দিন যতই যাচ্ছে মানুষের জীবনে ততই সমস্যা বাড়ছে। ফলশ্রুতিতে মানুষ আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছে। সারা জনম নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকার পর বার্ধক্যে উপনীত হয়ে সন্তানদের ভবিষ্যত নিয়ে ভাবতে শুরু করে। সন্তানদের বিয়ে দেয়ার সময় তাদের সুখী দাম্পত্য জীবনের কথা না ভেবে বিত্ত বৈভব এবং শক্তি সামর্থ বৃদ্ধির দিকে বেশী মনোনিবেশ করেন।যেমনটি করেছিলেন মুগল সম্রাট আকবর। তিনি ভারতবর্ষের তাঁর রাজত্ব দীর্ঘ স্থায়ী ও রাজ্যের পরিসর বৃদ্ধির জন্য নিজে এবং সন্তানদেরকে স্থানীয় প্রতাবশালী এমন কি হিন্দু রাজন্যবর্গদের সাথেও বৈবাহিক সম্পর্ক সৃষ্টি করেন। আজও সেই প্রথা সমাজে বিদ্যমান।
যার অনেক সম্পদ আছে কিন্তু সন্তান মাত্র ২/১ টা তার চিন্তা সম্পদ রক্ষার জন্য কোন জাঁদরেল অবিভাবক বা জনবহুল আত্মীয়- স্বজন থাকা প্রয়োজন। কিন্তু বৈবাহিক সূত্রে প্রাপ্ত অভিভাবক বা আত্মীয়- স্বজনরা যদি লোভী হয় তবে হিতে বিপরীত হতে পারে, তাঁরাই হয়ত সব গ্রাস করে ফেলতে পারে। তাই আল্লাহর উপর ভরসা না করে মানুষের উপর ভরসা করা নির্বুদ্ধিতা ছাড়া আর কিছু নয়।
কেহ কেহ আবার উচ্চ বংশ বা শিক্ষিত পরিবার পছন্দ করে। তেমনি এক লোকের ঘটনাই বলছি। এক লোক বয়:প্রাপ্ত হবার পূর্বেই তার পিতার মৃত্যু হয়। বিয়ের বয়স হতে নিজের পছন্দমত প্রাত্রী পছন্দ করবে এমন ব্যক্তিত্ব ছিল না। সে সব সময়েই ভাবত, নিজের পছন্দের স্ত্রী যদি মনপু:ত না হয় তবে সারাটা জীবন অসহনীয় দু:খ যন্ত্রনায় কাটাতে হবে, মনের যাতনা কাউকে বলে কিছুটা উপশমেরও উপায় থাকবেনা। তাই মা ও ভাই-বোনের উপর বিয়ের দায়িত্ব দিল। বোন ও ভাইয়েরা ভাবল, সে তো সহজ সরল মানুষ,তাকে যদি উচ্চ বংশে বিয়ে দেয়া যায় তবে তাকে তাঁরাই চালিয়ে নেবে। খোঁজাখুঁজিতে এমন সম্মন্ধ মিলেও গেল। পাত্রীর বাবা এলাকার বিরাট ব্যক্তিত্ব, শালাশালিরাও উচ্চ শিক্ষিত, মামারা , ফুফাত ও চাচাত ভাইয়েরা কেউ কারো চেয়ে কম নয়। অভিভাবকদের দৃঢ় বিশ্বাস জন্ম নিল যে, তার জীবনটা পরম সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে, কোন বাধা-বিঘ্ন ছাড়াই কেটে যাবে। এ যেন ঘর্মাক্ত হয়ে সব কয়টা সিড়ি বেয়ে সুউচ্চ প্রাসাদের চুড়ায় না উঠে বিনা