স্পোর্টস ডেস্ক:
গোটা টুর্নামেন্ট জুড়ে ভক্তদের মন রাঙিয়ে নরেন্দ্র মোদি স্টেডিয়ামে শিরোপার আশায় নেমেছিল ভারত। দর্শক ধারণক্ষমতায় বিশ্বের বড় মাঠ বানিয়েছে ভারত। ক্রিকেট বিশ্বকাপের ফাইনাল ম্যাচে এসেছিলেন নরেন্দ্র মোদি। মাঠের এক কোণাও ফাঁকা রাখেননি ভক্তরাও। অর্থাৎ বিশ্বকাপ জয়ের মঞ্চ তৈরিতে কোনো ত্রুটিই ছিল না দেশটির। কিন্তু সবশেষে সেখানে শোনা গেছে ১ লাখ ৩০ হাজার দর্শকের দীর্ঘশ্বাস। লাখো মানুষের নীরবতার ভাষা ঠিক কেমন হয়, তা বিশ্বকে দেখিয়েছেন ভারতের সমর্থকরা।
আসরের প্রথম থেকে ভারত সবগুলো ম্যাচে জয় পেলেও ফাইনালে এসে কেমন যেন গুলিয়ে গেল সব! এর আগেও কম রানে গুটিয়ে যাওয়ার অভিজ্ঞতা আছে তাদের, কিন্তু দুর্দান্ত বোলিং, ফিল্ডিং আর ক্যাপ্টেন্সি দিয়ে তা পুষিয়ে নিয়ে জয় তুলে নিয়েছে দলটি। অস্ট্রেলিয়াকে একবার হারানোর পরও সেই তাদের কাছে কীভাবে মনোবল হারিয়ে, কৌশলহীন হয়ে পর্যুদস্ত হলো রোহিতের টিম ইন্ডিয়া, সে হিসাব এখনও অনেকে মেলাতে পারেননি। অনেকের তা মেলাতে লাগবে হয়তো দীর্ঘকাল। আবার অনেকে এই ক্ষত বুকে পুষে রাখবেন আজীবন।
ভারতের আজকের হারে সাধারণ ক্রিকেটবোদ্ধার চোখ দিয়েও বেশ কয়েকটি বিষয়ের দিকে আলোকপাত করা যায়। চলুন দেখে নিই কোন কোন ছোট ছোট জায়গায় মার খেয়ে নিজ ভূমিতে হারের শিউলি পাতার রস পান করল ভারত।
১. টস
বারবার টস জেতা ও তারপর ম্যাচ জেতায় সদ্যসমাপ্ত আসরেই অনেকবার কথা শুনতে হয়েছে ভারতের। টস নিয়ে কারসাজির অভিযোগের তীর নিক্ষেপ করেছেন অনেকে। কিন্তু তারাই ফাইনালে টস হেরে গেল। ফলে উইকেট, কন্ডিশন বিবেচনায় প্রকৃতির আশীর্বাদ পেয়ে যায় অস্ট্রেলিয়া।
এ ম্যাচের সব সিদ্ধান্তই গিয়েছে প্যাট কামিন্সের পক্ষে। শুরুর দিকে দিনের আলোতে পিচ ছিল স্লো, সেই সঙ্গে শুকনো। ফলে স্টার্ক-হেজলউড-কামিন্সদের বাউন্সারে নাকানি-চুবানি খেয়েছেন ভারতীয় ব্যাটাররা। আবার স্লো পিচের কারণে ফুলার লেংথ ডেলিভারি ও ইয়র্কারেও সহায়ক হয়েছে উইকেট। ফলে স্টার্কদের মতো অভিজ্ঞ বোলাররা ভারতীয় ব্যাটারদের ইচ্ছামতো খেলিয়েছেন।
আবার সন্ধ্যার পর শিশিরের উপস্থিতি আসতেই বদলেছে উইকেটের কন্ডিশন। ফলে স্টার্ক-হেজলউড-কামিন্সরা যা করতে পেরেছেন, শুরুতে তা দেখাতে পারলেও আস্তে আস্তে তা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন শামি-বুমরাহরা। ফলে পরে ব্রেকথ্রু আনতে যে টার্ন-বাউন্সারের প্রয়োজন ছিল ভারতের, তা আনতে ব্যর্থ হয়েছেন বোলাররা।
২. অতি রক্ষণাত্মক মনোভাব
