বিনোদন পত্রিকার ধরন সম্পর্কে বলতে গিয়ে বিশিষ্ট সাহিত্য সমালোচক, লেখক ও শিক্ষাবিদ আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেন, ইংরেজি “performing art” বা “পরিবেশন শিল্প” যেমন চলচ্চিত্র, নাটক, গান, নৃত্য প্রভৃতি বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে যে পত্রিকাসমূহ প্রকাশিত হয় সেসব পত্রিকাগুলোকে আমরা বিনোদনধর্মী পত্রিকা বলতে পারি।
এ দেশের শিল্প, সাহিত্য-সংস্কৃতির উন্মেষ ঘটে মূলত ৪৭’র দেশ ভাগের পর। এই প্রথম এ অঞ্চলের অধিবাসীদের সামনে তাদের চিন্তা-চেতনা, আবেগ-অনুভূতি প্রকাশের ভিন্ন মাত্রিক সুযোগ সৃষ্টি হয়। এ ধারায় সংস্কৃতি নানা রূপান্তরের মধ্যে পথচলার সূচনা করে। সকলের মাঝে নতুন সৃষ্টির তাগিদ অনুভব হয়। শিল্পের বিভিন্ন শাখা নিজেদেরকে মেলে ধরতে প্রয়াসী হয়। এরই ধারাবাহিক পরিক্রমায় এক সময় বিনোদনধর্মী সংবাদ নিয়ে সাময়িকী প্রকাশের সূচনা হয়।
তারও আগে নদী-বিধৌত এ পলল ভূমির অধিবাসীদের বোধ-উপলদ্ধি, আত্মশক্তি ও আত্ম-আবিস্কারের নতুন মাত্রার সূচনা হয় ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। দরিদ্র ও কৃষিজীবী সম্প্রদায়ের সন্তানরা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশাল পাদপীঠে এসে নতুন আঙ্গিকে, নতুন উদ্দীপনায়, নতুন জাগরণের পাঠ পায়। একদিকে তারা যেমন স্বাধিকার ও স্বাতন্ত্র্যবোধে উজ্জীবিত হয়, অন্যদিকে তাদের চেতনার গভীর থেকে গভীরে জীর্ন পলেস্তরা খসে পড়া দেয়াল ভেঙে মানব মুক্তির চেতনা উজ্জীবিত, উদ্ভাসিত ও উদ্দীপ্ত হবার তাগিদ অনুভূতি হয়। যেটি সে সময়ের তরুণদের মন ও মানস জুড়ে গভীর রেখাপাত করে। মূলত এর মধ্যদিয়েই এ অঞ্চলের মাটি ও মানুষ ও মেঠো জীবন ঘিরে শিল্প-সংস্কৃতির নতুন পথযাত্রার সূচনা হয়। এবং এটি পরবর্তীতে কলকাতাকেন্দ্রিক সাংস্কৃতিক পটভূমির বাইরে ঢাকা কেন্দ্রিক ভিন্ন রঙ- ও রেখায় ভিন্ন একটি সাংস্কৃতিক প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে। মূলত সংস্কৃতির রঙিন রূপই ধীরে ধীরে রাজনৈতিক চেতনার রঙ ধারণ করে। এবং এ জাতির স্বাধিকার ও স্বাধীনতার পথ ও পাথেয় তৈরি করে।
৫০-র’দশকে বিনোদন সাংবাদিকতার শেকড় গেড়েছিলেন প্রয়াত সাংবাদিক বরেণ্য চিত্র পরিচালক ফজলুল হক। ১৯৫০ সালে বগুড়া থেকে তিনি চলচ্চিত্র বিষয়ক পত্রিকা প্রকাশনার দুঃসাহসিক যাত্রা শুরু করেন। ইস্ট-বেঙ্গল স্কাউট পত্রিকার (২য় বর্ষ, ৪র্থ সংখ্যা, এপ্রিল ১৯৫১) তথ্য থেকে জানা যায়, দেশের প্রথম বিনোদনধর্মী পত্রিকার নাম “সিনেমা”। এ নামে দু’টি পত্রিকা প্রকাশিত হতো। একটি বাংলা ও অপরটি ইংরেজি সংস্করণ। ইংরেজি পত্রিকাটির বার্ষিক চাঁদার হার ছিল ৬ টাকা, প্রতি সংখ্যার মূল্য ছিল ৮ আনা। বাংলা পত্রিকাটির বার্ষিক চাঁদার হার ছিল ৭ টাকা, প্রতি সংখ্যার মূল্য ছিল ১০ আনা।