আয়েসে নিমিষে তার সর্বোচ্চ তলায় উঠা। তাই কাল বিলম্ব না করে বিয়ের কাজ সম্পন্ন করা হল । হাজারে লোকের উপস্থিতিতে জাকজমকের সাথে তা অনুষ্ঠিত হল। কিন্তু দূর দুরান্ত হতে আগত বড় বড় আত্মীয়দের সাথে পরিচয় হওয়ার সুযোগ ঘটে নি। তবে বিদায়ের সময় সালাম করার জন্য উপস্থিত মুরুব্বীদের সংখ্যাধিক্যের কারণে লাইনে দাড়াতে হয়েছিল, বেচারী জামাইর সালাম করতে করতে ঘর্মাক্ত হতে হয়েছিল । বিয়ের কিছুদিন পর স্ত্রীর ইচ্ছা হল স্বামীকে তার বড় বড় আত্মীয়দের বাসায় নিয়ে গিয়ে তাদের সাথে পরিচিত হওয়া। অধিকাংশ আত্মীয়রাই ঢাকার অভিজাত এলাকায় থাকেন।
প্রথমেই তারা গেল বড় মামার বাসায়। এই মামা বিয়ে করেছেন নবাব পরিবারে। তাই সংসারের সর কাজকর্ম করার জন্য কাজের লোকের অভাব নেই। কিন্তু কারো কাজেই তার মন ভরে না। পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতায় তাঁর হাত দেয়া চাই।সারাদিনই চাকর- বাকরদের কোন না কোন কাজে ব্যাপৃত রাখেন। খাবার ব্যাপারে তার একটা অদ্ভুত নিয়ম ছিল। নির্ধারিত সময়ের বাহিরে কোন মেহমান এমন কি অতি আপন লোক আসলেও তাদেরকে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হত খাবারের জন্য। ফ্রিজ ভর্তি খাবার থাকলেও তিনি তাঁর কড়া অনুশাসনের ব্যত্যয় ঘটান নি।তারা সেদিন এই নিয়ম জানত বলেই নাস্তা খাবার সময় একজনের বাসায় গিয়ে অপ্রস্তুত না করতেই একটু দেরী করে গিয়েছিল। এতে উনি অত্যন্ত বিরক্ত হন। তবে তারা “সবার সাথে কেবল মাত্র পরিচিত হতে এসেছি, কোন বাসাতেই বেশিক্ষণ দেরি করব না “ বলাতে হয়ত তাদেরকে নাস্তা পরিবেশন করা হয়েছিল।
এরপর তারা গেল ছোট মামার বাসায় । তার প্রথম স্ত্রী এক কন্যা ও এক পুত্র রেখে অকালে মৃত্যুবরণ করলে তিনি দ্বিতীয় বিয়ে করেন। এই স্ত্রীরও আগের সংসারের সন্তানাদি আছে। তাই এখানে তেমন জামাই আদর পাওয়ার আশা ছিল ক্ষীণ। সেদিন তাই ফ্রিজ থেকে বের করা আইসক্রীমই ছিল আপ্যায়েন একমাত্র বস্তু। পরবর্তীতে এই মামা আইন কর্মকর্তার দায়িত্ব পরিত্যাগ করে শিল্পপতি হয়েছিলেন। তাই তাঁকে বিদেশে প্রায়ই যাওয়া-আসা করতে হত। জামাইর আত্মীয়রা বিমান বন্দরে তাকে দেখতে পেয়ে তাঁর সাথে পরিচিত হবার জন্য জামাইয়ে র বর্ণনা নানাভাবে দিবার পরেও তিনি না চিনার ভান করে এড়িয়ে যেতেন চান। কিন্তু তার আত্মীয়রা নাছোর বান্দা। উল্টো প্রশ্ন করেন, আপনি আপনার ভাগ্নি জামাইকে চেনেন না? তাঁর জবাব ছিল, দেখা সাক্ষাৎ নাই তো তাই এরূপ ঘটে।
