“সরকারী কলেজের অধ্যক্ষ হয়েও মনে হত না সমাজে তেমন মূল্যবান
তুমি আমার ভুল ভাঙ্গালে, শিক্ষকতাকে দিয়ে শ্রেষ্টত্বের সম্মান।
তোমার মতে, সকল উন্নতির পেছনে যে শিক্ষার অবদান
শিক্ষকরাই সেই অমূল্য সম্পদ অকাতরে করে যাচ্ছে দান,”
উপরোক্ত কয়েকটি লাইন আমার রচিত” মায়ের স্মৃতি” কবিতার প্রাসঙ্গিক অংশ। হয়ত তাই আমরা তিন ভাই এই পেশা বেছে নিয়েছিলাম এবং অপর তিন ভাই শিক্ষকতা দিয়ে জীবন শুরু করেছিলেন। শিক্ষকরা যে সমাজের চোখে কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ আমার বাস্তব জীবনেও তার সম্মক প্রমান পেয়েছি। তা সংক্ষেপে বলছি।
ক)নোয়াখালী কলেজটি সরকারিকরন করার সাথে সাথে সিলেটের জনৈক করিতকর্মা লোককে অধ্যক্ষ করে পাঠানো হয়। তিনি এসে দেখেন যে,অধ্যক্ষের থাকার কোন নির্ধারিত বাসা নেই। তিনি তখন তাঁর ব্যক্তিগত প্রভাব খাটিয়ে জেলা প্রশাসন হতে আবাসিক এলাকার একমাত্র একতলা বাংলো টাইপের বাসাটি বরাদ্দ নেন। সে সময় হতে বাসাটি কলেজের নিয়ন্ত্রনেই ছিল। অধ্যক্ষ না থাকলে কোন প্রবীন শিক্ষক তাতে বসবাস করেছেন। এমন সুন্দর ও সবার থেকে আলাদা একটি বাসায় শিক্ষকরা থাকবে এটা বোধ হয় ডিসি অফিসের কর্মকর্তাদের সহ্য হচ্ছিল অথবা কারো বাসাটি অত্যাধিক পছন্দ হয়েছে। তাই তাঁরা তাকে তাকে ছিল কখন বাসাটি খালী হয়। এতদিন বাসাটির বরাদ্দে প্রথমে মৌখিকভাবে অধ্যক্ষের সম্মতিতে দখলের পরে গণপূর্ত বিভাগকে অবহিত করলে তারা লিখিত বরাদ্দ দিত। এবারও বাসাটি খালি হলে অধ্যক্ষের সাথে পরামর্শ করে বাংলা বিভাগের অধ্যাপক মোয়াররফ হোসেন বাসায় উঠে পড়েন। অনুমোদনের জন্য দরখাস্ত করার আগেই তাঁর অবস্থানকে অনুমোদন দেয়ার পরিবর্তে কোন সময় না দিয়ে বাসা ছেড়ে দেবার জন্য গণপূর্ত বিভাগ চিঠি দেয়। অবাক কান্ড তিনি যেন আইনের আশ্রয় নিতে না পারেন তার জন্য অফিস বন্ধ হয়ে যাবার পর অর্থাৎ বৃহস্পতিবার বিকালে তাঁকে উচ্ছেদের জন্য আইন- শৃঙ্খলা বাহিনী প্রেরিত হল।অকস্মাৎ অভিযানে মোয়াররফ সাব যখন কিংকর্তব্যবিমূঢ় তখন খবর পেয়ে আবাসিক এলাকায় বসবাসরত সকল শিক্ষকরা এসে ম্যাজিষ্ট্রের সাথে কথা বলতে চাইলেন।কিন্তু তিনি কিছুই শোনতে প্রস্তুত নন, কি করা যায় যখন এই সব ভাবছি তখন পঙ্গপালের মত চারিদিক থেকে ছাত্ররা ছুটে এসে পুলিশের সামনে দাড়িয়ে গিয়ে বলল, আমাদের জান থাকতে কেহ আমাদের স্যারকে বের করতে পারবেনা, অসংখ্য ছাত্রের সামনে কয়েকজন পুলিশ প্রমাদ গুনল।ম্যাজিষ্রের সাথে একান্তে আলাপ করে রণে ভঙ্গ দিল। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম, যারা পরীক্ষার হলে শিক্ষকদের প্রতিদ্বন্ধী তাঁরাই আজ তাঁদের জন্য জান দিতে প্রস্তুত। আসলে বাস্তবতা হচ্ছে,শল্য চিকিৎসক যেমন রোগীর পেট কাটে তার ক্ষতি করার জন্য নয় বরং সুস্থ করার জন্য তেমনি শিক্ষকরা পরীক্ষার্থীকে নকল করতে দেয় না বা বহিষ্কার করে তার জীবন নষ্ট করার জন্য নয় বরং তার জীবনকে সুন্দর করার জন্য।