এ দেশের বিনোদনধর্মী সাংবাদিকতার প্রাণপুরুষ এবং মৃত্যুর দিন পর্যন্ত প্রধান পুরুষ ছিলেন দেশের অন্যতম প্রথম চলচ্চিত্র প্রযোজক, পরিচালক সৈয়দ মোহাম্মদ পারভেজ। “সাপ্তাহিক চিত্রালী” প্রকাশের মাধ্যমে তিনি এ ধারার সূচনা করেন। চিত্রালী’র আঙ্গিক ছিল দৈনিক কাগজের আয়তনের। ঝকঝকে ছাপা, আকর্ষণীয় ছবি, বুদ্ধিদীপ্ত ক্যাপশন ও বিনোদনের সংবাদ পাঠে নতুনত্ব ও অভিনবত্ব আনার পাশাপাশি পরিচ্ছন্ন সংস্কৃতির লালনের দরুন “সাপ্তাহিক চিত্রালী” দ্রুত পাঠক মহলে সমাদৃত হয়। মোহাম্মদ পারভেজ মেধা আর অনুসন্ধিৎসার সমন্বয়ে চিত্রালী’কে একটি মানসম্পন্ন পত্রিকায় পরিণত করেন। চিত্রালী প্রথম বর্ষ, প্রথম সংখ্যার প্রকাশ ০১ জানুয়ারি ১৯৫৩। সৈয়দ মোহাম্মদ পারভেজ সম্পাদিত চিত্রালী এ. বি. এম. রুহুল আমিন কর্তৃক বেঙ্গল প্রিন্টিং ওয়ার্কস, ৩/৪ পাটুয়াটুলী লেন থেকে মুদ্রিত এবং কাওসার হাউস, সিদ্দিক বাজার, ঢাকা থেকে প্রকাশিত হতো। শুরুতে এর পৃষ্ঠা সংখ্যা ছিল ১০ এবং দাম ছিল দুই আনা। ছবি নির্মাণ ও পারিপার্শ্বিক কারণে তিনি অর্থকষ্টে পড়েন কিন্তু এরপরও চিত্রালী প্রকাশের জন্য তাঁর আন্তরিক প্রয়াসের এতটুকু ঘাটতি ছিল না। এর সামান্য বিবরণ পাওয়া যায় সচিত্র সন্ধানী সম্পাদক গাজী শাহাবুদ্দিন আহমদের “সবটুকু উজাড় করে” লেখায়। সৈয়দ মোহাম্মদ পারভেজ সম্পর্কে অনেক কথার মাঝে বলা হয়েছে, “ঘাড়টাকে কিঞ্চিৎ কাত করে সমস্ত শরীরটাকে ঝাঁকিয়ে-ঝাঁকিয়ে এগিয়ে আসছে। আসছে- আসছে। কাছাকাছি হয়ে তার দৃষ্টির রেঞ্জের মধ্যে আমাকে পেয়ে একটা হাসি। এ হাসির সঙ্গে তখন তেমন অভ্যস্ত ছিলাম না। অর্থ বুঝি না। ডায়ালগের প্রয়োজন ছিল”।
‘তোমার সচিত্র সন্ধানী থেকে দু’তিন রিম কাগজ দিতে পারবে? না হলে এ সপ্তাহের চিত্রালী বের করতে পারব না’। মনে-মনে একবার হয়তো ভেবেছিলাম চিত্রালী এখন বের না হলে তো ভালই, সন্ধানী ভাল চলবে। তখন তাঁকে হয়তো আমার প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবতে চেয়েছিলাম। পরিচয় এত বেশি ছিল না।
পরবর্তীতে আর্থিক অনটনের দরুন তিনি চিত্রালী বিক্রি করে দেন অবজারভার গ্রুপের কাছে। ১৯৫৯ সালের ০১ জানুয়ারি চিত্রালী নতুন মালিকানায় প্রকাশিত হয়। অবশ্য সম্পাদক ছিলেন সৈয়দ মোহাম্মদ পারভেজ-ই। আল- হেলাল প্রিন্টিং অ্যান্ড পাবলিশিং কোম্পানির পক্ষ থেকে প্রকাশিত হতো পাকিস্তান অবজারভার (স্বাধীনতার পর এটির নাম ধারণ করে বাংলাদেশ অবজারভার), দৈনিক পূর্বদেশ এবং সাপ্তাহিক চিত্রালী। এর স্বত্বাধিকারী ছিলেন হামিদুল হক চৌধুরী। চিত্রালী’কে নবরূপ দেয়ার প্রচেষ্টায় সৈয়দ পারভেজ অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। নানা নতুন ফিচার, ছবি, ইলাস্ট্রেশন, টাইপোগ্রাফির নতুন মুখ, এমনকি কার্টুন পর্যন্ত ব্যবহৃত হয়েছে। সব্যসাচী লেখক
সৈয়দ শামসুল হক, কাইয়ুম চৌধুরী, রশীদ হায়দার, মাহফুজ সিদ্দিকী, কবি ফজল সাহাবুদ্দিন, আলোকচিত্রী লাল ভাই সহ দেশের খ্যাতনামা অনেক লেখক চিত্রালী’তে কাজ করেছেন। সকলের সম্মিলিত উদ্যমে চিত্রালী’র নতুন চেহারা পাঠকদের মাঝে অভূতপূর্ব আলোড়ন তুলল। চিত্রালী’র উত্তরদা ছিলেন এ.টি.এম. হাই। পরে তিনি হয়েছেন সচিত্র সন্ধানী’র টেলিভিশন বিভাগের লেখক ক্র্যামোট এ্যালি। শেষ জীবনে তিনি ছিলেন দৈনিক প্রথম আলো’র সহ-সম্পাদক। ২০০১-’র ০৯ সেপ্টেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্র সাংবাদিকতা ও চলচ্চিত্রশিল্পের মহিরূহব্যক্তিত্ব সৈয়দ মোহাম্মদ পারভেজ ১৯৭৯ সালের ২ এপ্রিল, লন্ডনে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল মাত্র ৪৫ বছর। তাঁকে যথাযোগ্য মর্যাদায়, ঢাকার বনানী কবরস্থানে দাফন করা হয়। যখন এ দেশে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়নি। চলচ্চিত্র নির্মাণের কথা হয়তো কেউ স্বপ্নেও ভাবেননি । সেই সময়ে এ দেশে নিয়মিত সিনেমা বিষয়ক সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশের দুঃসাহসী কাজটি করেছেন তিনি। শুধু ‘চিত্রালী’র সম্পাদক-প্রকাশকই ছিলেন না, তিনি চলচ্চিত্র প্রযোজনা ও পরিচালনাও করেছেন।
