সৌরভ হাওলাদার
পুজোর পর হাহাকারের গতিবেগ কিছুটা হলেও যেন কমেছে। মানুষ শ্বাস ফেলতে বাইরে এলো। এতোগুলো মাসের বন্দি দশায় হাতে পায়ে জং ধরে গিয়েছিল। ক্রমে দুহাজার কুড়ি সাল শেষ হয়ে আসে। নতুন বছরে পুরানো ক্যালেন্ডারের মতো সবাই অতিমারীর ভয় সরিয়ে রেখে রাস্তায় বেরিয়ে এসেছে। দল বেঁধে বেড়াতে যাচ্ছে। যেসব শ্রমিকরা গ্রামে ফিরে এসেছিল, তারা আবার ফিরে যাচ্ছে মুম্বাই, কেরালা, দিল্লি। নতুন বছর সব নতুন আশায় বুক বাঁধছে। হয়তো পুরানো তারিখের মতো রোগও তল্পিতল্পা গুটিয়ে উধাও হয়েছে। ভ্যাক্সিন নিয়ে দেশি বিদেশি অনেক রকম খবর শোনা যায়। মানুষ ভাবছে এবারে বুঝি একটা বাঁচার পথ পাওয়া গেলো।
গগনের কাজ এখনো আছে। কোম্পানি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে। তবে আগেকার মতো, আপিসের কাজে অন্য শহরে যাওয়া শুরম্ন হয়নি। দিলিস্নতে একটা নতুন প্রজেক্টের কথা হচ্ছে, কিন্তু কৃষক আন্দোলনের একটা ভয়ংকর রূপ দেখা দিচ্ছে। সরকার যেকোনো দিকে যাবে বোঝা যায় না। তাই মিটিং এর তারিখ নিয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
এদিকে বাংলায় নির্বাচনের ঢাক বেজে উঠেছে। হঠাৎ একদিন সুভদ্রা সকালে কাঁদতে কাঁদতে এসে উপস্থিত। পুজোর আগে থেকে গগনদের আবাসনে আবার বাইরে থেকে লোক আসার বিধিনিষেধ আলগা করেছে। সুভদ্রা আগের মতো ওদের ঘরে রান্না করতে আসে। ওর কান্না শুনে বেরিয়ে আসে গগন। সুভদ্রার স্বামী রঙ মিস্ত্রির কাজ করত। ভারা থেকে পড়ে মারা গিয়েছে। গগন অবাক হয়ে বলে, “কিন্তু তুমি তো বলেছিলে, তোমার স্বামীর সাথে তোমার কোনো সম্পর্ক নেই!” সুভদ্রা কান্না থামিয়ে বলে, “সে তো সম্পর্ক রাখতোই না। তা বলে, স্বামী স্ত্রী তো মিথ্যে হয়ে যাবে না।”
“কিন্তু, ওর এখনকার স্ত্রী?”
সুভদ্রা কান্না রেখে তেতে উঠল, “সে মুখপুড়ি কোন মুখে যাবে? সে কি ওর বিয়ে করা বৌ? হাসপাতাল থেকে আমাকেই ফোন করেছে।”
গগন বুঝতে পারে না, এক্ষেত্রে কী বলা উচিত। তিয়াসা এসে হাল ধরে,
“বেশ তুমি আজ যাও। আমি যা হোক রান্না করে নেবো।”
সুভদ্রা কান্না থামিয়ে চোখ মুছে বলে, “না না, এখন আমি কোথায় যাবো? বডি তো পোস্ট মর্টেম হবে। সেখানে আমায় ঢুকতেও দেবে না। তারপর ছবি পাঠাবে শনাক্ত করার জন্য। বডির আগে করোনা টেস্ট হবে। যদি করোনা বের হয়, তাহলে আমাকে বডি দেবেও না।”
কথাটা শুনে গগনের অস্বস্তি হয়। কোথাকার কোন মানুষ, যাকে কখনো দেখেওনি, তার জন্য একরাশ মায়া যেন গলার কাছটায় চলে আসে। লোকটা জানতেও পারলনা, ওর আদৌ কোভিড হয়েছে কিনা? শুধু লাশকাটা ঘরে অনেকগুলো কোভিড লাশের সাথে মিশে পড়ে থাকবে। মড়াদের মধ্যেও কি সংক্রমণ হতে পারে? প্রশাস্তকে জিজ্ঞেস করবে ভাবে।
বিল্টুবাবুর অবর্তমানে মুশারফ ভালোই হাল ধরেছে। আবার ধীরে ধীরে ব্যবসায় ফিরছে। পর পর বিয়ে বাড়িতে নতুন করে স্বমহিমায়, বিল্টুবাবুর ক্যাটারিংএর ব্যবসা আধিপত্য বিস্তার করে। শুধু ‘ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট’-এর কেতা দুরত্ব ব্যাপারটা কমে এসেছে।
কয়েকদিনের ধকলে গা ম্যাজ ম্যাজ করছে মুশারফের। ডাক্তার দেখাতে এসেছে। উপসর্গ শুনেই ডাক্তার কোভিড টেস্ট করতে দিল। নুরম্নলকে ঘর থেকে সরিয়ে প্রহ্লাদ নিজের কাছে নিয়ে আসে। নুরুল এখন বুঝে গেছে করোনা কোনো পুজো নয়, এটা একটা বিভীষিকা। ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে প্রহ্লাদকে বলল, “বা-জান, কী আর ফিরা আসবো?” প্রহ্লাদ ছেলেটিকে স্তোক দেয়, “লোকজনের অসুখ করে না?”
