সাগর রহমান
দুই
স্টাফ রুমে একা একা খেতে আসার সুযোগ খোঁজার পিছনে তৃতীয় আরেকটা কারণ আছে আমার। সেটা খাবারের হালাল-হারাম সংক্রান্ত।
ম্যাকডোনাল্ডে যত ধরনের খাবার-দাবার পাওয়া যায়, সেগুলোকে হালাল ও হারাম, এমন মোটাদাগে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। এর মধ্যে হারামের তালিকাটাই দীর্ঘ। সালাদ, আলুভাজা, ফিলেট-ও-ফিস (ফিস বার্গার) ও ভেজি-বার্গার বাদ দিলে আর প্রায় সবই হয় গরম্নর মাংসের, না হয় মুরগির, না হয় বেকন দিয়ে তৈরি। এবং স্বীকার করে নেয়া দরকার, স্বাদের দিক থেকে হারাম খাবারগুলোর কোন তুলনাই হয় না অন্যগুলোর সাথে।
আমরা যে ক’জন মুসলমান এখানে কাজ করি, তার মধ্যে কয়েকজন বেশ মুসলিস্ন-স্বভাবের মুসলমান। এরা সাধারণত ম্যাকডোনাল্ডের সব ধরনের খাবার-দাবার এড়িয়ে চলে। নিদেন হালালগুলোও, কেননা, তাদের সন্দেহ (এবং কতকটা সত্যতাও আছে এতে), যতই আলাদা রান্না করা হোক না কেন, যে তেলে ভাজা হয়, প্রায়ই সেসব তেল হারাম খাবারের তেলের সাথে মিলেমিশে যায়। এরা বড় জোর আলুভাজা পর্যন্ত ছোঁয়, কারণ আলুভাজার জায়গাটা অন্য জিনিসগুলোর ভাজাভাজির জায়গা হতে আলাদা। অবশ্য এই মুসলিমদের কার্যক্রম এতেই সীমাবদ্ধ থাকে না। অন্য কোন মুসলমান-ব্রাদার ও সিস্টার কে কী খেল, সেদিকেও তীড়্গ্ন নজর রাখেন। একটু উল্টা-পাল্টা দেখলে ‘নাউজুবিল্লাহ, আসতাগফিরুল্লাহ’ বলতেও ছাড়ে না। আবার কয়েকজন আছে মুসলমান হলেও ঠিক উল্টো স্বভাবের। তারা বেকন ছাড়া আর সবই খায়। কোনরকম রাখ-ঢাকও করে না। মুসলিমদের সাথে ব্যাপারটা নিয়ে এদের প্রায় লেগে যায়। তাদের যুক্তি, যস্মিন দেশে যদাচার। বিসমিল্লাহ বলে খেয়ে ফেললে বেকন ছাড়া আর সবই হালাল হবে এদেশে। জবাইয়ে যে আল্লার নাম নেয়া হয় নাই, সেটা খাবারের সময় নিয়ে নিলেই দোষ কাটা যাবার কথা। এসব নিয়ে স্টাফ রুমে প্রায়ই দু’দলের মধ্যে তুমুল ঝগড়া-বিবাদ লাগে। বলাবাহুল্য, সেটা ঐ কথা কাটাকাটি পর্যন্তই। দেশে থাকলে নাস্তিক ফাস্তিক তকমা লেগে তুলকালাম হওয়া বিচিত্র কিছু ছিল না।
এদের মাঝামাঝি আরেক দল আছে। যারা মনে মনে জানে, এসব খাওয়াটা আদতে হারাম, কিন্তু এ জ্ঞান তাদেরকে চিকেন-বিফ খাওয়া থেকে বিরত রাখতে পারে না। ইমান দুর্বল হবার কারণে জিহ্বার স্বাদের কাছে হার মেনে যায়। তারা যে এসব খায়, তা যেন অন্য কেউ না দেখে ফেলে, তার জন্যও চেষ্টার অন্ত থাকে না। হয়তো সবার সামনে সালাদের বক্স নিল এবং কেউ না দেখার ফাঁকে এক টুকরো চিকেন ভাজা ঢুকিয়ে ফেলল লেটুসের ভেতরে। কিংবা ভেজি-বার্গারের বক্সের ভেতরে বিগম্যাক ঢুকিয়ে ভাল মানুষের মতো খেতে চলে গেল।