সৈয়দ মোহাম্মদ পারভেজের মৃত্যুর পর চিত্রালী’র সম্পাদনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন আহমেদ জামান চৌধুরী। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার পেশা ছেড়ে দিয়ে তিনি পত্রিকা সম্পাদনার জগতে আসেন। তিনি তাঁর মেধা, ধীশক্তি পত্রিকার জন্য বিনিয়োগ চিত্রালী’র প্রকাশনা করেন। যার দরুণ চিত্রালী’র পাঠকপ্রিয়তা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে। ষাট-সত্তর ও আশির দশকে চিত্রালী’র সার্কুলেশন ছিল অবিশ্বাস্য । এ সময় এক লাখ ২০ হাজার চিত্রালী ছেপে পাঠকদের চাহিদা মেটাতে হতো । প্রেসে অনবরত তিন দিন চিত্রালী’র ছাপার কাজ চলত । ঈদ উপলক্ষে চিত্রালী’র বিশেষ সংখ্যা বের হতো ম্যাগাজিন সাইজে। দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্প- সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কবি-সাহিত্যিকদের লেখা এতে স্থান পেতো। এক সময় চিত্রালী’র উর্দু সংস্করণও বের হতো । কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য এ বিপুল পাঠকপ্রিয় পত্রিকা আজ কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে। সেই সোনালী দিন আজ বন্দী স্মৃতির পাতায়। চিত্রালী’তে কর্মরত এস. এম. সোলায়মান ও সৈয়দ এনায়েত জানান, দীর্ঘ ১৫ বছর যাবৎ মালিকানা নিয়ে দ্বন্দ্ব-সংঘাতে লিপ্ত ছিলো ঢাকা’র সংবাদপত্র শিল্প জগতের এক সময়ের “গোল্ড মাইন” বলে খ্যাত অবজারভার গ্রুপে। চিত্রালী’র কর্মীরা বেতন বঞ্চিত ছিলেন প্রায় ৫০ মাস ধরে। সংক্ষুব্ধ এক জন জানালেন, “কবে যে শেষ বেতন তুলেছি তা একেবারেই ভুলে গেছি”। দারুণ অর্থকষ্টে চলেছে চিত্রালী’র শেষ সময়ের প্রকাশনা।
১৯৫৬ সালের ২৩ জুন বাংলা ০৯ আষাঢ় শনিবার “সচিত্র সন্ধানী”র প্রথম প্রকাশ । এটি ইংরেজি মাসের ৭ এবং ২৩ তারিখে প্রকাশিত হতো। পত্রিকাটি ছাপা হতো ইম্পেরিয়াল প্রেস, ১০ হাটখোলা রোড থেকে, এর সম্পাদকীয় দপ্তর ছিল ৪১, নয়াপল্টন। ৩২ পৃষ্ঠা পত্রিকার তা দাম ছিল ৪ আনা। এর প্রথম প্রকাশক ছিলেন – নুরুল হক এবং প্রথম সম্পাদক ও সহকারী সম্পাদক ছিলেন যথাক্রমে হুমায়ুন খান ও সরফুদ্দীন আহমেদ। সচিত্র সন্ধানী’র প্রকাশনা এ সম্পর্কে গাজী সাহাবুদ্দিন জানান, “আমরা উনিশ-কুড়ি বয়সের কয়েকজন স্কুল-কলেজের ছাত্র নিজ-নিজ তারুণ্যে সংস্কৃতি সেবায় জড়ো হই। তখন দেশে সাময়িক পত্রিকার সংখ্যা ছিল কম।