“কিন্তু এই অসুখে তো কেউ ফেরে না। এই বাড়ির বড়বাবু যেমন চইলে গেলো।”
“তোর আলস্নারে ডাক! তিনিই রাখবেন।”
প্রহ্লাদের আশঙ্কা সত্যি হলো। ঠিক যখন সবার মনে একটা ধারণা হয়েছে, করোনার ব্যাধি প্রশমন হয়েছে, তখন মুশারফের রিপোর্ট পজিটিভ এলো। কয়েকেদিনের মধ্যে শ্বাস কষ্ট শুরম্ন হল। বিল্টুবাবুর স্ত্রী, মুশারফের কাছ থেকে ওর চাচাতো ভাই মইদুলের নম্বর নিয়ে ফোন করে। খবর শুনে মইদুল সাথে সাথে সোমনাথের সাথে যোগাযোগ করে ওদের হাসপাতালে ভর্তির ব্যবস্থা করে দেয়। বিল্টুবাবুর স্ত্রী, মনিদীপা টাকা পয়সার ব্যবস্থা করে। মইদুল এসে নরম্নলকে নিয়ে আমনদীঘি ফিরে যায়।
সুভদ্রা চলে যাওয়ার পর গগন ব্যালকনিতে চুপ করে বসেছিল। কীসের জন্য? এটা কি সুভদ্রার ভালোবাসা নাকি সংস্কার? পুরম্নষ মানুষ যখন খুশি তার বিয়ে করা বৌকে ত্যাগ করে, অন্য স্ত্রীর সাথে থাকতে পারে? অথচ সুভদ্রা সেই অশরীরী স্বামীর কল্যাণে সিঁদুর পরে থাকলো, আবার তার মৃত্যুর পর শেষ কাজটাও সে করছে। এখানে কি সমাজ না মানুষ, কে বড়? একজন সামান্য রান্নামাসির যা উপলব্ধি, সেটুকুও কি গগনের বা তিয়াসার নেই? গগন এতদিনে জেনে গিয়েছে, তিয়াসার মনের নিজস্ব অংশে আরো একজন বাস করে, যার সাথে তিয়াসা গল্প করে, পুজোর সময় বেড়াতেও যায়। লকডাউনে ঘরে না থাকলে হয়তো, সারা জীবনে এই হদিশ পেতো না। আর গগনও কি তিয়াসার বিরহকে সম্বল করে বসে রইল? ধৃতির সাথে অষ্টমীর রাতের সেই ভেসে যাওয়া কি স্খলন নয়?
রাত অনেক হয়েছে। তিয়াসা খেতে ডাকে। খাওয়ার পর শুতে গিয়েও ঘুম যেন আসতেই চাইছে না। ঘুরে ঘুরে সুভদ্রা, ওর না দেখা স্বামী, তিয়াসা, তিয়াসার না-দেখা বন্ধু, এমনকি ধৃতির মুখ ঘুরে ঘুরে আসে। এদের মাঝখানে গগন কোথায়? গগন জানে না। গগন যেন একটা অচেনা জায়গাতে চলে এসেছে। এলোমেলো গাছপালা। তার ভেতরে আগুন জ্বলছে। কেউ যেন চীৎকার করে উঠল,
“কী পুড়ছে? ওটা কী পুড়ছে?”
একজন উর্দিধারী লোক বেরিয়ে এসে বলল,
“আমার ওপর মহলে, জিজ্ঞেস করলেন।” প্রশ্নকর্তা বারবার একই প্রশ্নে আর্তনাদ করে চলেছে, আর তার উত্তরে পুলিশটি একঘেয়ে গলায় বলে চলেছে, “আমার ওপর মহলে, জিজ্ঞেস করম্নন।”