মুজিব আর আমার জীবনের মূল্যবান সময়গুলো পড়াশোনা বাদ দিয়ে সিনেমা দেখে কাটতে লাগল। মাঝেমধ্যে আক্ষেপ করত মুজিব, শেষ পর্যন্ত বৃদ্ধ
আজির হোসেন হয়ে বাড়ি ফিরতে হবে। এইসব কষ্টের মধ্যেও পিপাসার্ত চাতকের ঠোঁটে আকাশ থেকে ঝরে পড়া একটু জলের শান্তির মতো আমারও হৃদয়ে প্রশান্তি নিয়ে আসতো নীল জোছনার চিঠি। খলিলুর রহমান কাসেমীর ডাকবাক্স নম্বর তাকে পাঠিয়ে ছিলাম।ওখানে সমীকরণের জন্য লেখা আসে। সেখানেই তার চিঠিও আসে। কাসেমী ভাই তার ডাকবাক্সের একটা ডুপ্লিকেট চাবি আমাকে দিয়েছিলেন।
আমার স্বপ্নবৃক্ষ থেকে যখন প্রতিদিন একটা একটা করে বর্ণিল পাতা ঝরে ঝরে পড়ছে, তখন নীল জোছনার পাঠানো চিঠি থাকে স্বপ্নের আবীর মাখা। তার স্বপ্নের ভূবন প্রসারিত হতে থাকে ভূবনজুড়ে। সেই কবে হয়তো বলেছিলাম,’একদিন আমার সবই হবে,গাড়ি-বাড়ি।’ সেটার জবাব দিচ্ছে এতটা দিন পর, ‘না না তোমার গাড়ি-বাড়ি নয়,তুমি নিঃস্ব হলেও হৃদয়ের ঐশ্বর্য দিয়ে তোমাকে পেতে চাই।’ আরো কত কী যে কথা…
এমন চিঠি পাবার পর কার না নতুন করে স্বপ্ন দেখতে ইচ্ছে করে! কিন্তু আমি পথ খুঁজে পাই না। আমি কেবল পারি নীল জোছনাকে নিয়ে কবিতা লিখতে, গল্প লিখতে। পারি আর না পারি, কবিতা-গল্প হোক আর না-হোক ওগুলো লিখে আমার সময় কাটে। যদিও সে-সবের প্রায় সবই জঞ্জাল হয়ে কোথায় হারিয়ে গেছে!
সৈয়দ মুজিবের ‘ষোলো’ এখন সতেরো-আঠারোতে ছুটছে, নীল জোছনাও কলেজে ভর্তি হয়েছে, সে তার স্বপ্ন বুকে নিয়ে ঘুমায়,দু’চোখে স্বপ্ন নিয়ে জেগে ওঠে।
একদিন পরিচয় হলো কবি-গল্পকার আবদুল হামিদ মোহাম্মদের সঙ্গে। সে আমারই সমবয়সী, যুগভেরীতে কাজ করে। কথায় কথায় বলল, সে-ও এমসি কলেজে পড়ে, বিএ ক্লাসে।ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেছে এমসি ইন্টারমিডিয়েট কলেজ থেকে। হামিদ জোর করেই ধরে নিয়ে গেল তার বাসায়। পূর্ব ঈদগাহের চানমারি টিলার উপর তাদের বাসা। সবুজ ঘাসে ঢাকা উন্মুক্ত এক টিলার উপর একরুমের ছোট্ট একটা দালান। আশ্চর্য! এই টিলার উপর একটা গাছ পর্যন্ত নেই। টিলার উপর দাঁড়ালে খোলামেলা বিস্তীর্ণ সিলেট শহরের নান্দনিক দৃশ্য চোখে পড়ে।
এই বাসাটা সম্ভবত এই সুন্দর টিলার মালিকের। হামিদ আর তার বন্ধু চান মিয়া এই বাসাটা ভাড়া নিয়েছে। চান মিয়া মদন মোহন কলেজে বিএ পড়ে। সে-ও আমাদের সমবয়সী।
ওই একরুমের দালানে দুটো বড় চকি পাতা আছে,সেখানে বিছানা বিছানো। ওই ঘরেই রান্নাবান্নার ব্যবস্থা। টিলার শেষ মাথায় ছোট একটা পায়খানা আছে। একটা টিউবওয়েল আছে। অনেক্ক্ষণ চাপাচাপি করলেও পানি ওঠে না। চান মিয়া বলল,ঘুস খাওয়াতে হবে।
ঘুস?