আমরা চেয়েছিলাম সেই পত্রিকা যা লেখা ও রেখায় পাঠককে নির্মল আনন্দ দেবে একই সঙ্গে মনের অনুজ্জ্বলতা দূর করবে। কিন্তু কলেজের মাঠে ও রেস্তোরাঁয় বসে পত্রিকা বের করার চিন্তা করা যত সহজ, আর্থিক নিশ্চয়তা ছাড়া পত্রিকা প্রকাশ তত সহজ না। নিজের পকেট খরচের টাকা, কিছু সংখ্যক ভদ্রজনের চাঁদা এবং পত্রিকা প্রকাশের সাহায্যার্থে চলচ্চিত্র প্রদর্শনী করে পত্রিকার নামকরণ করা হলো ‘সচিত্র সন্ধানী’। কলকাতা থেকে বিখ্যাত কার্টুনিস্ট প্রমথ সমান্দার এবং এ দেশের কার্টুনিস্টরা নিয়মিত কার্টুন সরবরাহ করেন। আজকের জনপ্রিয় কার্টুনিস্ট রনবী তাঁর প্রতিষ্ঠার শুরুর দিকে সচিত্র সন্ধানী’র জন্য কার্টুন এঁকেছেন। সম্পাদকীয় বিভাগের সদস্যরা বিভিন্ন ফিচার লিখতেন। চলচ্চিত্র শিল্পের তখন মাত্র বিকাশকাল। সংবাদ, সমালোচনা এবং ছবি ছাপিয়ে এই চিত্তাকর্ষক মাধ্যমকে জনপ্রিয় করার চেষ্টা করি। ক্রমশ শিল্প- সাহিত্য-সংস্কৃতি সহ সন্ধানী’র পরিধি বৃদ্ধি পায়। ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ছিল সন্ধানী’র প্রথম পর্ব। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর নতুন দেশ পাওয়ার আনন্দে নবপর্যায়ে সচিত্র সন্ধানী শিল্প-সংস্কৃতির পত্রিকা হিসেবে প্রকাশিত হয়। দেশের সব উল্লেখযোগ্য কবি-সাহিত্যিক-লেখক- শিল্পী তাঁদের পত্রিকা মনে করে নিয়মিত লেখালেখি করেন। তখনও দেশের শিল্প- সাহিত্যের একমাত্র পত্রিকা ছিল সাপ্তাহিক সন্ধানী। সত্তর-আশি-নব্বই দশক পর্যন্ত দেশের প্রতিষ্ঠিত ও নবীন লেখক, চিত্রশিল্পী-চলচ্চিত্র- সংগীত-খেলাধুলার প্রতিশ্রুতিশীল শিল্পী ও খেলোয়াড়রা সচিত্র সন্ধানী’র পৃষ্ঠায় উপস্থিত। কিন্তু দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা, সামাজিক অস্থিতিশীলতা, টেলিভিশন চলচ্চিত্র এবং নিচুমানের পত্রিকার প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে মানুষের রুচি। ক্ষয় হতে থাকে মানুষের অধ্যবসায় মানুষের অগ্রসর চিন্তা-চেতনার অভাবে নষ্ট হয়ে যায় সংস্কৃতির বিকাশ। নব্বই দশকের মাঝামাঝি সময়ে সচিত্র সন্ধানী’র নিয়মিত প্রকাশ ব্যাহত হয়। সচিত্র সন্ধানী সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে প্রয়াত অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন, “সচিত্র সন্ধানী যখন প্রথম প্রকাশিত হয় তখন পত্রিকাটি কেমন হবে, তা বোঝা যায় নি। শেষ পর্যন্ত পাঠকরা ঠিকই জেনে গিয়েছিলেন যে, সচিত্র সন্ধানী’র অনিষ্ট আমাদের সংস্কৃতির ঠিকানা। হালকা লেখা ও কার্টুন এতে মুদ্রিত হচ্ছে। থাকছে চলচ্চিত্র জগতের বিভিন্ন কথা। তারই পাশে প্রকাশিত হচ্ছে সমকালীন শ্রেষ্ঠ তরুণ লেখকদের কবিতা-গল্প-উপন্যাস- আলোচনা-প্রবন্ধ, ছাপা হচ্ছে উদীয়মান চিত্রকরদের আঁকা ছবি কিংবা তাঁদের কাজের পর্যালোচনা। আজকের সুপ্রতিষ্ঠিত অনেক শিল্পীর আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল সন্ধানীকে ঘিরে এ কথা ভোলার নয়”
নবপর্যায়ে সন্ধানী’র প্রকাশ সাময়িকপত্রের জগতে একটি মাইলফলক। কাইয়ুম চৌধুরী এ ব্যাপারে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, “প্রযুক্তির সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও প্রকাশনাকে নয়ন শোভন করতে আমাদের চেষ্টা ছিল সবারই”। বার্নাডশ’র একটি কথা আমাকে খুব আলোড়িত করেছিল। বইয়ের পৃষ্ঠা হবে ছবির মতো। স্পেস অনুযায়ী পাঠ্য বিষয়কে সাজানো, টাইফোগ্রাফির নবতর বিন্যাস, ফটোগ্রাফির আকর্ষণীয় দিকটিকে গুরুত্ব দিয়ে ছাপা। ইলাস্ট্রেশন নতুন পদ্ধতির প্রয়োগে ভিন্নতর চেহারা দেয়া, বাংলা হরফের নতুন নকশা এ সবই আমাদের পরিকল্পনার মধ্যে ছিল, ছিল পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার অপরিসীম