সময়ের চরিত্রই বদলে যাওয়া। কালের নিয়মেই পাল্টেছে যুগের হাওয়া, পাল্টেছে সামাজিক রীতিনীতি, বদল এসেছে নানা ক্ষেত্রে, আর্থ-সামাজিক পরিকাঠামোয়। পেশার ক্ষেত্রই বা বাদ যায়নি। চাহিদা না থাকায় মানুষও তার পুরনো কাজ বদলে আকৃষ্ট হয়েছেন নতুন ক্ষেত্রে। বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া পেশাগুলোর মধ্যে ভিস্তিদের নাম বেশ উপরের সারিতে রয়েছে।
সে কালের শহর বিশেষ করে কলকাতা ও ঢাকায় আজকের মতো পাইপ দিয়ে পানি সরবরাহের ব্যবস্থা ছিল না।তখন শহুরে মানুষকে পানির জন্য এই ভিস্তিওয়ালাদের ওপরই নির্ভর করতে হত।আজকাল চলার পথে বা রেস্তোরাঁয় সর্বত্রই তেষ্টা পেলে আমাদের হাতে উঠে আসে ঠান্ডা বা নর্মাল সিল করা পানির বোতল। তখন কি মানুষ ঠান্ডা পানি খেতেন না? হ্যা খেতেন, অবশ্যই খেতেন। তখন ফ্রিজ না থাকলেও ছিল ‘ভিস্তি’। ভিস্তি হল এক ধরনের বস্তার মত দেখতে ব্যাগ। ছাগলের চামড়া দিয়ে তৈরি এই বিশেষ থলেকে ‘মশক’ও বলে। এতে পানি রাখলে ফ্রিজের মতোই ঠান্ডা থাকত। আর স্বয়ং পানিদাতা হয়ে এই ভিস্তির পানি যারা বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দিতেন তাদের বলা হত ভিস্তিওয়ালা।
‘বেহেশত’ নামের ফারসি শব্দ থেকে ‘ভিস্তি’ কথার প্রচলন হতে কত দিন লেগেছিল বা ঠিক কীভাবে এটা ঘটেছিল, তা নিশ্চিত করে বলা মুশকিল। তবে ‘বেহেশত’ (যার অর্থ ‘স্বর্গ’) কেন ‘ভিস্তি’ হল তা নিয়ে দুটো কথা বলা যায়। পশ্চিম এশিয়ার সংস্কৃতি অনুযায়ী মনে করা হয়, স্বর্গে রয়েছে প্রচুর নদী, জলাশয় আর বাগান। তাই এক সময় মানুষ মনে করতেন ভিস্তিওয়ালারা পানি নিয়ে আসেন স্বর্গের নদী থেকে। যেহেতু পানির অন্য নাম জীবন এবং স্বর্গ থেকে আনা পানি ভিস্তিরা মানুষের মাঝে বিলিয়ে দিতেন তাই এঁদেরকে ‘স্বর্গের দূত’ও বলা হত।
এক সময় মানুষ মনে করতেন ভিস্তিওয়ালারা পানি নিয়ে আসেন স্বর্গের নদী থেকে
ইতিহাসে ভিস্তিওয়ালারা সুপরিচিত হয়ে আছে মুঘল সম্রাটের প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন সেই সময় থেকে । শোনা যায়,মুঘল সম্রাট হুমায়ুন শেরশাহের সঙ্গে চৌসার যুদ্ধে বাধ্য হয়ে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সরাসরি ঝাঁপ দেন খরস্রোতা গঙ্গা নদীতে। স্রোতের তোড়ে তিনি যখন মৃত্যুর সম্মুখীন তখন নাজিম নামের জনৈক ভিস্তিওয়ালা তাঁর প্রাণ বাঁচান। তখন হুমায়ুন নাজিমকে কথা দেন,তিনি যদি দিল্লির মসনদে বসতে পারেন তবে নাজিম যা চাইবেন তাই উপহার দেবেন। পরে হুমায়ুন হয়ে ভিস্তিওয়ালা নাজিমকে তাঁর উপহারের কথা জিজ্ঞেস করা হলে তিনি সম্রাটের সিংহাসন চেয়ে বসলেন।বাদশাহ হুমায়ুন একটুও দেরি না করে নিজের মুকুট খুলে পরিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর প্রাণদাতা ভিস্তিওয়ালার মাথায়। তার পরে তাঁকে সাদরে বসিয়েছিলেন তাঁর সিংহাসনে।একদিনের সম্রাট হয়ে অভিভূত ভিস্তিওয়ালা নাদিম সম্রাটকে আলিঙ্গন করে মুকুট ও সিংহাসন ফিরিয়ে দেন।