এরপর তারা এক ফুফাত ভাইয়ের বাসায় । এই ভাই বড় ব্যবসায়ী , তাঁর সম্পদের পরিমাণ নিজেও জানতেন না। তাঁর প্রচন্ড ফুটবল প্রীতি ছিল। তাঁর দলের যেদিন খেলে সেদিন খেলোয়ারদের উৎসাহ দিতে টাকার বস্তা নিয়ে খেলার মাঠে যেতেন। দল জয়ী হলে খুশিতে মাঠের ভিতরে বস্তার টাকা উড়াতেন। সমর্থকরা তা কুড়িয়ে নিয়ে মিষ্টি বিলাতো। তারপর আরেক ব্যবসায়ী ফুফাত ভাইয়ের বাসায়। তাঁর স্ত্রী কোন রাজনৈতিক দলের স্থানীয় নেত্রী। তিনি জামাইর সাথে কিছুটা রসিকতা করলে, ননদের স্বামী বলে কথা। উভয় ক্ষেত্রে হাল্কা নাস্তা আপ্যায়ন। সর্বশেষে গেল আরেক ফুফাত ভাইয়ের বাসায়, তিনি সরকারী বিরাট কর্মকর্তা। ছেলে -মেয়েরাও উচ্চ শিক্ষিত। তখন দুপুর ২/২-৩০টা। জামাইর ধারণা এ বাসাতেই হয়ত দুপুরের খাবারটা সেরে নেয়া যাবে। কিন্তু বাড়ীর কর্ত্রী নাস্তা পরিবেশন করে অনেক আফসোস করে বলল, আমার বাজার করার লোক আছে, বাবুর্চি আছে, এক ঘন্টা আগে খবর দিয়ে আসলে রান্না করে খাওয়াতে পারতাম। ভাবখানা যেন পোলাও-কোর্মা ও বিরানী ছাড়া নতুন জামাইকে খাওয়ানো যায় না। তদোপরী তাঁদের ফ্রিজে যে খাবার থাকে তা দিয়ে ছোট খাট মেজবানী করা যায়। আসলে সমানে সমানে হয় দোস্তী। জামাই যদি বড় অফিসার হত বা বড় ব্যবসায়ী হত তখন সবার শুরু হয়ে যেত ছোটাছুটি, কোথা থেকে যে কত কিছুর জোগাড় হয়ে যেত! সেই যে দেখা এর পর আর কোন দিন তাঁদের সাথে দেখাও হয় নি, কোন সাহায্য হওয়া তো দূরের কথা।
এভাবে কোন প্রত্যাশা পূর্ণ না হলেও বড় লোকদের আত্মীয় হিসাবে পরিচয় দিতে জামাইর বুকটা ফুলেই উঠত।
ছোট্ট বালক হোসেনের মনেও এরূপ বংশ গৌরবের উদ্রেক হয়েছিল । আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মদ (স) তাঁর নাতি হাসান ও হোসেনকে অত্যধিক ভালবাসতেন। একদিন হোসেন নানাকে জিজ্ঞাসা করেন, নানা! আপনি বড় না আমি বড়?
রাসুল (স) স্বাভাবিকভাবে জবাব দিলেন, আমি বড়, আমি আল্লাহর নবীই নই সব নবীদেরও নবী আর তুমি আমার উম্মত।
হোসেন জবাব দিলেন, আমি মানিনা নানা! আমিই আপনার থেকে বড়।
রাসুল (স) বললেন, কেমনে?
