জগতে আনন্দযজ্ঞে আমার নিমন্ত্রণ (দ্বাদশতম পর্ব): সিরাজুল ইসলাম মুনির
আপডেট সময়:
মঙ্গলবার, ২৫ জানুয়ারী, ২০২২
১০৩
দেখেছেন
দেশে বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার নিচ্ছে, দুর্ভিক্ষের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে
‘নীল জোছনা’ মেয়েটির পরীক্ষাও শেষ হয়ে গেছে। বিআইডিসির ফুপুর বাসা থেকে সে চলে যাচ্ছে কক্সবাজার, সেখানে তার বাবা-মা,ভাই-বোন থাকে। যাওয়ার আগে একটা চিঠি লিখেছে,আমি পেলাম তার চলে যাওয়ার পর। তার সঙ্গে আমার দেখা হলো না।
সে লিখেছে, আমার রাজ-ঐশ্বর্য চাই না। যদি কোনোদিন তোমাকে আপন করে পাই,সেটাই হবে আমার পরম পাওয়া। আমি সৃষ্টিকর্তার কাছে সে প্রার্থনা করব জনমভর।
একদিকে এই বিচ্ছেদ-বেদনা যখন আমার অন্তরকে হিমাঙ্কের শুন্যস্তরে নামিয়ে আনে তখন অন্যদিকে আমার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে আরেক দুঃসংবাদ। গত দুইমাস থেকে আমার মানিঅর্ডার আসেনি। আমার ফুড চার্জ বাকি পড়ে যায়। আমি আশায় আশায় থাকি, মেস ম্যানেজারকে আশার কথা বলি, মানিঅর্ডার চলে আসবে, একটু ধৈর্য ধরো ভাই।
মেস ম্যানেজার প্রতিমাসেই আমাদের মধ্য থেকেই নির্বাচন করা হয়। আমিও কোনো কোনো মাসে ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করেছি। ফুড চার্জ বকেয়া থাকার অর্থ হলো আমি ম্যানেজারের কাছে ব্যক্তিগতভাবে ঋণগ্রস্থ হলাম। নতুন ম্যানেজার বকেয়া পাওনার দায় নেন না।
কারো ফুডচার্জ বকেয়া পড়েছে, এটা খুবই আন-ইজুয়াল একটা বিষয়। আমার লজ্জাই লাগে। কী যে করব ভেবে পাই না।
একদিন সকাল বেলা চিঠি লিখছিলাম সেজকাকুর কাছে। দুই মাস টাকা পাই না। বিপর্যস্ত জীবন। আমার জীবন আর ভিক্ষুকের জীবনের মধ্যে একটাই পার্থক্য, ভিক্ষুক হাত পাতে,আমি হাত পাততে পারি না।….
চিঠিটা অসম্পূর্ণ রেখে আমি টয়লেটে গেলাম। যাওয়ার সময় চিটিটা টেবিলের উপর কলম-চাপা দিয়ে গিয়েছিলাম। তখন সেখানে এলেন নুরুল হক মনজু ভাই। গত কয়েকদিন ধরেই আমার কাছে তিনি নিয়মিত আসা-যাওয়া করছিলেন। সারা বছর তারা রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। এখন পরীক্ষার সময় কাছাকাছি হওয়ায় তাদের মাথা খারাপ অবস্থা। মনজু ভাই এবং আরো দুই সিনিয়র ভাই বিগত কয়েক বছরের পুরনো প্রশ্নপত্র জোগাড় করে এনে আমাকে বললেন, তুমি একটা সাজেশন বানিয়ে দাও ছোটভাই।
আমি প্রশ্ন আর তাদের বই-টই দেখে বুঝলাম, কেন তাদের সারা বছর না পড়লেও চলে। রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ইতিহাস অন্যান্য ইলেকটিভ বিষয়ে কমন কিছু প্রশ্ন আছে, যেগুলো থেকে সর্বোচ্চ দশটা করে প্রশ্নের উত্তর জানলে আর কিছু সংক্ষিপ্ত প্রশ্নের উত্তর জানা থাকলে পাশ করা কঠিন কিছু নয়। কিন্তু ওদের সমস্যা হলো ইংরেজি ও বাংলায় অধিকাংশই ফেল করে বসে। গত বছর ডিগ্রিতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশের হার ছিল মাত্র এক পার্সেন্ট এবং তারা ছিল বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র। কলা বিভাগ থেকে কেউ পাশ করতে পারেনি।
আমি টয়লেট থেকে ফিরে এসে দেখি মনজু ভাই মাথা নিচু করে বসে আছেন।
বললাম, মনজু ভাই, কাল দেব।
আমার কথার জবাব না দিয়ে বললেন, তুমি টাকার সমস্যায় আছ,আমাকে বললে না কেন?