আগে যুদ্ধের সময়ে ভিস্তিওয়ালাদের মশকে পানি রাখা হত। এদেশে ইংরেজ আগমনের পর নিজেদের কাজের মাধ্যমে ভিস্তিরা ব্রিটিশদের আনুগত্য অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ব্রিটিশ আমলে দুর্গগুলোতেও পানি সরবরাহ করা হত মশকের সাহায্যে। টমটম গাড়িতে করে পানিভর্তি মশক বয়ে আনা হত। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত ঢাকার রাস্তায় ভিস্তিদের আনাগোনা ছিল। ঊনবিংশ শতাব্দীর ঢাকা শহরে ছিল সুপেয় পানির বেশ অভাব। ভারতবর্ষের অন্য অঞ্চলের মতোই ঢাকায়ও খাবার পানির জন্য নির্ভর করতে হতো খাল, নদী বা কুয়ার ওপর। নিরাপদ পানির জন্য তাই শহর অধিবাসীদের অনেক দূরে দূরে ঘুরে বেড়াতে হতো। ঢাকার নাগরিকদের নিরাপদ পানির জন্য সাধারণত শীতলক্ষ্যা ও বুড়িগঙ্গা নদীর পানির ওপর নির্ভর করতে হতো। শহরে যেসব কুয়া ছিল তাতেও ছিল সুপেয় পানীর অভাব। আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী লোকেরা তাই এক বিশেষ পেশাজীবী শ্রেণির লোকদের মাধ্যমে নিজেদের পানি সংগ্রহ করতেন। তাদের কাঁধে ঝুলানো থাকত ছাগলের চামড়ার এক মশক।এই মশক দিয়েই টাকার বিনিময়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে তারা পানি সরবরাহ করত। এদের বলা হতো ভিস্তি বা সুক্কা। ‘ভিস্তি আবে ভিস্তি’ হাঁক দিয়ে প্রতি বাড়ি গিয়ে তারা পানি দিয়ে আসত ।
মূঘল সম্রাট হুমায়ূনের প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন ভিস্তিওয়ালা
‘ঢাকা পুরাণ’ থেকে জানা যায়, সেকালে কলের পানি সব বাড়িতে পৌছায়নি, যেখানে পানির কল ছিলনা সেখানে ভিস্তিওয়ালা সহায়। ছাগলের চামড়ার মশকে করে পানি ফেরির করত। ঢাকায় ভিস্তিওয়ালাদের “সাক্কা”বলা হত। সেসময় ভিস্তিওয়ালাদের একটি সংগঠন ও ছিল। সংগঠনের প্রধানকে নওয়াব ভিস্তি বলা হতো । আজ পুরান ঢাকার যে সিক্কাটুলি দেখা যায় তা ছিল ভিস্তিদের এলাকা। ১৮৩০ সালে ঢাকার ম্যাজিস্ট্রেট হেনরি ওয়াল্টারস এক আদমশুমারিতে ১০টি ভিস্তিপল্লীর উল্লেখ করেছিলেন। ইসলাম ধর্মাবলম্বী এসব ভিস্তিরা বেশিরভাগই ছিল সুন্নি মুসলিম।মহররমের মিছিলে রাস্তায় পানি ছিটিয়ে পরিষ্কার রাখার দায়িত্বে তাদের প্রত্যক্ষ করা যেত ।
দ্য লাস্ট ওয়াটারম্যান খ্যাত বিশেষ এ পেশাজীবী শ্রেণির মধ্যে নিজস্ব পঞ্চায়েত ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল ।লালবাগ কেল্লায় ভিস্তিরা টমটম ভরে বড় বড় চামড়ার থলেতে পানি দিয়ে আসতো ।কবি সাহিত্যিকদের রচনায় ভিস্তিদের অস্তিত্বের প্রমান পাওয়া যায় । শামসুর রাহমান তার শৈশবের স্মৃতি স্মরণ করতেগিয়ে ভিস্তিদের চিত্রায়িত করেছেন এভাবে-রোজ মশক ভরে দুবেলা পানি দিয়ে যেত আমাদের বাড়িতে। কালো মোষের পেটের মত ফোলা ফোলা মশক পিঠে বয়ে আনত ভিস্তি । তারপর মশকের মুখ খুলে পানি ঢেলে দিত মাটি কিংবা পিতলের কলসির ভেতর ৷ মনে আছে ওর থ্যাবড়া নাক, মাথায় কিস্তি টুপি, মিশমিশে কালো চাপদাড়ি আর কোমরে জড়ানো পানিভেজা গামছার কথা।
রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন:
“তখন বেগে ছুটিল ঝাঁকে ঝাঁকে,
মশক কাধে একুশ লাখ ভিস্তি ।
পুকুর বিলে রহিল শুধু পাঁক,
নদীর জলে নাহিকো চলে ভিস্তি ।”
সুকুমার রায় তাঁর “ন্যাড়া বেলতলায় ক’বার যায়?”ছড়ায় ভিস্তিদের প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন –
লাখোবার যায় যদি সে যাওয়া তার ঠেকায় কিসে?
