ফারহানা নীলা
মড়মড় শব্দে যখন রাতের শূন্যতা ভাঙে ঠিক তখনই ঝরাপাতার উপর হিসহিস আওয়াজ। তরল কিছু ঝরাপাতা ভিজিয়ে দিচ্ছে। বেশ গতিতে তরল পড়ছে। কুয়াশায় ভেজা পাতাগুলো তো ভিজেই ছিল।
হাতে আগুন আর ধোঁয়া। মানুষগুলো চেনা যায় না।
“সারাদিন ইঞ্জিন বোটের আওয়াজে কানে মনে হয় পোক পড়া”
“তয় যে তোর দাঁতে পোক”
“বিড়ির শেষটুকু ফেলে দিয়ে এদিক আয়। তোর ব্যারাম ধরিছে মুতানি ব্যারাম। যেহানে সেখানে যহন তহন ভিজায়ে দিস নাদানের মত”
একদল উঠতি তরম্নণ রাতটাকে পুঁজি করে ঘাটের আশপাশে ঘোরাঘুরি করে। দিনে কতকলোক ব্রিজ দেখতে আসে। ছবি তোলে। খায়দায় আর অযথা এদিক-ওদিক ঘোরাঘুরি করে। তাতে অবশ্য লাভ হয়। যত লোক আসে ততই লাভ। নৌকার ভাড়া বাড়ে। মহাজন বেশি নেয়। অল্প কিছু হেল্পার পায়। যারা নৌকায় সেতু দেখতে আসে লাইফ জ্যাকেট পরে শক্ত হয়ে খানিক বসে। তারপর শুরম্ন হয় ছবি তোলা। কতরকম মানুষ আসে!
পদ্মার সেই আগ্রাসী চেহারায় ঝিম ধরেছে। কুড়চে মুরগির মতো যেন খালি ঝিমানি আসে।
এই পদ্মা এখনো কখনো কখনো তেলেসমাতি দেখায় ঝড়ো আবহাওয়ায়। তখন অবশ্য নৌকা ঘাটে বাঁধা থাকে।
আলফাজ রোজ রাতে নৌকার কাজ শেষ করে যেটুকু টাকা কামায় সেটা নিয়ে অভিযানে বের হয়। সাথে বোরহান, লাল্টু।
নেশা তো এমনই। ঘাটের টং দোকান ঘরের আজিমের সাথে মাসকাবারি চুক্তি।
ইয়াবা আসে চোরাপথে।
“এত দাম বাড়লি পর খাবোনি ক্যাম্বা?”
“ঠ্যাক দে! বুঝলু” বোরহানের কথায় লাল্টু সায় দেয়। আলফাজ আবারও ছ্যারছ্যার করে পাতা ভেজায়।
“আইজ ঐ বুইড়ার রেডিও লেওয়াই লাগবি। ব্যাটা সারাদিন বোগলের মধ্যি থুয়ে দেয় রেডিও” আলফাজের কথায় রাগ হয় বোরহানের।
“ক্যা রেডিও ক্যা? এহন কি সেই যুগ? শালা মোবাইল দেখ”
ব্রীজ করার সময় জমি গ্রহনের কাল। বুইড়ার বাড়িটা পদ্মার পাড়ে।
একরাতে ফাটল দেখে বুইড়া চিৎকার করে ওঠে গেল! গেল সব গেল!
মাটিতে চিড় ধরলেই বোঝা যায় ভাঙনের গতি। বুইড়া রেডিওটা বোগলে নিয়ে দূর থেকে তাকিয়ে থাকে।
স্কুল ঘরটা পর্যন্ত মাটির চিড়।
মেয়েটাকে মামাবাড়ি পাঠিয়ে দেয় বুইড়া।
ঘনঘন ঢেউ আসে। ঘন রাতের বনে একটা দুইটা জোনাকির আলো। টর্চ হাতে গ্রামের লোকজন পাহারা দেয়।
“কহন ভাঙবিনি?”
“তোক বইলে কয়ে ভাঙবি না কি? শালার মাথা মোটা!”