চান মিয়া একটা ছোট বালতি ভরে কলের মধ্যে পানি ঢাললো। তারপর কয়েক চাপ দিতেই পানির প্রবাহ।
চান মিয়া বলল, পানি পেতে হলে এই বালতির মধ্যে ঘুসের পানি জমা রাখতে হবে।
হামিদ-চানমিয়ারা আমাকে ছাড়লো না। তাদের অবস্থাও কিছুটা আমার মতো। কবে যে পরীক্ষা হবে তার কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই। সময় কাটাবার জন্য হামিদ যুগভেরীতে কাজ ধরেছে,চান মিয়া ব্যবসা করার ধান্দা করছে। তাদের টাকা-পয়সা আছে, পরিবারের কেউ হয়তো লন্ডন থাকে, টাকা-পয়সা নিয়ে মাথাব্যথাও নেই। আমার যে মাথাব্যথা আছে, সেটা আমি বুঝতে দিতে চাই না। আমাকে তাদের সঙ্গে থাকতে হলো পনেরো দিন। আমার সাহচর্য তাদের হয়তো ভালো লেগেছে, সে কারণেই আমাকে তারা ছাড়েনি। পনেরোটা দিন আমার জন্য ছিলো খুবই আনন্দের দিন। যুগভেরীতে ছাপা হওয়া আমার প্রথম গল্পটা হামিদ পড়েছে। সে জোর করে আমাকে দিয়ে গল্প লেখালো,কবিতা লেখালো।একটা কবিতার নাম ছিল ‘….আমার কাব্যলক্ষী’। কয়েকটা লাইন মনে আছে।
‘অস্তিত্বের বেলাভূমিতে
জাগ্রত সৈনিক হেরে গেল
তোমার উদ্বেল উচ্ছল উন্মিলনে
সর্বনাশের চঞ্চলতায় বিভীষিকাময়
বিপর্যস্ত তাণ্ডবতায় আমার রাজ-হৃদয়
কেমন পৈচাশিক যন্ত্রণায়
অবক্ষয়ের চোরাবালিতে।’
ছাপা হওয়া সে-সব কবিতা-গল্প যে মান-উত্তীর্ণ হয়েছে আমার মনে হয় না। তবে সে-সব কবিতা-গল্পও কোথায় য়ে হারিয়ে গেছে,জানি না।
কবি গিয়াসউদ্দিন সেলিমও কাজ করতেন যুগভেরীতে। তিনি ‘জন্মসুখে’ নামে একটা ম্যাগাজিন প্রকাশ করবেন। আমাকে বললেন, গল্প দেন।
এবার একটা গল্প লিখলাম, প্রেম-ভালোবাসার বাইরে। জলোচ্ছ্বাসের কারণে বাঁধে আশ্রয় নেয়া সর্বহারা মানুষের মৃত-স্বজন, গবাদি পশু আর গেরোস্থালি সম্পদ ভেসে যাওয়ার দৃশ্য দেখতে দেখতে সর্বহারা মানুষের আহাজারি আর তাদের সমবায় সমিতির সাইনবোর্ড রক্ষার গল্প ‘সর্বহারা সমিতি’। সেই গল্প ছাপা হতে হতে পরের বছর হয়ে গেল। ততদিনে আমাকে সিলেট শহর ছেড়ে যেতে হয়েছে। বহুবছর পর, প্রায় দেড়যুগ পর আমি আবার যখন কর্ম উপলক্ষে সিলেট গেলাম, তখন গিয়াসউদ্দিন আউয়াল আমাকে তার ‘জন্মসুখে’র ফটোকপি উপহার দিলেন।
চানমারি টিলার মায়া কাটিয়ে চলে গেলাম কাশীকাফন। মনজুর বাবা-মা খবর না দিয়ে এতদিন বাইরে থাকায় অনুযোগ করলেন। কলেজের দোহাই দিয়ে বুড়োবুড়ির মনকে শান্ত করলাম।
পরদিন দুপুরবেলা। খেয়েদেয়ে গড়াগড়ি দিচ্ছিলাম। মনটা বিষণ্ন,কিছুটা বিক্ষিপ্তও। তখন বুলবুল এলো।
বলল, মনি ভাই, তুমি খই আছলায়? অতদিনে মনে অইলনি আমরার খতা? নানায় তুমার খতা মামারে খতবার জিগাইছইন!