সুযোগ। অবশ্যই আমরা আমাদের চেষ্টাকে সে সময়ে প্রকাশিত সাময়িক পত্রের মধ্যে একটা ভিন্ন চেহারা দিতে সমর্থ হয়েছি। আজকে যখন পুরনো সংখ্যাগুলো উল্টে-পাল্টে দেখি আবার বিস্ময়ে ভাবি এত সীমাবদ্ধতার মধ্যে কি করে এটা সম্ভব হয়েছিল। সে সময়ে ছাপার জন্য উন্নতমানের নিউজপ্রিন্ট পাওয়া যেত না, পাওয়া যেত না ছাপার জন্য উন্নত মানের কালি। টাইপের সীমাবদ্ধতা অপরিসীম। হাতে কম্পোজ করা থেকে মনোটাইপ, লাইনোটাইপে উন্নীত করেও হেডিং টাইপের স্বল্পতার কারণে পৃষ্ঠাবিন্যাসে যথেষ্ট বেগ পেতে হতো। হেডিং টাইপের নতুন নকশা সন্ধানী’কে একটা কমনীয় চেহারা দিতে যথেষ্ট সাহায্য করেছিল। সঙ্গে ছিল উদ্ভাবন ক্ষমতার অধিকারী কালাম মাহমুদ, মুনীর খান যাঁদের সহযোগিতা সন্ধানী’কে সেরা সাপ্তাহিকে পরিণত করেছিল। দৃষ্টিনন্দন আলোকচিত্র বাছাইয়ে আমাদের পরিশ্রম নতুন আলোকচিত্রীকে পাদপ্রদীপের আলোয় নিয়ে আসতে পেরেছিল।
স্বাধীন বাংলাদেশে মুক্তিচিন্তার প্রতিধ্বনি করে স্বাতন্ত্র্য ও আপন মহিমায় ভাস্বর হয়ে নাট্যচর্চায় জোয়ার আসে। নিজস্ব ও অনুবাদ নাটকের প্রাচুর্যে সমৃদ্ধ হয় মঞ্চের যৌগিক শিল্পকর্ম। শক্তিমান ও প্রতিশ্রুতিশীল অভিনেতা ও অভিনেত্রীর অভিনয়ের বিশ্লেষণ সন্ধানী’র পৃষ্ঠায় উজ্জ্বল হয়ে আছে। সব্যসাচী সৈয়দ শামসুল হকের “পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়” “নুরুলদীনের সারা জীবন” সহ দেশ সেরা নাটকগুলো হয়েছে সন্ধানী’র প্রচ্ছদ প্রতিবেদন।
এই দেশে প্রকৃত সংগীত জানাশোনা ও গাওয়ার মতো মানুষের সংখ্যা হাতেগোনা। এঁরাই লঘু জনপ্রিয় গানের নামে শোরগোলের বিপরীতে বাঁচিয়ে রেখেছে প্রকৃত সুরধ্বনি। সম্মানিত এই সঙ্গীত শিল্পীদের সহযোগিতা পেয়ে সচিত্র সন্ধানী সংগীত বিভাগকে ঋদ্ধ করতে পেরেছে আবার সম্ভাবনাময়ী শিল্পীদেরও তরুণ- তরুণী বিভাগে তুলে ধরা হয়েছে যারা এ দেশের নামী দামী শিল্পী হিসেবে নিজকে আজ প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন।
দেশভাগের পর চলচ্চিত্রের শিশুকাল থেকে ক্রমশ বিকাশ পর্বে সচিত্র সন্ধানী এই মাধ্যমকে সবচেয়ে বেশি জায়গা দিয়েছে। স্বাধীনতার পর চলচ্চিত্রে শুরু হয় ক্ষয়। এই দুর্বলতা চিহ্নিত করেছে সচিত্র সন্ধানী। আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্রের শিল্প সাফল্যের দৃষ্টান্তও তুলে ধরা হয় সন্ধানীর পাতায়।
সমাজের বিবিধ শিল্পের বিকাশ ও প্রকাশ করে। সচিত্র সন্ধানী আগুয়ান, রুচিবান পাঠকের চিন্তা-চেতনায় যোগ করেছে বহু স্তরের শিল্প- সংস্কৃতি নির্ভর কথকতা।
সন্ধানী অনুসন্ধান করে তুলে ধরেছে ৫৬ হাজার বর্গমাইলে ছড়িয়ে থাকা আমাদের সমৃদ্ধ শিল্প সংস্কৃতির সমৃদ্ধ জগতকে। ঐতিহ্যকে তুলে ধরেছে তরুণদেরে সামনে। আধুনিকতার উদগীরণে আমন্ত্রণ জানিয়েছে আবার তরুণদের স্বকীয় সত্ত্বাকে জাগিয়ে তুলেছে; যা শিল্প-সাহিত্যে, সংগীতে-চলচ্চিত্রে পরিস্ফুটিত হয়েছে। আমাদের ভাষা-সংস্কৃতি সমৃদ্ধ হয়েছে। সন্ধানী আমাদের চিন্তার জগতে একটি বাঁকবদল করে দিয়েছে। এখানেই সন্ধানীর অনন্যতা।
