২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার বাজেট জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করা হবে আজ। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ঘোষণা করবেন দেশের ৫২তম বাজেট। ইতোমধ্যেই বাজেটের সারসংক্ষেপ অনুমোদন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রস্তাবিত বাজেটে কৃচ্ছ্রতা সাধন নীতি অব্যাহত রেখেছে সরকার।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে প্রধান্য দিয়ে প্রস্তাব করা ভোটের বছরের এই প্রস্তাবিত বাজেট আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্তগুলো মাথায় রেখে প্রস্তুত করা হয়েছে বলে অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে। কর্মকর্তারা বলছেন, বাজেটের মূল লক্ষ্য হচ্ছে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা ও উচ্চতর জিডিপি প্রবৃদ্ধি অব্যাহত রাখা। এবারের বাজেট ‘সম্প্রসারণমূলক বা সংকোচনমূলক’ হবে না। তবে ব্যয় সংকোচন নীতি বহাল থাকবে।
অর্থমন্ত্রী আজ জাতীয় সংসদে ‘দেড় দশকের উন্নয়নের পর স্মার্ট বাংলাদেশের অগ্রগতি’ শীর্ষক বাজেট বক্তৃতা দেবেন। সারসংক্ষেপে প্রস্তাবিত বাজেটের স্বপক্ষে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ‘অর্থনীতির ক্রমবর্ধমান আকার এবং বর্তমান চাহিদা বিবেচনায় কম আয়ে বেশি ব্যয়ের এই বাজেট বাস্তবায়ন করে সব লক্ষ্যই অর্জন করা সম্ভব।’
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের চলমান ৫ বছরের মেয়াদের শেষ বাজেট এটি। এমন এক সময়ে এই বাজেট ঘোষণা করা হচ্ছে- যখন খাদ্য, জ্বালানি ও পরিবহন ভাড়া থেকে শুরু করে ইউটিলিটি বিল পর্যন্ত প্রায় সব কিছুরই উচ্চমূল্য। যা সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছেন সাধারণ মানুষ।
যদিও সরকার চায় আগামী অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি যাতে ৭ দশমিক ৫ শতাংশে পৌঁছায় এবং মূল্যস্ফীতির হার ৬ শতাংশের কাছাকাছি থাকে। আগামী বাজেটের আকার বর্তমান বাজেটের চেয়ে ১২ দশমিক ৩৪ শতাংশ বড় হবে। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের মূল বাজেটের তুলনায় ৮৩ হাজার ৭২১ কোটি টাকা বেশি।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রভিশনাল হিসাব বলছে, চলতি অর্থবছরে জিডিপি বেড়েছে ৬ দশমিক ০৩ শতাংশ এবং মূল্যস্ফীতির হার এপ্রিল পর্যন্ত ছিল ৮ দশমিক ৪ শতাংশ।
এবারের বাজেট উচ্চাভিলাষি নয় জানিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, এবারের বাজেট ৫০ লাখ ৬ হাজার ৬৭২ কোটি টাকার প্রাক্কলিত জিডিপির ১৫ দশমিক ২১ শতাংশ, যা চলতি অর্থবছরে ছিল ১৫ দশমিক ২৭ শতাংশ। তবে বাজেটে স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনির মতো খাতে বরাদ্দের বড় কোনো পরিবর্তন হবে না।
প্রস্তাবিত বাজেটে ভর্তুকির জন্য বরাদ্দ বাড়িয়ে ১ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি এবং সুদ পরিশোধের জন্য ১ লাখ ২ হাজার কোটির বেশি করা হবে। চলতি অর্থবছরে ভর্তুকি বাবদ বরাদ্দ ছিল ৮১ হাজার কোটি টাকা এবং সুদ পরিশোধের জন্য ছিল ৮০ হাজার কোটি টাকা।
অন্যদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের উচ্চমূল্য এবং টাকার মান কমায় এই ২ খাতে বরাদ্দ বাড়ানো হচ্ছে। ভর্তুকির বোঝা কমাতে বিদ্যুৎ ও সারের দাম বাড়ানো হচ্ছে। তবে বকেয়া পরিশোধ করতে ভর্তুকির জন্য সরকারের এখনো আরও অর্থ প্রয়োজন।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সরকার বৈদেশিক রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে আগামী অর্থবছরে খরচ কমানো বিষয়ক কঠোরতা অবলম্বন অব্যাহত রাখবে। সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, আইএমএফের ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ কর্মসূচির একটি শর্ত মাথায় রেখে সরকার ৫ লাখ কোটি টাকা রাজস্ব সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে, যা গত অর্থবছরের তুলনায় প্রায় ৬৭ হাজার কোটি টাকা বেশি।
আইএমএফের শর্ত অনুসারে, অর্থ মন্ত্রণালয়ের এমনভাবে রাজস্ব ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে যাতে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে আগের অর্থবছরের চেয়ে জিডিপির আরও অতিরিক্ত শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ রাজস্ব লাভ করতে পারে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য মোট কর-রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা হবে ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রকৃত রাজস্ব ও ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জিডিপির অতিরিক্ত দশমিক ৫ শতাংশ। আগামী অর্থবছরের প্রাক্কলিত জিডিপি ৫০ লাখ ৬ হাজার ৬৭২ কোটি টাকা এবং এর শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ হলো ২৫ হাজার ৩৪ কোটি টাকা।
রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে সারা দেশে বেসরকারি এজেন্ট নিয়োগসহ কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এজেন্টরা সরাসরি কর আদায় করবেন না। এজেন্টরা মানুষের কাছে গিয়ে তাদের করের আওতায় আসতে রাজি করাবেন এবং তাদের কর ফাইল খুলতে ও রিটার্ন জমা দিতে সাহায্য করবেন। যাদের ট্যাক্স আইডেন্টিফিকেশন নম্বর (টিআইএন) আছে, কিন্তু আয় করযোগ্য আয়সীমার নিচে- তাদেরকেও রিটার্ন জমা দিতে হবে এবং ন্যূনতম ২ হাজার টাকা কর দিতে হবে। করভুক্ত আয়সীমা বর্তমান ৩ লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৩ লাখ টাকা করা হতে পারে। করভুক্ত আয়ের ওপর ন্যূনতম কর আগের মতো ৫ হাজার টাকাই থাকছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, করযোগ্য আয় নেই এমন ব্যক্তিদের জন্য টিআইএন বাতিল করার মতো বিকল্প ব্যবস্থা থাকবে। যাতে তাদের কর দিতে না হয়।
আগামী বাজেটে সার্বিক ঘাটতি হবে ২ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। যা জিডিপির ৫ দশমিক ২ শতাংশ। ঘাটতি মেটাতে সরকার ব্যাংকসহ অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ১ লাখ ৫০ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা এবং বিদেশি উৎস থেকে ১ লাখ ১১ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনা করেছে। আইএমএফ শর্ত অনুযায়ী বাজেটের প্রাথমিক ঘাটতি জিডিপির ৩ শতাংশের মধ্যে থাকতে হবে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘প্রকৃতপক্ষে ঘাটতি আইএমএফ-নির্ধারিত সীমার কাছাকাছিই আছে। কারণ সামগ্রিক ঘাটতি থেকে সুদ প্রদান ও বৈদেশিক অনুদান বাদ দিয়ে প্রাথমিক ঘাটতি ধরা হয়। পরবর্তী অর্থবছরের প্রাথমিক ঘাটতির লক্ষ্যমাত্রা জিডিপির ৩ দশমিক ১ শতাংশ।’