চারদিক ডেস্ক
শহর, বন্দর, গ্রাম-সব জায়গায় গ্রীষ্মের রুদ্ররোদ। প্রচণ্ড তাপে গলে যাচ্ছে সড়কের পিচ, হিট স্ট্রোকে মারা যাচ্ছেন মানুষ। তীব্র গরমে ঘরে-বাইরে কোথাও স্বস্তি নেই। দাবদাহ বাড়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রোগবালাইও বাড়ছে। গরম থেকে বাঁচতে নদী-খাল-বিল ও ডোবায় নামছে মানুষ, ঘটছে দুর্ঘটনা। সর্বত্র হাঁসফাঁস অবস্থা; এই অবস্থা থেকে বাঁচতে দেশের বিভিন্ন স্থানে বৃষ্টির জন্য নামাজ আদায় করেছে মানুষ। মঙ্গলবার (২৩ এপ্রিল) সারা দেশে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পাঁচজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ঢাকার ওয়ারীতে ছাপাখানার কর্মী, ময়মনসিংহে শিলপাটার কর্মী ও মিল শ্রমিক, কুমিল্লায় রাজ জোগালি, জামালপুরে ব্যবসায়ীর মৃত্যু হয়েছে। হিট স্ট্রোকজনিত কারণে এদের মৃত্যু হয়েছে বলে জানা গেছে। এছাড়া গরম থেকে বাঁচতে রাজশাহীর পদ্মা নদীতে নেমে তিন শিশু মারা গেছে। হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে চারটি পরামর্শ দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এদিকে তিন দিনের হিট অ্যালার্টের দ্বিতীয় দিনেও আবহাওয়া অফিস তাপমাত্রা কমার সুখবর দিতে পারেনি। তবে জানানো হয়েছে-দাবদাহ কমতে হলে শক্তিশালী ঝড় দরকার। কিন্তু সেই ঝড়েরও কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না।
ঢাকার তাপমাত্রা আজ বুধবার আবার বেড়েছে। বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর সূত্র জানায়, মঙ্গলবার রাজধানীর সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৩৮ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তবে আগামী ১ সপ্তাহে পুরো দেশে বৃষ্টির কোনো সম্ভাবনা নেই। বিচ্ছিন্নভাবে কোনো কোনো এলাকায় বৃষ্টির সম্ভাবনা আছে। আর মে মাসের শুরু থেকে তাপমাত্রা সহনীয় পর্যায়ে আসতে পারে।
প্রসঙ্গত, গত শনিবার দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় যশোরে, ৪২ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এটি ছিল এ বছরের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা। ওইদিনই রাজধানীর তাপমাত্রা ছিল ৪০ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এটিও ছিল এ বছরে রাজধানীর সর্বোচ্চ তাপমাত্রা। তবে রোববার ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে নগরীর তাপমাত্রা ২ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস কমে যায়। ওইদিন সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৩৮ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর সোমবার ঢাকার তাপমাত্রা আরও কমে হয় ৩৭ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
আবহাওয়া অফিস সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে দেশের ৪০টির বেশি জেলার বিভিন্ন স্থানে মৃদু থেকে তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৬ থেকে ৩৭ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলে মৃদু তাপপ্রবাহ, ৩৮ থেকে ৩৯ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলে মাঝারি তাপপ্রবাহ, ৪০ থেকে ৪১ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলে তীব্র তাপপ্রবাহ এবং ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তার বেশি হলে তাকে অতি তীব্র তাপপ্রবাহ বলছে আবহাওয়া বিভাগ।
এদিকে মঙ্গলবার আবহাওয়া অধিদপ্তরের দেওয়া এক পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, বুধবার সন্ধ্যা ৬টার পর থেকে সারা দেশে দিন ও রাতের তাপমাত্রা কিছুটা কমতে পারে। অর্থাৎ বুধবার সন্ধ্যা ৬টার পর থেকে গরমের অনুভূতি কিছুটা হলেও কমবে। তবে জলীয়বাষ্পের আধিক্যের কারণে অস্বস্তিও বিরাজ করতে পারে কিছুটা। আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, দেশে চলমান তাপপ্রবাহ আগামীকাল বুধবার পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। বর্ধিত পাঁচ দিনের আবহাওয়ার পূর্বাভাসে অধিদপ্তর জানিয়েছে, এই সময়ের শেষ দিকে দেশের উত্তর-পূর্বাংশে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বাড়তে পারে।