ভেবে তাই না পাই দিশে নাই কি কিচ্ছু উপায় তার?
এ কথাটা যেমনি বলা রোগা এক ভিস্তিওলা
ঢিপ্ ক’রে বাড়িয়ে গলা প্রণাম করল দুপায় তার ।
ঢাকায় ১৮৭৮ সালের আগ পর্যন্ত কোন নিরাপদ পানির স্থায়ী ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। ১৭৮৪ সালে ঢাকার কালেক্টর পানীয় জলের খরচ বাবদ পেতেন ১৫০ টাকা।যেখানে ১ টাকায় দুমণ চাল পাওয়া যেত । এত টাকা পানীয় জলের পেছনে বরাদ্দের কারণ ছিল ঢাকার জল স্বাস্থ্যসম্মত ছিল না ।তার উপর সারা বছর চলতো কলেরার মহামারি। অভিজাত লোকজন সুদূরমেঘনা থেকেও জল আনতে পাঠাতো।
নবাব আবদুল গনি ও নবাব আহসানউল্লাহর সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ১৮৭৪ সালে চাঁদনীঘাটে স্থাপিত হয় ‘ওয়াটার-ওয়ার্কস’ পানি পরিশোধনাগার । তবে শুরুতে ঢাকাবাসীর জন্য সুপেয় পানির সরবরাহ ব্যবস্থা ছিল খুবই অপ্রতুল । প্রথমদিকে চার মাইল এলাকাজুড়ে পানি সরবরাহের পাইপ বিস্তৃত ছিল । দৈনিক পানি সরবরাহের পরিমাণ ছিল ৩৫ হাজার গ্যালন। ১৮৭৯ সালে ঢাকার নওয়াব আব্দুল গণি “কেসিএসআই” উপাধি পান । তিনি তখন ঢাকার পানি সংস্থান প্রকল্পে লাখ টাকা দান করেন।
ঢাকা শহরে ভিস্তিওয়ালারা বহুদিনযাবত তাদের পোক্ত অবস্থান ধরে রেখেছিল। ভারতবর্ষে ঢাকাই ছিল শেষ শহর যেখানে ষাটের দশক পর্যন্ত ভিস্তিওয়ালারা তাদের কাজ চালিয়ে যায়। ১৯৬৮ সালের দিকে এসে ঢাকা শহর থেকে তারা বিলুপ্ত হয়ে যায়।বর্তমানে পুরান ঢাকার সিক্কাটুলি দাঁড়িয়ে আছে ভিস্তিওয়ালা নামের অতীতের এক কর্মজীবীদের পেশার সাক্ষী হয়ে।
ভিস্তিওয়ালাদের ‘ভিস্তি আবে ভিস্তি’ হাঁকে এক সময় ঢাকা ও কলকাতার রাস্তা মুখরিত থাকত। সময়ের পরিক্রমায় সেই হাঁক আর শোনা যায় না।ভিস্তিওয়ালারা আজ প্রায় বিলুপ্ত একটি প্রজাতি। তবে মধ্য কলকাতার বো-ব্যরাক অঞ্চলে এখনও দেখা মেলে গুটিকয়েক ভিস্তিওয়ালার। কলকাতা কর্পোরেশনের পানিঐ অঞ্চলে পৌঁছলেও, প্রত্যেক ফ্ল্যাটে পানি এখনও পৌঁছায়নি। তবে এদের কাঁধে চামড়ার ব্যাগের দেখা মেলে খুব কম। রাস্তার টাইম কলে লম্বা লাইন দিয়ে পানির নাগাল পেতে হয়। কিছু মানুষ এখনও ওদের উপরেই ভরসা করেন পরিষ্কার পানির জন্য। একেকজন ভিস্তিওয়ালা দিনে দু’বেলা মোটামুটি ৩০টি পরিবারে পানি পৌঁছে দেন। এর জন্য মাসে চারশো টাকার মতো খরচ হয় একেকটি পরিবারে। তাই হয়তো এখনও টিকে রয়েছে ভিস্তিওয়ালারা। ধীরে-ধীরে এই শহরেও সময়ের প্রয়োজনে কমে আসছে ভিস্তিওয়ালার দর। হাতে গোনা যে কয়জন এখনও এই কাজ করেন, তারা চলে গেলে ভিস্তিওয়ালারা শুধু স্মৃতি রোমন্থনেই বেঁচে থাকবেন।
মোহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন,তথ্য অফিসার,তথ্য অধিদফতর,বাংলাদেশ সচিবালয়
Leave a Reply