৪৭’র দেশ ভাগের পর প্রায় সমসাময়িককালে প্রকাশিত হয় সাপ্তাহিক চিত্রালী ও সাপ্তাহিক সচিত্র সন্ধানী। দেশ ভাগের আগে বাংলা সাহিত্য আর সাময়িকীর চর্চা হতো কলকাতা কেন্দ্রিক। ভাগ-পরবর্তী ঢাকা কেন্দ্রিক নতুন বাংলা ভাষা ও সাহিত্য চর্চার নতুন ধারার সূচনা হয়। কবি-সাহিত্যিক, গাল্পিক, সমালোচক, অভিনেতা-অভিনেত্রী, সংগীত শিল্পী সৃষ্টির যুগান্তকারী ভূমিকা ছাড়াও কলকাতা কেন্দ্রিক বাংলা থেকে এ অঞ্চলের বাংলার স্বকীয় বৈশিষ্ট্য সৃষ্টিতে এ দু’টি পত্রিকা অনন্য সাধারণ ভূমিকা পালন করে। এবং এসব দুটি সাময়িকী কেন্দ্র করে প্রিন্টিং প্রকাশনা শিল্প ও এর কারিগর গড়ে ওঠে। ঢাকায় 47’পরবর্তী মেকআপম্যান, প্রুফ রিডার, ইলাস্ট্রেটর, কার্টুনিস্ট, চিত্রশিল্পী ছিলো না। প্রকাশনার প্রয়োজনে এসব কারিগর তৈরি হয়। পরবর্তীতে এরাই দক্ষ উত্তরসূরী তৈরি করে ।
সন্ধানী’র পর বিনোদনধর্মী পত্রিকা হিসেবে বাজারে আসে সচিত্র মাসিক “মৃদঙ্গ”। ১৯৫৯ সালের আগস্টে এর প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয়। সম্পাদনার দায়িত্বে ছিলেন এম. মুস্তাফা। পত্রিকাটি মৃদঙ্গ প্রকাশনী, কায়সার মঞ্জিল, ৪৪, লালবাগ রোড, ঢাকা থেকে প্রকাশিত হতো। ১০০ পৃষ্ঠার এ পত্রিকার বিনিময় ছিল ১২ আনা । সম্পাদকীয় দপ্তর ছিল ২৭/১২, তোপখানা রোড, রমনা, ঢাকা-২। এতে লিখতেন বিষ্ণু দে, সন্তোষ গঙ্গোপাধ্যায়, জহির রায়হান, টিপু সুলতান, হাসান হাফিজুর রহমান, হুমায়ুন কাদির, ফজল শাহাবুদ্দিন, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, আবু জহির এনায়েত উল্লাহ, সাঈদা খানম, আলবার্টো মোরাভিয়া, লিন য়ু তাঙ।
সমসাময়িককালে “রঙ-বেরঙ” নামের আরেকটি সিনে ম্যাগাজিন প্রকাশিত হয়। ১৯৫৯ সালের অক্টোবরে এর প্রথম সংখ্যা পাঠকের কাছে আসে। সম্পাদকের নাম আবদুল মবিন, সহ-সম্পাদক কেরামত মাওলা ও আনোয়ারুল হক হয়ে রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ কর্তৃক নিউ নেশান প্রিন্টিং প্রেস, ১ রামকৃষ্ণ মিশন রোড থেকে মুদ্রিত হয়ে ৬ নবাবপুর রোড, ঢাকা-১ থেকে প্রকাশিত হতো। প্রথম বর্ষ শেষ সংখ্যা প্রকাশিত হয় সেপ্টেম্বর ১৯৬০ সালে । এরপর আরেকটি মাসিক সিনে সংস্কৃতি পত্রিকা বাজারে আসে যার নাম “চলন্তিকা”। প্রথম সংখ্যার আত্মপ্রকাশ করে নভেম্বর ১৯৬০ সালে। চলন্তিকা’র সম্পাদনার দায়িত্বে ছিলেন ডা. সাদাত আলী শিকদার। এ পত্রিকার ৩য় বর্ষ ৬ষ্ঠ সংখ্যার প্রকাশ এপ্রিল ১৯৬২। ৬৮ পৃষ্ঠার এ সংখ্যার দাম রাখা হয় ৫০ পয়সা। ৫ম বর্ষ চতুর্থ সংখ্যার প্রকাশ হয় ১৯৬৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। ১০৮ পৃষ্ঠার দাম ছিল ১ টাকা। এটি লিয়াকত এভিনিউ থেকে মুদ্রিত হয়ে সম্পাদক কর্তৃক প্রকাশিত হতো। একই সময়ে আরেকটি সচিত্র বিনোদন মাসিক পত্রিকা প্রকাশিত হয় “সিনেমা জগত” শিরোনামে। পত্রিকাটির ১ম বর্ষ ৪র্থ-৫ম (যুগ্ম) সংখ্যা প্রকাশিত হয় ১৯৬১ সালে। সংখ্যাটি ঈদ সংখ্যা হিসেবে প্রকাশিত হয়। ১ম বর্ষ, ১ম সংখ্যার প্রকাশ সম্ভবত ১৯৬০ সালের নভেম্বরে। সম্পাদক ছিলেন মোহাম্মদ উল্লাহ, সহ-সম্পাদক এইচ. এন. লালা। নিউনেশন প্রিন্টিং প্রেস, ১ রামকৃষ্ণ মিশন রোড থেকে মুদ্রিত হয়ে সম্পাদক কর্তৃক ৫১/১ লিয়াকত এভিনিউ থেকে প্রকাশিত হতো । ৮০ পৃষ্ঠার এ পত্রিকার দাম রাখা হতো ২৫ পয়সা। প্রায় দুই বছর পর “সন্দেশ” নাম নিয়ে আরেকটি সিনেমা মাসিক জন্ম নেয় ১৯৬৩ সালের আগস্ট মাসে। পত্রিকার ১ম বর্ষ, ৮ম সংখ্যায় এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয় : আগামী