স্বীকার করে নিই, আমি এই তৃতীয় দলে। প্রথম প্রথম ফিস-বার্গার, ভেজি বার্গার এসব খেতাম। কিন্তু মাস ঘুরতে না ঘুরতেই এগুলো ঘাসের মতো লাগতে শুরু করল। এবং একসময় ‘আলস্নাহপাক নিশ্চয়ই মাফ করে দিবেন’ এই ভরসায় বিফ-টিফ খেতে শুরম্ন করি। তবে ঐ যে বলে না, আলস্নাহ মাফ করলেও বান্দায় মাফ করবে না, সেজন্যই ঐ লুকোচুরি-রাখঢাকের ব্যাপার। স্টাফ রুমে একা খেতে আসলে অন্তত মন খুলে নিজের যে বার্গার খেতে ইচ্ছে, সেটা খাওয়া যায় ।
যাই হোক, পুরানো প্রসঙ্গে ফিরে যাই। একা একা খাচ্ছিলাম। এলিস এসে বসল ঠিক উল্টো দিকের চেয়ারে। মুখোমুখি।
এলিসের ট্রেতে একটা সালাদ। একটা ফ্রুট ব্যাগ। এক বোতল পানি।
আমি আড়চোখে এলিসের ট্রের দিকে তাকালাম। এর স্বাস্থ্য সচেতনতা দেখে বেশ প্রশংসা করলাম মনে মনে এবং নিজেও যে খুব শীঘ্রই এমন ধরনের ডায়েটের দিকে ধাবিত হতে হবে, সে কথা নিজেকে মনে করিয়ে দিলাম। ইদানীং দেখেছি তলপেট কেমন থলথলে হয়ে এসেছে। এর বেশ খানিকটা যে ম্যাকডোনাল্ডের চিজ আর মাংসের টুকরোর প্রভাব তা নিশ্চিত করেই বলে দেয়া যায়।
দেখলাম, এলিসও আমার ট্রের দিকে তাকিয়ে আছে। ভাবলাম, ঘটনা কী? এ আবার মুসলমান নয় তো।
খানিকক্ষণ আমরা কেউ কোন কথা বললাম না। তারপর আচমকা এলিস আমাকে জিজ্ঞেস করল, তুমি কী কিচেনে কাজ করো?
আমি মুরগির টুকরো চিবোতে চিবোতে ‘হ্যাঁ’ জানালাম।
সে বলল, মুরগির টুকরো, গরুর পেটি এগুলো ভাজাভাজি কর?
আমি মুখে বললাম, সে তো করতেই হবে।
এলিস বলল, সারাদিনে কত টুকরো মুরগি ভাজ তুমি?
এমন বেয়াড়া প্রশ্নে বেশ থমকে গেলাম। উত্তরে ঠিক কী বলতাম জানি না, কিন্তু কিছু বলার আগেই উপর থেকে আমার ডাক পড়ল। ব্রেক আপাতত মুলতবি রেখে ‘ফ্লোরে’ ফিরে যেতে হবে। ভয়াবহ ভিড় লেগে গেছে ওখানে। এমনটা প্রায়ই হয়। এই রেস্টুরেন্টটা টুরিস্ট এলাকায় হওয়ায় মাঝে মাঝে বড় কোন এক দল টুরিস্ট হয়তো ঢুকে পড়ে, একসঙ্গে প্রায় শ’খানেক খাবারের অর্ডার চলে আসে। এদিকে প্রতিদিনকার ভীড় তো আছেই। এ ধরনের সময়ে কেউ ‘ব্রেকে’ থাকলে, ভিড় সামাল দেয়ার জন্য তাকেও ডেকে নেয়া হয়। সুন্দরী-সংগ ত্যাগ করে অনিচ্ছায়ও আমি ঝট করে উঠে দাঁড়ালাম। বাকি খাবারটা ময়লার ঝুড়িতে ফেলে, এলিসকে পরে দেখা হবে জানিয়ে স্টাফ রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেলাম।