তানভীর হোসেন
ঘুম থেকে উঠে ফোন হাতে নিতেই তারিখটি চোখে পড়লো। ৩ সেপ্টেম্বর। তারিখটি দেখে ফিরে গেলাম আমার শৈশবে। অতি পরিচিত, অতি প্রিয় একটি প্রাঙ্গণে। এই বিশেষ দিনটির জন্য ছোটবেলায় আমরা কত অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম। এই দিনটি ছিল আমাদের স্কুল দিবস। ৩ সেপ্টেম্বর আমাদের স্কুলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। আমি পড়তাম ঢাকার গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাই স্কুলে। ১৯৬৬ সনে ক্লাস ওয়ানে ভর্তি হয়ে ১৯৭৬ সনে এসএসসি পাশ করেছি। শৈশবের টানা দশটি বছর পার করেছি এই স্কুলের চত্বরে। স্কুলের প্রতিটি ইট পাথরের সাথে ছিল আমার নাড়ির সম্পর্ক।
আমাদের স্কুলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীটি খুব ধুমধাম করে উদ্যাপন করা হতো। দু মাস ধরে এর প্রস্তুতি চলতো। ছাত্ররা তাদের ক্লাসরুমগুলো সাজাতো খুব সুন্দর করে। লাল নীল বর্ণিল কাগজ দিয়ে খুব সুন্দর রিবন বানিয়ে ছাদ থেকে ঝুলিয়ে দিতো। নিজেদের আঁকা ছবি দিয়ে দেয়াল ভরিয়ে ফেলতো। দেয়াল পত্রিকা বের করতো। তাদের কাব্য ও সাহিত্য প্রতিভা প্রকাশ পেতো এতে। টিচাররাও খুব উৎসাহ দিতেন। তাঁরা জানতেন, পড়াশোনার বাইরে এসব চর্চা করলে ছাত্রদের সৃজনশীলতা বাড়ে। ছাত্রদের মাঝে কাব্য প্রতিভার অবশ্য কোনো অভাব ছিল না। একবার আমাদের এক বন্ধুতো লিখেই ফেললো,
”ওরে,শুনলে তোরা করবি হাসাহাসি,
টিফিন খাওয়ার জন্য স্কুলে আসি”
এখানে বলে রাখি, ওই সময় আমাদের স্কুলে খুব ভালো টিফিন দেওয়া হতো। টিফিন ফি ছিল মাসে পাঁচ টাকা। ওই টাকায় মাসে একদিন পোলাও মাংসের ফিস্টও খেতাম আমরা।
স্কুল দিবসে ক্লাসরুম সাজানো নিয়ে ক্লাসে ক্লাসে রীতিমত প্রতিযোগিতা চলতো। সবাই চাইতো তাদের ক্লাসটি সবচেয়ে সুন্দর ক্লাসরুম হিসাবে স্কুল দিবসে স্বীকৃতি পাক। এজন্য ছাত্ররা আপ্রাণ চেষ্টা করতো ক্লাসরুম সাজানোতে অনেক ধরনের নতুনত্ব আনার জন্য।
সময়টা ১৯৬৮ সাল। আমি তখন ক্লাস থ্রিতে পড়ি। স্বাধিকারের দাবিতে ক্ষুব্ধ স্বদেশভূমি। আমি তখন নেহাতই ছোট মানুষ। রাজনীতি অত শত বুঝি না। রাস্তায় স্লোগান শুনি, “জেলের তালা ভাঙবো, শেখ মুজিবকে আনবো”। ঢাকা কলেজ থেকে মাঝে মাঝে ছাত্ররা এই স্লোগান দিয়ে স্কুলে আসতো। আমাদেরকে ক্লাস থেকে বের করে মিছিলে নিয়ে যেত। টিচাররাও এতে বাঁধা দিতেন না। একদিন মনে আছে কলেজের ছাত্রদের মিছিলের সাথে হেঁটে হেঁটে পুরানো ঢাকার জেলগেট পর্যন্ত গিয়েছিলাম। তখন শেখ মুজিব কে সেটা জানতাম না। তবে তাঁকে জেল থেকে বের করা যে জরুরি সেটা বুঝতে পেরেছিলাম। খুব জোরে জোরে স্লোগান দিয়েছিলাম সেদিন।