ফিসফাস আওয়াজ আসে।
রাতের বেলা ভুস করে নদীতে দেবে গেল ভিটেমাটি। স্কুল ঘরেরও কোনো নিশানা নেই।
বুইড়া বোগলে রেডিও নিয়ে সেই যে গেল নিরম্নদ্দেশে বহুদিন পর ঘাটের কাছে তাকে দেখা গেল।
“ক্যা রেডিও লাগবি ক্যা?”
বোরহানের প্রশ্নে ভাবাতুর হয় আলফাজ।
এই রেডিওটা তার চাই।
পদ্মা ব্রিজ করার জন্য যখন কাজ শুরু হয় জমিটা থাকেনি। নদী শাসনের সময় জলও মনে হয় প্রতিবাদী হলো।
আলফাজ তখন স্কুলে পড়ে। পড়ার চাইতে আড্ডা জমে বেশি। বয়সটা কম বলে তেমন কিছু বোঝেনি। বাবার সাথে জমিতে কাজ করত ফাঁকে ফাঁকে। স্কুলে যাবার পথে এবাড়ি ওবাড়ি উঁকি দেয়। বরই গাছ ঝাঁকি,কদবেল লুকিয়ে পাড়ে, ডাব পাড়ে ঝুপ করে নদীতে ঝাঁপ দেয়। সাঁতারের প্রতিযোগিতা করে।
পাড়ার সবাই অতিষ্ঠ হয়ে যায় ওদের কর্মকা- দেখে।
সেই সময় একদিন আলফাজ জানতে পারে স্কুল ঘরটা নদী খেয়ে নিয়েছে বিকট একটা হা করে।
নদীর উপর রাগ হয়, ক্ষোভ হয়। উপচে ওঠে দুঃখ।
বুইড়া তখন এত বয়সী ছিল না। সুস্থ ছিল, সচল ছিল। আলফাজের বাবার একটা রেডিও ছিল। সেটা এই ভাঙনের সময় হারানো গেছে।
“পা চালায়ে চলেক তো”
বোরহান এবার তাড়া দেয়।
“বুইড়া ঘুমায়ে গেলি পর কাজ খেন করা লাগবি” আলফাজ উত্তর দিয়ে আঁধার কাটতে কাটতে এগোয়।
“বুইড়ার মেয়েডার খবর কিছু জানিস?”
“শুনিছি মামার বাড়িতে ম্যালা হেনস্তা হওয়ার পর দোজবরে বিয়ে হয়েছে। খুব অত্যাচার করে। এদিক আসপের দেয় না।”
বুইড়ার মেয়ের খবরে কী কাম? বুঝে পায় না আলফাজ। রেডিওটা পেলেই হলো।
কুপি বাতি জ্বলছে। বুইড়া রেডিও বোগলে নিয়ে কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে। আজ তার মন অশান্ত। সংসার একটা জঞ্জাল। এই জঞ্জালে নিজেও একটা আস্ত জঞ্জাল।
রাতের খাবারে পানি ঢেলে দিয়ে শুয়ে আছে বুইড়া। শালা ভাতের পর রাগ যদি করতি পাইরত? পেট না থাকলি পর খাওয়াও থাইকত না। মানুষের এত কামড়াকামড়ি সব থাইকত না। পেট একটা আস্ত হারামজাদা।
মেয়েটা এসেছে আজ হুট করে। এতগুলো বছর পর মেয়েকে দেখে বুইড়ার মনে ঝড় ওঠে। কিন্তু কথা হয় না সেই বেগে।
ধীরে জিজ্ঞেস করে “আসলু ক্যা”
মেয়েটার চেহারা আগের মতো নেই। মনে হয় কেউ পাটা ঘষে কালোজিরা ভর্তা মেখে দিয়েছে। বিষণ্ণ যাত্রাপথের এই জীবনকে এতদিন পর দেখে বুইড়া পদ্মার ভাঙনের শব্দ পায়।
“স্বামী মইরে গেল। ভাত কাপড়ের কষ্ট। ঐ বাড়িত আমার জায়গা হয় না বাপজান।”
মেয়েটা নখ খুঁটছে। নখগুলো টিয়াপাখির নখের মতো ধারাল ফলা যেন।
সেই থেকে বুইড়ার অস্থিরতা শুরু।
ভিটেমাটি নেই। পরের ঘরের এক কোণে থাকে। এই মেয়েকে কোথায় রাখবে এখন?