পয়লা এপ্রিল থেকে সন্দেশ সাপ্তাহিক রূপে বেরোবে। প্রতি সংখ্যায় দু’টো গল্প, একটি ধারাবাহিক কাহিনী, একটি সংবাদ কটাক্ষ ও প্রচুর ছবি থাকবে। স্টুডিও রিপোর্ট এবং চিঠিপত্র বিভাগ পরপর সংখ্যায় থাকবে। মহিলা বিভাগ এবং সংগীত বিভাগ সহসাই আরম্ভ হবে। প্রতি কপির দাম হবে পঁচিশ নয়া পয়সা। সিনেমা-সাহিত্য সাপ্তাহিক হিসেবে এই পত্রিকার ২য় বর্ষ, ২য় সংখ্যার প্রকাশকাল ০৯ জুলাই বৃহস্পতিবার ১৯৬৪, ৩য় সংখ্যা প্রকাশিত হয় ৩০ জুলাই ১৯৬৪ । পত্রিকাটি আবু জাফর কর্তৃক প্রকাশিত হতো এর মুদ্রাকর ছিল এ. কে. এম. মহিদউদ্দিন, ছাপাখানা বিজি প্রেস ১৩/১ বাবকুন বাড়ী লেন, ঢাকা-১।
এরপর ১৯৬৬ সালের নভেম্বরে আরেকটি মাসিক সিনে পত্রিকা বের হয় যার নাম “ঝিনুক”। “আমাদের কথা” শীর্ষক প্রথম সংখ্যার সম্পাদকীয়তে সম্পাদক আসিরুদ্দিন আহাম্মদ পত্রিকার উদ্দেশ্য প্রকাশ করে লিখেন “আমাদের সাংস্কৃতিক জীবনধারা নানা প্রতিকূলতার বেড়াজালে আবদ্ধ। আর এই প্রতিকূলতার নিষ্পেষণে সাংস্কৃতিক আদর্শ দিন- দিন যেভাবে মার খাচ্ছে আজও তার প্রতিবিধানিক কোন মানসিকতা গড়ে উঠেনি। সাংস্কৃতিক সত্যিকারের আবেদন খুঁজে পাবে তখনই যখন আমরা এর সস্তা বাহনগুলোকে পরিত্যাগ করিতে সক্ষম হব। ঝিনুক এই সস্তা বাহনগুলো থেকে উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম হবে। এটাই আমাদের প্রতিজ্ঞা ঝিনুকের যাত্রাকালে। সহৃদয় পাঠক-পাঠিকাদের এই অনুরোধ করছি যে, আদর্শ সাংস্কৃতিক মানসের আলোকে প্রতিটি কর্মধারা হবেই। নিরপেক্ষ সাংবাদিকতা আর অশুতোখয় সমালোচনা দ্বারা গোষ্ঠীর সেবা পরিহার করেও আমরা যেন এমন এক ব্যাপ্তি পরিবেশ গড়ে তুলতে পারি সেখানে দলমত নির্বিশেষে সবারই প্রবেশাধিকার থাকবে”। পত্রিকাটি আশরাফ হালিম কর্তৃক লাকী আর্ট প্রেস ৫০, টিপু সুলতান রোড থেকে প্রকাশিত হতো।
বিনোদনধর্মী পত্রিকা প্রকাশের হিড়িক পড়ে একাত্তরের স্বাধীনতার পর। স্বাধীন দেশে একের পর এক প্রকাশ হতে থাকে নতুন পত্রিকা। তারকালোক, ছায়াছন্দ, আনন্দবিচিত্রা, বিনোদন, টেলিভিশন, আনন্দধারা, বিনোদন ভুবন, আনন্দ বিনোদন, আনন্দ ভুবন, বিনোদন বিচিত্রা, প্রিয়জন প্রভৃতি পত্রিকা বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত হয়ে বাজারে চালু ছিলো দীর্ঘ সময়। এসব পত্রিকা বিনোদনের সংবাদ পরিবেশনের মাধ্যমে দেশজ শিল্পীদের জনপ্রিয় করে তোলার ক্ষেত্রেও বড় ভূমিকা তৈরি করে। এবং বিশাল একটি দর্শক গোষ্ঠি তৈরি করে। বিনোদন নিছক আনন্দ দেবার মাধ্যম থেকে একটি ইন্ডাষ্ট্রিতে রূপ নেয়। গড়ে ওঠে বিভিন্ন নির্মান হাউজ ও প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান। গল্প, গান, সংলাপ এর উৎকর্ষ সৃষ্টিতে তরুণদের মধ্যে একধরনের ইতিবাচক প্রতিযোগিতা সৃষ্টি হয়। এ শিল্পকে কেন্দ্র করে অনেক কলাকূশলী সৃষ্টি হয়। কিন্তু কালের গর্ভে সেই সময় এখন হারিয়ে গেছে। এক সময়ের জনপ্রিয় চলচ্চিত্রাঙ্গন এখন আকাশ সংস্কৃতির প্রচন্ড বিস্তারের মধ্যে টিকে থাকার সংগ্রামে লিপ্ত। বছরে মুক্তিপ্রাপ্ত ছবির সংখ্যাও অনেক কমে গেছে। এর মাঝে ব্যতিক্রমী হয়ে টিকে আছে নাটক। বাংলাদেশের নাটক ইউটিউব সহ বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রদর্শিত হচ্ছে। এবং তীব্র প্রতিযোগিতার মাঝে নাটক দাপটের সাথে নিজেকে মেলে ধরতে সক্ষম হচ্ছে। এসব খবরও প্রিন্ট মিডিয়ায় আসার আগেই বিভিন্ন পত্রিকার অনলাইন ভার্সন ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দর্শকরা জেনে যাচ্ছেন। তাই পত্রিকা বা সাময়িকী পড়ার প্রয়োজন হচ্ছে না।