হোসেন যে সকল যুক্তি উপস্থাপন করেছিলেন তা সংক্ষেপন নিম্নরূপ:-
১)আমর বাবা হযরত আলী(রা)কে আল্লাহ আসাদ উল্লাহ (আল্লাহর বাঘ) নামে অভিহিত করেছেন। তার সাহসিকতায় যুদ্ধক্ষেত্রে ভীতসন্ত্রস্ত থাকত শত্রুরা। তিনিই বালকদের মধ্যে প্রথম ইসলাম গ্রহণ করেন। আর তিনি বিশ্বনবীর জামাতা। পক্ষান্তরে আপনার বাবা আবদুল্লাহকে কেউ চিনে না এবং তিনি কোন নবীরও জামাতা নন।
২)আমার মা হযরত ফাতেমা (রা) যাকে আপনি অত্যধিক ভালবাসেন, সফরে যাবার সময় যার সাথে সর্বশেষে এবং ফিরে এসে সর্ব প্রথমে দেখা করেন। যাকে আল্লাহ বেহেশতের সর্দারনী বানিয়েছেন। আর আপনার মা আমেনা তো সবার অপরিচিত।
৩)আমার নানী খাদেজাতুল কোবরা তাহেরা(রা)। তিনিই তো সর্ব প্রথমে ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনিই তো সর্বস্ব দিয়ে বিপদে-আপদে আপনাকে আগলে রেখেছিলাম। যাকে আল্লাহ আরশ থেকে সালাম পাঠিয়েছেন এবং কবরের তিনটি প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন। পক্ষান্তরে আপনার নানী বাররা ইবনে আব্দুল উজ্জার নাম তো আগে কেউ শোনেনি।
৪)আমার নানা মুহাম্মদ(সা.) তো সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী। তিনি তো হাইজে কাউসারের মালিক। তাঁর শাফায়েত ছাড়া কে বেহেশতে যেতে পারবে? তাঁকে মুসলিম-অমুসলিম সবাই চিনে। আর আপনার নানা ওহাব ইবনে আবদে মোনাফের নাম তো আজ হারিয়ে গেছে।
এই অকাট্য যুক্তিগুলি শোনে যে কোন লোক বিভ্রান্ত হতে পারেন। নিন্মোক্ত ঘটনাটি এই যুক্তিগুলির অসারতা প্রমান করে।
হযরত ফাতেমা(রা)এর বেহেশতের সর্দারনী হবার অন্যতম কারন পর্দার যথাযত ব্যবহার। তিনি মাহরাম ছাড়া কারো সাথে দেখা দিতেন না। মৃত্যুর পর খাটিয়ার উপর লাশ দেখে জানাজায় অংশ গ্রহনকারীরা মৃতের আঁকার-আকৃতির ধারনা নিতে পারে এই আশংকায় অসিয়ত করে যান যে, তাঁর মৃত্যুর পর যেন কাউকে খবর না দিয়ে জানাজা শেষে দাফন করা হয়। তাঁর মৃত্যুর তাঁর স্বামী আলী(রা) দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলন। ঘরে আছেন হাসান হোসেন ও তিনিসহ মাত্র তিনজন। কিন্তু খাটিয়ার চার খুঁটি ধরতে লোক লাগে চার জন। হঠাৎ কোত্থেকে আবু জরগিফারী (রা) এসে সমস্যার সমাধান হলেও তিনি ভেবে পাননা ফাতেমা(রা) এর মৃত্যু খবর তিনি পেলেন কোত্থেকে? জিজ্ঞাসা করাতে তিনি জবাব দিলেন,” রাসুল(স) স্বপ্নে আমাকে চতুর্থ খুঁটিটি ধরতে নির্দেশ দিয়েছেন। দাফন শেষে কবরকে উদ্দেশ্য করে গিফারী(রা)বলেন,হে কবর! তোমার কাছে যাকে রেখে গেলাম তিনি সাধারন মহিলা নন, তিনি ইমাম হাসান ও হোসেনের মা, শেরে খোদা আলী (রা) স্ত্রী এবং জান্নাতের সর্দারনী এবং বিশ্বনবীর আদরের দুলালী।খবরদার তার সাথে দুর্ব্যবহার করোনা। আল্লাহর ইচ্ছায় কবর থেকে আওয়াজ এলো,” আমি ব্যক্তি পরিচয়ে কাউকে চিনি না। যে ভাল আমল নিয়ে আসবে তাকে করব সন্তুষ্ট আর যে খারাপ আমল নিয়ে আসবে তাকে করব পিষ্ট।”
ইহকালে কেউ আত্মীয়দের দ্বারা উপকৃত হতেও পারেন আবার না-ও হতে পারেন। কিন্তু পরকালে আল্লাহর রহমত পাবার একমাত্র উপায় আমল।
-আল মামুন জাহানগীরি, শিক্ষাবিদ, বর্তমানে কানাডা প্রবাসী
Leave a Reply