ছেলেটা যে বিবাগী হলো সেই সময় আর আসেনি। কোনো খোঁজখবর নেয় না, দেয়ও না।
শীত এলেই বুইড়ার হাঁপানি রোগটা বাড়ে। আজ দম পাচ্ছে না। সবকিছু কেমন জানি জলের অতল অন্ধকারের মতন!
বুইড়া উঠে বসে চৌকিতে। মেয়েটা নিচে বিছানা করে গুটিয়ে শুয়ে আছে।
বুইড়া বিছানা থেকে উঠতে চেষ্টা করে।
জানালার কাছে ফিসফিস আওয়াজ। কে? কে ওখানে?
থেমে গেল আওয়াজ।
মেয়েটাকে আদর করে একটা কথাও বলেনি। মেয়েটা যখন কাঁদছিল ডুকরে ডুকরে তখনো একবারও তাকে ছুঁয়ে দেখেনি। এই অপারগতার কথা কাউকে বলা যায় না।
নিজের নাই চালচুলো।
মেয়েটা হঠাৎ ব্যথায় গোঙাতে থাকে। বুইড়া বড় বড় চোখে তাকিয়ে আছে।
শ্বাসে দম নেই মনে হচ্ছে বুক-পিঠে মৃত্যু স্লোগান দিয়ে হাঁটছে।
মেয়েটার পেটে বাচ্চা ছিল? যখন আসল মেয়েটার দিকে ভালো করে তাকায়ওনি।
এখন তো প্রসব হবে। কী করে কী হবে?
বুইড়া কোনোমতে ঘরের বাইরে আসে। ঠান্ডায় হিম হয়ে যাচ্ছে সেÑ সম¯ত্ম শরীরটা একটা বরফের চাকা। কোনো বাতাস নেই, কোথাও শ্বাস নেই
আলফাজ, বোরহান আর লাল্টু সেই সুযোগে ঘরে ঢোকে।
রেডিওটা বিছানায়। খপ করে হাতে নেয় আলফাজ।
মাটিতে এক নবজাতকের কান্না শোনা গেল। দৌড়ে চলে গেল তারা ঘরের বাইরে। ঝোপের ভেতর বসে এবার ইয়াবার সাথে আলাপ শুরু।
“শালার বুইড়া রেডিও খুঁজবিনি কহন?”
এক তাল অন্ধকার ঢেকে নিল চরাচর। তারপরই আলো ফোটে। খোঁয়াড় থেকে মোরগের ডাক। হাঁসগুলো প্যাঁচপ্যাঁচ করতে করতে জলের দিকে যায়।
বুইড়ার ঘরের ভেতর থেকে রক্তের নদীটা বের হয়।
কতগুলো কাক হামলে পড়ে।
ঘরের বাইরে আর ঘরের ভেতরে শুনশান নীরবতা।
কেবল কা কা আওয়াজ।
তিনটা লাশের গন্ধ পেয়ে আরো কাক দাওয়াত পেয়ে আসে।
পুলিশের গাড়িটা ঘরের সামনে। পদ্মা ব্রীজ দিয়ে গাড়ি চলছে। সরগরম এপার-ওপার।
ইঞ্জিনের নৌকায় রেডিও বাজছে কিন্তু শব্দে কিছু শোনা যায় না। রেডিওটা বন্ধ করে দেয় আলফাজ।
কুঁইকুঁই শব্দে স্মৃতির কান্না বেজে চলে। বাবার মুখটা মনে পড়ে। একসময় বাবা আর বুইড়ার আদল মিলেমিশে এক হয়ে যায়!