গত ৫৩ বছরে বিনোদন বিষয়ক অসংখ্য পত্রিকা দেশে শো-বিজ ইন্ডাস্ট্রি গড়েতুলতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। বিশেষ করে নব্বই দশকে বিনোদন পত্রিকাগুলোর ফটো- সুন্দরী প্রতিযোগিতা ও নতুন মুখের সন্ধানে শীর্ষক বিভিন্ন আয়োজন আমাদের শো-বিজ অঙ্গনকে অনেক সমৃদ্ধ করেছে। বিনোদন পত্রিকাগুলো ফ্যাশন শো’র আয়োজন করে এ দেশীয় বস্ত্রের বিপণন ও জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে।
তথ্য প্রযুক্তির বিপ্লবের এ সময়ে ছাপার কাগজ ছাপিয়ে বিনোদন উঠে এসেছে ভার্চুয়াল জগতে। অষ্টপ্রহর গান, সিনেমা, নাটক, চিত্রকলা, ফ্যাশন শোসহ বিনোদনের খবরাখবর পাওয়া যায় ইউটিউব, টুইটার, ফেইসবুক ও ইনস্টাগ্রামে। সাময়িকী ও পত্রিকার বিনোদনের পাতায় এখন পাঠককের চোখ পড়ে না, পাঠকের চোখ আটকে গেছে কম্পিউটার আর মোবাইলের স্ক্রিনে। পাঠক এখন হয়ে গেছে ভিউয়ার্স। আঙুলের ছোঁয়ায় বিনোদনের রুচি বদল হয় এখন। পণ্যের বিপণনের কথা ভেবে বিজ্ঞাপন ভার্চুয়াল জগতে চলে যাচ্ছে। তাই বিনোদন সাময়িকী শুধু নয় প্রিন্ট মিডিয়াও এই আগ্রাসনে প্রচন্ড চ্যালেঞ্জের মুখে।
প্রযুক্তির দিক থেকে আমাদের দেশের মিডিয়া জগতে বিপ্লব ঘটলেও সংবাদের গুণগত উন্নতি ঘটে নি। বিনোদন পত্রিকা ক্রমাগত বেড়েই চলছে; কিন্তু সেই হারে প্রতিবেদক বা সংবাদকর্মী তৈরি হচ্ছে না। গত দুই দশকে মুদ্রণ প্রযুক্তির অভাবনীয় উন্নতি হয়েছে। পত্রিকা খুললেই এখন রঙের ছড়াছড়ি। কিন্তু পাঠক রঙের নান্দনিক কারুকাজের সাথে টেক্সটও চান। কিন্তু বিনোদন পত্রিকায় ইদানীং টেক্সট সেভাবে গুরুত্ব পায় না। এ ছাড়া ভুল বানান, অশুদ্ধ বাক্য, মুদ্রণ প্রমাদ-এগুলো যেন বিনোদন পত্রিকাগুলোর নিত্য চলার সাথী হয়ে গেছে। মেকআপ এবং গেটআপের সূক্ষ্মতম দিকটি এখনও বেশির ভাগ বিনোদন পত্রিকা আয়ত্ত করতে পারে নি। এ ক্ষেত্রে বিনোদন পত্রিকাগুলোতে একজন গ্রাফিক্স এডিটর নিয়োগ, ডিজাইনার নিয়োগ দিয়ে পত্রিকার দৃষ্টিনন্দন ব্যাপারটিকে নিখুত করা প্রয়োজন।
একটি বিনোদন সাময়িকী মানুষের তৃতীয় নয়ন খুলে দেয়, অনুন্মোচিত বিষয়গুলোকে উন্মোচিত করে। সমাজ, রাষ্ট্র, সরকার যেদিকে দৃষ্টিপাত করছে না, সেদিকে দায়িত্বশীলদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে এবং করণীয় সম্পর্কে পরামর্শ দিতে পারে। আমরা একটি বহুমাত্রিক গণতান্ত্রিক বিতর্কভিত্তিক সমাজে বসবাস করি। সমজের মানুষ বিনোদনের মাধ্যমে নিজেকে বিকশিত করার মাধ্যমে মন ও মননের নিঁখুত বুননের মাধ্যমে নিজেকে করতে পারে আরও পরিণত ও পরিপাটি। পর্যায়ক্রমে এটি ব্যক্তি থেকে সমাজ ও রাষ্ট্রে প্রতিফলিত হবে। একটি মুক্তবুদ্ধি ও মুক্তজ্ঞান চর্চাসম্পন্ন নাগরিক সমাজ গড়তে হলে সুস্থ বিনোদন অপরিহার্য। বিনোদন পত্রিকাগুলো সেই কাজটি করে চলেছে দিনের পর দিন।
-মাহবুবুর রহমান তুহিন-সিনিয়র তথ্য অফিসার, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়।