খ) ১৯৬৯ সালে আমি চট্টগ্রাম উচ্চ মাধ্যমিক কলেজের প্রভাষক ছিলাম।সে সময় রবিউল হোসেন উক্ত কলেজের মানবিক বিভাগের ছাত্র ছিল। আমি গণিতের শিক্ষক বলে তার সাথে আমার ক্লাশ ছিল না। তবে কলেজটি সদ্য প্রতিষ্ঠিত বলে শিক্ষার্থীর সংখ্যা খুবই কম ছিল। সে কারণে হয়ত তার সাথে দেখা সাক্ষাত হতে পারে। আমাদের শিক্ষক সংখ্যা কম বলে হয়ত সে আমাকে দেখতে পারে। এতটুকুই তার সাথে আমার পরিচয়। দুই যুগেরও অধিক পরে সে যখন নোয়াখালী পৌরসভার চেয়ারম্যান পদে দাড়িয়ে তার কর্মী সমর্থকদের নিয়ে আমার বাসায় গিয়ে বলে,স্যার আমি চট্টগ্রাম উচ্চ মাধ্যমিক কলেজের ছাত্র,আমি ভোটের জন্য নয়, আপনার দোয়ার জন্য এসেছি।তখন আনন্দে আমার মন ভরে যায়।নির্বাচিত হয়ে কোর্ট বিল্ডিং – এর সামনে কোন এক ঈদের জমাতে বক্তব্য রাখতে গিয়ে আমাকে সে যে সম্মান দেখিয়েছিল তাতে মনে হয় শিক্ষকতার চেয়ে মহান পেশা আর নেই।
গ) নোয়াখালী কলেজের বাংলা বিভাগের জনৈক অধ্যাপক, নেহায়েত সাদাসিধে লোক, বয়স খুব একটা বেশী না হলেও স্বাস্থ্যগত কারনে দেহ ভেঙ্গে পড়েছে। এ সমস্ত কারনে পাঠদানে তেমন সফল নন। তাই দিনে দিনে শিক্ষার্থীদের কাছে হাস্যাস্পদ হয়ে উঠেছেন, সামাজিক মর্যাদাও লোপ পাচ্ছিল।একদিন তিনি বাসে করে কলেজে আসছেন। তাঁর এই সরলতার সুযোগে বাস কন্টাক্টর তাঁর সাথে দুর্ব্যবহার করে বসে। সেই বাসে কলেজের কয়েকজন ছাত্র ছিল, তারা ঘটনাটি অবলোকন করে উত্তেজিত হয়ে কন্ট্রাকটর ও ড্রাইভারকে বাস থেকে নামিয়ে দেয়। এতে অন্য বাসের কন্ট্রাকটর, হেলপার ও ড্রাইভাররাও বচসায় জড়িয়ে পরে। তখন আরও ছাত্র জড়ো হয়ে সব যানবাহন বন্ধ করে দিয়ে অচলাবস্থা সৃষ্টি করে। আমি তো শোনে অবাক। দুষ্ট ছেলেদের হাসাহাসিতে যার ক্লাশে পাঠদান করতে বেহাল অবস্থায় পড়তে হয় তাঁর জন্য তাদের এত দরদ! অবস্থা পরিস্থিতির বাইরে চলে গেছে শোনে ডিসি ও এসপি এসে বহু কষ্টে মিমাংসা করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে আনে।
ঘ)আমি যখন খাগড়াছড়ি কলেজের অধ্যক্ষ তখন খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার স্থানীয় সরকার পরিষদের অন্যতম সদস্য ছিলেন জনাব জানে আলম। শোনেছি তিনি আগে খাগড়াছড়ি কলেজের ছাত্র ছিলেন। তিনি মাঝে মাঝে কলেজে আসলে তাঁর শিক্ষকদের অত্যাধিক সম্মান প্রদর্শন করেন। আমার সাথেও সালাম বিনিময় হয়েছে। তবে তেমন হৃদ্যতা গড়ে উঠেনি।