বললাম, কাজ আছিলো।
বুলবুল বলল,তুমি আছলায় খই?
আমার বিরক্ত লাগছে। এই পিচ্চির কাছেও জবাবদিহি করতে হবে!
বললাম, খই আছলাম,তরেও কওয়া লাগবোনি?
বলল, খেনে,খইলে সমস্যা কি তা?
বিরক্তি নয়,এবার আমার রাগ হল। বললাম, জ্বালাইছ না। ইন তাকি যা।
আমি বুলবুলের দিকে পিঠ রেখে শুয়েছিলাম। বুলবুল আমার পিঠে ধাক্কা দিল, বসে থাকল,কিন্তু গেল না।
আমি বললাম, যাছনা খেনে।
বুলবুল বসে থাকে।
রাগ করে বললাম, যাছনা বে।
একটু সময় চুপচাপ। পেছন ফিরে দেখি, বুলবুল ঠোঁট ফুলিয়ে নিঃশব্দে কাঁদছে ।
আমি উঠে বসলাম। বললাম, কান্দস খেনে?
এবার বুলবুলের কান্না দ্বিগুণ হয়।
আমি উদ্বিগ্ন হই। বলি, কী তা অইছে?
বুলবুল কেঁদেই চলে,নিঃশব্দে।
আমি বলি,খান্দস খেনে বে?
বুলবুল এবার শান্ত হয়। কিছু একটা ফয়সালা করার উদ্দেশ্য নিয়েই আমার মুখোমুখি বসে।
বলল, তুমি কিতা মোরে শাফিয়ার মা (বাড়ির কাজের বুয়া) ফাইলায়নি যে তুমি আমার লগে ‘বে’ খইয়া মাতলায়?
বললাম, তে কি-তা অইলো?
বুলবুল বলল, তুমি নোয়াখালী বেটা,বুঝবায় কীলাখান!
বুঝলাম, সমস্যা গম্ভীর।
বুলবুল বলল,আমার নানা-নানি,আমার মামু তুমার লগে কিলাখান মাতৈইন! তারা তুমার লগে ‘বে’ খইয়া মাতেনি? তারা তুমারে বা-বো কইয়া মাতোইন। আমার লগেও তুমি বা-বো খইয়া মাততা আছলায়।
একটু সময় চুপ করে থেকে ফের বলল, তুমি তুমার বন্ধুরে ‘বে’ খইয়া মাতবায়,আরবার তুমার ঘরোর কামোর ফুয়া-ফুড়িইনতোরে ‘বে’ খইয়া মাতবায়। তোমার বড় কেউ তুমারে ‘বা-বো’ খইব,তুমিও তোমার হুরু যারা আছে, তারার লগে ‘বা-বো’ খইয়া মাতবায়।
আমার সিলেট বসবাসের তখন একযুগ পার হয়ে গেছে। সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলায় আমি দক্ষ একজন মানুষ। বন্ধুরা বলে,তুমি তো জড় বিছাইলাইছ!
অামি সিলেটের ব্যবহারিক ভাষায় দক্ষ হয়েছি সত্য, কিন্তু এই ভাষার যে সুন্দর একটা গ্রামার আছে, সেটা সচেতনভাবে কখনো ভেবে দেখিনি, এমনকি যারা সিলেটি ভাষার নাগরিক, তারাও হয়তো ভেবে দেখেননি। অথচ মাত্র আট বছরের একটি বালিকা আমাকে এই চমৎকার গ্রামারটি ধরিয়ে দিল।
( চলমান——)
Leave a Reply