনন্দের অশ্রু চিকমিক করে উঠল।বললেন, তোমরা বসো। চা খাও।
আজির ভাই বসা থেকে উঠে ভেতরে গেলেন। একটু পরেই দেখলাম আমাদের মেসবয় নুরু মিয়া ট্রে ভর্তি করে মিষ্টি আর চা নিয়ে এলো। বুঝলাম, এর নেপথ্যের কারিগর বৃদ্ধ আজির হোসেন। আজির ভাইকে কেন আমাদের সবার নেতা নির্বাচিত করা হয়েছিল, আজ তা বুঝলাম। যদি তিনি নেপথ্যে থেকে এই সমস্যাটির সমাধান না করতেন,তাহলে বড় কোনো ঘটনাও ঘটতে পারত।
তবে এই ঘটনার একটা সুদূরপ্রসারী ইমপ্যাক্ট তৈরি হলো। সিনিয়র-জুনিয়রদের মধ্যে সম্প্রীতি ও সৌহার্দের সম্পর্ক বৃদ্ধি পেল। আমরাও যথাসাধ্য তাদের মান্য করতাম। ওরা ১১ জনের জন্য ওদেরও মায়া-মমতা বেড়ে গেল। আর অঘোষিতভাবে আমি হয়ে গেলাম বাকি ১০ জনের প্রিয়বন্ধু।
Leave a Reply