অবসর গ্রহন করার চার বছর পর অর্থাৎ ২০০৭ সালে সস্ত্রীক হজ্জে যাচ্ছি, সঙ্গে আছেন বন্ধু নাজমুল হোসেন ও তার স্ত্রী, এছাড়া সবাই অপরিচিত। এ সময়ে জানতে পারলাম খাগড়াছড়ি হতে জানে আলম সাবও যাচ্ছেন। নতুন জায়গায় আরেকজন পরিচিত লোক পাচ্ছি ভেবে ভাল লাগল। জেদ্দা বিমান বন্দরে নেমে দেখা হল, ভাব বিনিময় হল। কিন্তু একান্তভাবে গল্প করার সুযোগ ঘটেনি। মোয়াল্লিমের পরিচালনায় হজ্বের নিয়ম কানুন মেনে চলছি। এরই মধ্যে লক্ষ্য করলাম জানে আলম তাঁর স্বভাবসুলব আচরন দিয়ে অনেককে কাছে টানতে পেরেছেন। হজ্জ সম্পাদন শেষে মিনাতে অবস্থান করে কোরবানী দেয়া, শয়তানকে পাথর ছোঁড়া ও চুল কাটার জন্য অপেক্ষা করতে হয়। এ সময়ে মোতওয়ালী ও হজ্জ আয়োজক অন্যত্র কাজে ব্যস্ত থাকায় দুই বেলা নামাজ সদ্য হাজীদের নিজেদের দ্বারাই সম্পাদিত হতে হবে। অনেক উপযুক্ত লোক থাকতে জানে আলম সাব আমাকেই ইমামতি করার অনুরোধ জানাল। এরূপ গুরু দায়িত্ব সম্পাদনের জন্য আমাকে অনুরোধ করাতে আমার প্রতি তাঁর আস্থা দেখে আমি অবাক হলেও না করতে পারলাম না। এমন পবিত্র জায়গায় অতগুলি ধর্মপ্রান লোকদের নামাজে নেতৃত্ব পেয়ে মনে মনে আমি আল্লাহর শোকরিয়া আদায় করলাম। আল্লাহকে বললাম, আমি নালায়েক হলেও আল্লাহ, যাদেরকে নিয়ে হাত তুলেছি তারা সদ্য হজ্জকৃত, তোমার মাফকৃত বান্দা। আল্লাহ! তোমার নেক বান্দাদের ওয়াছিলায় আমাদের সবাইকে মাফ কর, সুখ দাও, সমৃদ্ধি দাও,দেশকে বালামুছবতের হাত থেকে রক্ষা কর, বিশ্বের সব নির্যাতিত লোকদের রক্ষা কর ইত্যাদি । সেদিনে জানে আলম সাবের এরূপ সম্মান প্রদর্শন আমাকে নয় বরং একজন শিক্ষককে মহিমান্বিত করেছিল।
ঙ)২০০৮ সালে কানাডা আসতে আমার কর্মজীবন বৃত্তান্ত সনদ আনার প্রয়োজন হল। অবসর গ্রহণ করেছি প্রায় পাঁচ বছর হয়েছে। শিক্ষা ভবনে কারো সাথে জানাশোনা নেই। হঠাৎ মনে পড়ল খাগড়াছড়ি কলেজে কিছুদিন কর্মরত ছিলেন জনাব রফিকুল ইসলাম খানের কথা। তাঁর বাসা ঢাকা বলে ঢাকার সব শিক্ষা অফিসে তাঁর বহু যাতায়াত।তিনি বঙ্গভবনেও চাকরী করেছেন। তাঁকে ফোন করাতে তিনি আমাকে তাঁর বিশেষ পরিচিত ও মাউশির পরিচালক (কলেজ ও প্রশাসন) খান হাবিবুর রহমানের সাথে দেখা করতে বললেন।যথারীতি আমি তাঁর কাছে গিয়ে রফিক সাব পাঠিয়েছেন, বলে জানালাম। তিনি আমার দিকে তাকিয়েই বললেন, স্যার,আপনি চট্টগ্রাম উচ্চ মাধ্যমিক কলেজে ছিলেন না? আমি হ্যাসূচক জবাব দিলে সে আমার ছাত্র বলে পরিচয় দিল। তাতে দুজনেরই আনন্দের শেষ নেই।ফলে তার সহায়তায় কাজটা তড়িৎ হয়েছিল। সে না থাকলে শিক্ষা অফিসের কেরানীরা কেরামতি দেখিয়ে হয়ত সামান্য একটি কাজের জন্য মাসের পর মাস আমাকে ভোগাত।