বুঝলাম, তিনি আমার চিঠিটা পড়ে ফেলেছেন। অন্যের ব্যক্তিগত চিঠি পড়া অন্যায়, এই বোধ নিশ্চয়ই নুরুল হক মনজুর আছে। কিন্তু তাকে প্রতিবাদ করে আমার কিছু বলা হয়না, কারণ তাঁর জিজ্ঞাসার ভঙ্গি ছিলো সহমর্মিতার। আমি যেন অপরাধী, মাথা নিচু করে বসে থাকি।
মনজু ভাই চলে গেলেন। কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে দুটো একশো টাকার নোট দিয়ে বললেন, এটা নাও। ফেরত দিতে হবে না।
টাকা নিতে চাইলাম না। বললাম, টাকা এলে ফেরত দেব।
বললেন, ঠিক আছে।
আমি বাকিপড়া ফুডচার্জ দিয়ে এলাম।
সেদিনই সারাদিন খাটাখাটুনি করে আমি দশটা করে প্রশ্ন লিখে দুই বিষয়ের প্রশ্নপত্র তৈরি করলাম। তাদের কাছে বান্ডিলবাঁধা অনেকগুলো প্রশ্নের উত্তরপত্র তৈরি করা ছিল, সেগুলো নিয়ে এলাম। দেখলেই বোঝা যায়, বছরের পর বছর ধরে এগুলো উত্তরাধিকার সূত্রে তারা প্রাপ্ত হয়েছেন। এমন যে অবস্থা, একই বান্ডিলের মধ্যে বাংলা-ইংরেজি-ইতিহাস-রাষ্ট্রবিজ্ঞান সব বিষয়ের উত্তর লেখা আছে। কোনো কোনোটার দুই-তিনটা করে উত্তর রয়েছে। কিন্তু এগুলোকে বিষয়ভিত্তিক আলাদা পর্যন্ত করা হয়নি।
আমি পরের দুইদিন প্রশ্ন ও উত্তর মিলিয়ে মিলিয়ে সাবজেক্টগুলো আলাদা করলাম। যে উত্তরগুলো দুর্বল, বই থেকে তথ্য যোগ করে সেগুলো নতুনভাবে সাজালাম অক্লান্ত পরিশ্রম করে। মনজু ভাইদের পেপারগুলো বুঝিয়ে দিয়ে বললাম, ইংরেজির দায়িত্ব নিতে পারব না।এটা অনেক কঠিন। অনেক আনসিন প্রশ্ন আসে। আপনারা কোনো স্যারের সাহায্য নেন।
দিন চলে যায়, আমাদের নতুন শিক্ষক আসেন না। কিন্তু ফার্স্ট ইয়ারের পরীক্ষা চলে আসে। আমরা পরীক্ষা দিলাম। পাশের নম্বর দেখে আমাদেরই লজ্জা লাগে। আমরা সেকেন্ড ইয়ারে উঠলাম, একথা না বলা ভালো, আমাদের সেকেন্ড ইয়ারে ওঠানো হলো।
বিআইডিসিতে মাঝে মধ্যে যাই। কিন্তু শৈশব-কৈশোরের বন্ধুদের, সহপাঠীদের পাই না। ওখানে গেলে মনটা আরো ভার হয়ে যায়। কাকুর পক্ষে আমাকে নিয়ম করে টাকা-পয়সা দেওয়া সম্ভব হয় না। তবু কখনো খালি হাতে বিদায় করেন না।
গ্রাম থেকেও টাকা আসা অনিয়মিত হয়ে গেছে। দুই মাস হয়তো খবর নেই। চিঠি লিখলে কখনো একশো, কখনো দুইশো টাকার মনিঅর্ডার আসে।
দেশে বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার নিচ্ছে, দুর্ভিক্ষের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে। পত্র-পত্রিকার পাতা ভরে এসব সংবাদ ছাপা হচ্ছে। আমি গণকন্ঠে সংবাদ পাঠাই। নিয়মিত পত্রিকাটির পাঠকও বটে। সরকারবিরোধী পত্রিকা বলে এসব সংবাদ ফলাও করে ছাপা হয়। চাল-ডাল-তরিতরকারী-মাছ-মাংসের দাম কেবল বাড়তেই থাকে। মাঝেমধ্যে মানুষের দুঃখ-দুর্দশায় ভরা করুণচিত্রের সংবাদ পড়ে মন খারাপ হয়ে যায়।
রেডিওতে খবর পড়ি। স্থানীয় সংবাদ নাম হলেও এর ভৌগোলিক বিস্তার দূরবর্তী হবিগঞ্জ, মৌলভিবাজার, সুনামগঞ্জ, জকিগঞ্জ ও সন্নিহিত অঞ্চল। দুর্ভিক্ষ মোকাবিলায় এসব অঞ্চলে সরকারের গৃহীত নানা পদক্ষেপের সংবাদ থাকে, যা দেশের অন্যান্য অঞ্চলের সংবাদেরও প্রতিফলন। দুই সংবাদ মাধ্যমে কাজ করা এবং একইসঙ্গে রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে সম্পৃক্ততার কারণে আমি দেশের চলমান পরিস্থিতি সম্পর্কে কিছুটা অবহিত ছিলাম।
আমার আর্থিক দুরবস্থার কথা নুরুল হক মনজু হয়তো বুঝতে পারেন। আমাকে সহযোগিতা করার জন্য তিনি একটা পথ বের করলেন। আমাদের হোস্টেলে মাসের শেষ দিন ইমপ্রুভ ডায়েট বা ফিস্ট হয়। যে ম্যানেজার সারা মাস ভালো মাছ-মাংস খাওয়াতে পারে এবং উদ্বৃত্ত টাকা খরচ করে ভালো ফিস্ট খাওয়াতে পারে,তার বাহবা হয়। এরকমই এক ফিস্টের রাতে হঠাৎ করে ডাইনিং রুমে নাটকীয়ভাবে মনজু ভাই আমাকে জড়িয়ে ধরে ঘোষণা করলেন, আজ থেকে মনি আমার ভাতিজা। সে অনেক ভালো ছেলে।
সবাই হাততালি দিয়ে আমাদের নতুন সম্পর্ককে অভিবাদন জানাল।
Leave a Reply