রাজধানীতে সরেজমিন ঘুরে এবং দেশের বিভিন্ন এলাকার প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্যে দেখা গেছে, তীব্র দাবদাহের কারণে অধিকাংশ মানুষ বাইরে বের হচ্ছে না। জরুরি প্রয়োজনে যারা বাইরে বের হচ্ছেন, তারাও সতর্ক রয়েছেন। তবে দিনমজুর ও খেটে খাওয়া মানুষরা জীবিকার তাগিদে বাইরে বের হচ্ছেন। বাইরে বের হওয়া মানুষদের অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন।
আবহাওয়ার পূর্বাভাস সম্পর্কে জানতে চাইলে আবহাওয়াবিদ হাফিজুর রহমান জানান, আপাতত তাপমাত্রা কমার কোনো সুখবর নেই। তাপমাত্রা কিছুটা কমা-বাড়ার মধ্যে আরও কিছুদিন এভাবে চলবে। তবে শক্তিশালী ঝড় হলে তাপমাত্রা কমে যাবে। আপাতত তেমন কোনো ঝড়ের সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের চার নির্দেশনা: তীব্র গরমে হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে মঙ্গলবার এক বিজ্ঞপ্তিতে চারটি পরামর্শ দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলেছে, হিট স্ট্রোক থেকে বাঁচতে তীব্র গরম থেকে দূরে থাকতে হবে, মাঝে মাঝে ছায়ায় বিশ্রাম নিতে হবে। শরীরের পানিশূন্যতা পূরণ করতে প্রচুর পরিমাণে নিরাপদ পানি পান করতে হবে। এক্ষেত্রে পূর্ণবয়স্ক ব্যক্তি সারাদিনে কমপক্ষে আড়াই থেকে ৩ লিটার পরামর্শ দিয়েছে দপ্তর। তবে হেপাটাইটিস-এ, হেপাটাইটিস-ই, ডায়রিয়াসহ প্রাণঘাতী পানিবাহিত রোগ থেকে বাঁচতে রাস্তায় তৈরি পানীয় ও খাবার এড়িয়ে চলতে হবে। প্রয়োজনে দিনে একাধিকবার গোসল করতে হবে। গরম আবহাওয়ায় ঢিলেঢালা পাতলা ও হালকা রঙের পোশাক পরতে বলেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। সম্ভব হলে গাঢ় রঙিন পোশাক এড়িয়ে চলতে হবে। গরম আবহাওয়ায় ঘাম বন্ধ হয়ে যাওয়া, বমি বমি ভাব, তীব্র মাথাব্যথা, শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়া, প্রস্রাব কমে যাওয়া, প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া হওয়া, খিঁচুনি এবং অজ্ঞান হওয়ার মতো কোনো লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত হাসপাতালে যেতে হবে। নির্দেশনায় অধিদপ্তর আরও জানিয়েছে বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যা, যেমন-ডায়াবেটিস, কিডনি রোগ, উচ্চ রক্তচাপ অথবা অন্যান্য রোগ থাকলে গরমের সময়ে করণীয় সম্পর্কে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি যতœ নিতে হবে। স্বাস্থ্যবিষয়ক পরামর্শের জন্য প্রয়োজনে ‘স্বাস্থ্য বাতায়ন ১৬২৬৩’ নম্বরে যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে।
তাপমাত্রার কারণ ও কমানোর উপায়: এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম-সম্পাদক অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার জানান, বাতাসে জলীয়বাষ্পের পরিমাণ কমে যাওয়ায় তাপমাত্রা বাড়ছে। আর এর নেপথ্যের তিনটি কারণ রয়েছে। সেগুলো হলো-প্রধানত বৈশ্বিক, আঞ্চলিক ও স্থানীয়। বৈশ্বিক কারণের মধ্যে রয়েছে-পৃথিবীর ফুসফুসখ্যাত আমাজান ফরেস্ট নষ্ট হওয়া, উন্নত দেশগুলোর অতিরিক্ত কার্বন নিঃসরণ ও ফুয়েল বার্ন বেড়ে যাওয়া। আর আঞ্চলিক কারণের মধ্যে রয়েছে-বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, ভুটান, আফগানিস্তান ও চীন নিয়ে গঠিত জোনে প্রবহমান নদী মেরে ফেলা। এ কারণেও বাংলাদেশের তাপমাত্রা বাড়ছে। তবে বাংলাদেশের ও বিশেষ করে ঢাকার তাপমাত্রা বাড়ার বড় কারণ স্থানীয়। এক সময় দেশের ২৫ শতাংশ বনাঞ্চল থাকলেও বর্তমানে এর পরিমাণ খুবই কম। এছাড়া শহরের গাছপালা ও জলাশয় ভরাট করে ফেলা হচ্ছে।