এগুলি পড়ে কারো মনে হয়ত হতে পারে মোল্লার দৌড় মসজিদ পর্যন্ত, শিক্ষকের মর্যাদাও শুধু শিক্ষার্থী পর্যন্ত। আসলে তা নয়, অতীতে দেখে এসেছি অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের ওস্তাদদেরকে ক্ষেতের প্রথম ফসল, গাছের প্রথম পাকা ফল ও তরিতরকারী না দিয়ে নিজেরাও খেত না। এগুলি পারিশ্রমিক দেয়ার জন্য নয় , বরং ভালবাসা ও শ্রদ্ধা হতে।
এরপরেও প্রশ্ন উঠতে পারে, এতো কেবল শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ, এর বাইরের লোকদের কাছে শিক্ষকের পাত্তা কই? তার উত্তরে বলব, বাইরের লোকগুলোর শিক্ষিত হতে হলে তারা কারো না কারো শিষ্য হতে হবে। বিশ্বের সবাই কারো না কারো শিক্ষার্থী ছিল কেবল মুহাম্মদ( স) কারো ছাত্র ছিলেন না এক আল্লাহ ছাড়া।
তারপরেও যদি কেহ সন্তুষ্ট না হন তবে ভারতবর্ষের প্রতাপশালী বাদশাহ আলমগীরের মাষ্টারদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি শোনুন। “শিক্ষকের মর্যাদা’ শিরোনামের এই কবিতাটি এর রচয়িতা কবি কাজী কাদের নেওয়াজ । কবিতার বক্তব্য এরকম- দিল্লীর বাদশাহ আলমগীরের পুত্রকে পড়ানোর দায়িত্ব ছিল একজন মৌলভীর ওপরে। একদিন বাদশাহ দেখতে গেলেন ‘পুত্র কেমন শিক্ষা লাভ করছে?’ দেখলেন, বাদশাহ-পুত্র শিক্ষকের চরণে পানি ঢালছে ও শিক্ষক তার চরণ ধুয়ে মুছে সাফ করছেন নিজ হাতে। বাদশাহকে দেখে শিক্ষক ভাবলেন, দিল্লীপতির পুত্রের হাতে সেবা নিয়েছি – আজ আর তার নিস্তার নেই। কিন্তু বাদশাহ তাঁকে ডেকে শাস্তি দেয়া তো দূরের কথা মৌলভীর সাবকে অনেক বড় সম্মানে ভূষিত করেছেন। পক্ষান্তরে বাদশাহ-পুত্র শিক্ষাগুরুর চরণে পানি ঢেলেছে, কিন্তু নিজ হাতে চরণ ধুয়ে দেয়নি বলে বাদশাহ কষ্ট পেয়েছেন।
এই কবিতাটিতে কবি অতি সুন্দরভাবে শিক্ষকের মর্যদা ফুটিয়ে তুলেছেন।-‘
বাদশাহের ভয়ে যখন শিক্ষক প্রকম্পিত তখনই তিনি শিক্ষকের আত্মমর্যদা উপলব্ধি করেছিলেন এবং।এক পর্যায়ে তিনি উপলব্ধি করেন।
” শিক্ষক আমি শ্রেষ্ঠ সবার
দিল্লীরপতি সে তো কোন ছার!”
নির্ভিকভাবে বাদশাকে মোকাবিলা করার সংকল্প করেন
আমরাও যদি আদর্শ নিয়ে ও নির্ভিকভাবে নিষ্ঠার সহিত মানুষ গড়তে পারি তবে “ যে পায় না চাকরী সে করে মাষ্টারী “ এই অপবাদটি ঘুচিয়ে শিক্ষকদের মাথায়ই শ্রেষ্ঠত্বের তাজ শোভা পাবে।
-আল মামুন জাহানগীরি, শিক্ষাবিদ, বর্তমানে কানাডা প্রবাসী।
Leave a Reply