এমনই এক উত্তাল সময়ে আমাদের স্কুল দিবস এসে পড়লো। ক্লাসরুম সাজাতে হবে। মহা চিন্তার বিষয়। হাজার চিন্তা করেও নতুন কিছু মাথায় এলো না। তখন আমাদের বন্ধু নাসিম উপায়টি বাতলে দিল। নাসিম সাইজে ছোটখাটো হলে কী হবে, বুদ্ধিতে সে বড়ই পাকা। নাসিম বললো, একটা কাগজের বাক্স জোগাড় করে তার উপর কাঁচি দিয়ে কেটে ‘স্বাগতম’ লিখতে হবে, তার উপর রঙিন কাগজ লাগাতে হবে। বাক্সের ভেতর একটি লাইট জ্বলবে আর নিভবে। তাতে স্বাগতম লেখাটিও একবার জ্বলবে আর একবার নিভে যাবে। খুব সুন্দর দেখা যাবে। ক্লাসরুম ডেকোরেশনের ফার্স্ট প্রাইজ নির্ঘাত এবার আমরা পাবো।
আইডিয়াটা অতি গোপন রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হলো। অন্যরা টের পেলে আবার আমাদের আগেভাগেই সেটা বাস্তবায়ন করে ফেলতে পারে। কিন্তু সমস্যা হলো লাইটটি কীভাবে জ্বলবে এবং নিভবে সেটি নিয়ে। সেই সমস্যার সমাধান নাসিমই দিয়ে দিলো। ও জানালো, আমাদেরকে একটি অটোমেটিক ব্যাটারি কিনতে হবে, তাহলেই কাজ হবে। অটোমেটিক ব্যাটারিটি কী বস্তু সেটি অবশ্য জানা ছিল না। নাসিমের নেতৃত্বে সদলবলে আমরা গেলাম নিউ মার্কেটে। ইলেক্ট্রিকের দোকানে খোঁজ নিলাম। দোকানদার জানালো অটোমেটিক ব্যাটারি নামের কোনো বস্তু তারা বিক্রি করে না। বললো, নবাবপুরে গিয়ে খোঁজ নিতে। নবাবপুর কি বাড়ির কাছে? কিন্তু তাতেও কোনো সমস্যা নেই। কাঠবডি বাসে করে চলে গেলাম নবাবপুরে। কিন্তু সেখানেও এই আজব বস্তুর কোনো সন্ধান পেলাম না। তবে ওখানকার দোকানদার আমাদের বুদ্ধি দিল স্টেডিয়াম মার্কেটে খোঁজ নিতে। নবাবপুর থেকে হেঁটেই চলে আসলাম স্টেডিয়াম মার্কেটে। স্টেডিয়াম মার্কেটে ঘোরাঘুরি করছি। এমন সময় আমার মেজো মামার সাথে দেখা হয়ে গেল। উনি তখন ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র। মামা আমাকে দেখে প্রথমে খুব রাগ করলেন, তোরা ছোট মানুষ স্টেডিয়ামে কেন ঘোরাফেরা করছিস? ওনাকে তখন অটোমেটিক ব্যাটারির কথা বললাম। মামা অত্যন্ত বুদ্ধিমান মানুষ। উনি শুনেই বললেন, ও তোরা মনে হয় টিউব লাইটের স্টার্টার খুঁজছিস, আরে বোকা ওটা তো সব জায়গায় পাওয়া যায়, এজন্য এতদূরে স্টেডিয়াম মার্কেটে আসতে হবে? মামার কাছে ধরা পড়ে প্রথমে খুব ভয় লেগেছিল, কিন্তু পরে সমস্যার সমাধান হয়ে যাওয়াতে খুশি হলাম। স্টার্টার কিনে স্কুলে ফিরে গেলাম আমরা। তারপর সেটি দিয়ে আমরা বানালাম আমাদের সেই আশ্চর্য জ্বলা-নেভা স্বাগতম বাক্স। তারপর ঝুলিয়ে দিলাম ক্লাস রম্নমের দরজার উপর। আমাদের ভাগ্যে পুরস্কার জুটেছিল কিনা সেটা অবশ্য এখন আর মনে নেই। তবে বড়দের মতো এত দূরে গিয়ে অটোমেটিক ব্যাটারি কেনার অভিজ্ঞতার কথা আজও ভুলিনি। কোথায় যে হারিয়ে গেল শৈশবের সেই সোনালি দিনগুলো?