তিনি জানান, এই অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটাতে হলে সবুজ ও জলাশয়ের পরিমাণ বাড়াতে হবে। বড় গাছগুলো না কেটে স্থানান্তর করতে হবে। ‘ট্রি-ট্রান্সপ্লানটিং মেশিন’ দিয়ে এটা করতে হবে। এই ধরনের একটি মেশিনের দাম ২ কোটি টাকার মতো। সরকারকে এসব দিকে ভাবতে হবে। বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক কারণ তাপমাত্রা বাড়তে থাকবে। সেটা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না। তবে অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হবে। সেসব কাজগুলোয় সরকারকে বিশেষভাবে মনোযোগ দিতে হবে।
এ প্রসঙ্গে পরিবেশ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত জানান, জলবায়ু পরিবর্তন অবধারিত বিষয়। এটা রোখা যাবে না। পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়া শিখতে হবে। অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি ও অতিতাপ সহনীয় কৃষি বীজ উদ্ভাবনের প্রচেষ্টা চলছে। এভাবে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে।
তিনি জানান, সমগ্র বিশ্বের গড় তাপমাত্রা বাড়বে। তা প্রতিরোধ করা যাবে না। নানামুখী চেষ্টায় অনেকাংশ নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে। এজন্য উদ্ভাবনের মাধ্যমে জীবনযাত্রার জন্য নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
এদিকে রাজধানীর ওয়ারী থানাধীন গুলিস্তান টোল প্লাজার কাছে আলমগীর শিকদার (৫৬) নামের এক ব্যক্তি হিট স্ট্রোকে মারা গেছেন। তিনি ছাপাখানায় বাইন্ডিংয়ের কাজ করতেন। মৃত আলমগীর যাত্রাবাড়ী থানাধীন দক্ষিণ কাজলার নয়ানগর এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা। তার বাবার নাম জমির শিকদার। মৃতের ছোট ভাই রবিউল আলম বলেন, তার ভাই ছাপাখানায় বাইন্ডিংয়ের কাজ করতেন। সকালে বাসা থেকে কাজের উদ্দেশে বের হয়ে যান। পথে অসুস্থতার খবর পেয়ে ঢাকা মেডিকেলে গিয়ে মৃত অবস্থায় দেখতে পান। তিনি হিট স্ট্রোকে মারা যেতে পারেন বলে তারা ধারণা করছেন।
কুমিল্লা ব্যুরো জানায়, তীব্র গরমের মাত্রা সহ্য করতে না পেরে হিট স্ট্রোকে মৃত্যুবরণ করেছেন রাজ জোগালির শ্রমিক মজিবুর রহমান (৪৫)। সকালে তিনি বুড়িচং সদরের এক ব্যবসায়ীর বাড়িতে কাজ করতে যান। বিল্ডিংয়ের বেইজ কাটার সময় হিট স্ট্রোকে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে বুড়িচং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
ইসলামপুর (জামালপুর) প্রতিনিধি জানান, ইসলামপুরে তীব্র দাবদাহে হিট স্ট্রোকে গোলাম রাব্বানী (৪৮) নামের এক ব্যবসায়ীর মৃত্যু হয়েছে। তিনি উপজেলার চিনাডুলি ইউনিয়নের পশ্চিম গিলাবাড়ী এলাকার বাসিন্দা গুঠাইল বাজারের ব্যবসায়ী ছিলেন। মঙ্গলবার বিকালে নিজ বাড়িতেই তিনি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। স্থানীয়রা দ্রুত তাকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
ফুলপুর (ময়মনসিংহ) প্রতিনিধি জানান, উপজেলার ইমাদপুর গ্রামে দুপুরে হিট স্ট্রোকে রমজান আলী (৬৩) নামে একজনের মৃত্যু হয়েছে। তার বাড়ি তারাকান্দা উপজেলার বগিরপাড়া গ্রামে। তিনি সিলপাটা কাটার কাজ করতে এসে হিট স্ট্রোকে অসুস্থ হন। পরে ফুলপুর হাসপাতালে আনার পর মারা যান।
ভালুকা (ময়মনসিংহ) প্রতিনিধি জানান, ভালুকায় হিট স্ট্রোকে কামরুল ইসলাম (৩০) নামে এক মিল শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। মঙ্গলবার উপজেলার জামিরদিয়া মাস্টারবাড়ি এলাকায় নিহত কামরুল ইসলাম ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলার রায়শিমুল গ্রামের আব্দুল্লাহর ছেলে। পূর্বাশা কম্পোজিট টেক্স লিমিটেডের অ্যাডমিন ম্যানেজার মাসুম জানান, সকালে কামরুল ইসলাম কর্মস্থলে আসার পর অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে তাকে তার ভাইকে দিয়ে চুরখাই হাসপাতালে নেওয়ার পর তিনি মারা গেছেন।সূত্র:যুগান্তর