শুরুর দিকে উইকেট হারানোয় অতি সাবধানী হয়ে গিয়েছিলেন ভারতের ব্যাটররা। ফলে শুরুর দিকে রানের গতি যেভাবে শ্লথ হয়ে গিয়েছে, পরে উইকেটের রক্তক্ষরণ বন্ধ করতে না পেরে ইনিংস টেনে লম্বা করতে পারেননি মিডল ও লোয়ার অর্ডারের ব্যাটাররা।
আজ দুই দফায় মোট ৩৫ ওভার বাউন্ডারি মারতে ব্যর্থ হয়েছেন ভারতীয় ব্যাটাররা। যেখানে টেস্টেও প্রতি ওভারে ৪/৫ করে রান তোলে দলটি, সেখানে ওয়ানডে বিশ্বকাপের ফাইনালের মতো ম্যাচে বল মাঠছাড়া করতেই ঘাম ছুটে গেছে তাদের। আবার বাউন্ডারির জন্য খুব চেষ্টা করতেও দেয়া যায়নি ভারতের ব্যাটারদের।
মহেন্দ্র সিং ধোনির মতো সিঙ্গেলসে দৃকপাত করলেও ‘মহেন্দ্র সিং’ না হওয়ায় নিয়মিত স্ট্রাইক রোটেট করতে ব্যর্থ হয়েছেন তারা। ফলে রানের চাকায় প্রথম দিকে যে মরিচা পড়া শুরু করে, সময়ের সঙ্গে তা কেবল প্রবল থেকে প্রবলতর হয়েছে।
৩. অস্ট্রেলিয়ার দুর্দান্ত ফিল্ডিং
ভারতের মতো ব্যাটারসমৃদ্ধ দলকে আড়াই শ’র আগে আটকাতে যে বিষয়টি বিশেষ ভূমিকা রেখেছে, তা অস্ট্রেলিয়ার প্রাণপণ ফিল্ডিং। যে ভুলে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে হেরে ফাইনালে উঠতে ব্যর্থ হয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকা, তা থেকে শিক্ষা নিয়েই যেন নিখুঁত ফিল্ডিংয়ের এক মনোমুগ্ধকর প্রদর্শনী চালালো অস্ট্রেলিয়া।
উইকেটের পেছনেও আজ যে ক’বার ক্যাচ গিয়েছে গ্লাভসবন্দি করতে একবারও ভুল করেননি জস ইংলিস। আবার সীমান্তে রোহিতের ক্যাচটি যেভাবে নিলেন ট্র্যাভিস হেড, তাতে মনে হচ্ছিল ওইটিই বিশ্বকাপ জয়ের একমাত্র চাবিকাঠি। ধারাভাষ্যকার ইয়ান স্মিথ তো তখন বলেই ফেলেছিলেন, ‘এটিই হতে পারে ম্যাচের টার্নিং পয়েন্ট।’
এই জায়গাতে আজ যথেষ্ট হতাশ করেছেন ভারতীয় ফিল্ডাররা।
৪. রোহিতের অধিনায়কত্ব
আজ বিশ্বকাপের ফাইনাল। অধিনায়ক হিসেবে আজকেই সব গুলিয়ে গেল রোহিতের! অথচ গত ম্যাচগুলোতে, বিশেষ করে, বোলিংয়ের সময় বিভিন্ন কৌশল কাজে লাগিয়ে প্রতিপক্ষকে নাস্তানাবুদ করেছেন তিনি।
ভারতের শুরু থেকে সবগুলো ম্যাচে জয়ের পেছনে স্থির মস্তিষ্কের রোহিতের অধিনায়কত্বের ছিল বিশেষ গুরুত্ব। সেমি ফাইনালেও তিনি অধিনায়ক হিসেবে তার প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। অথচ কাজের কাজ করার দিন তিনি সব ভুলে বসলেন।
ব্যাটিংয়ের সময়ও চাপের মুহূর্তে সূর্যকুমারকে আগে খেলিয়ে শেষে স্লগ ওভারগুলোতে জাদেজাকে খেলাতে পারতেন তিনি। এতে করে আরও অন্তত ২৫-৩০ রান বেশি তুলতে পারত ভারত। কিন্তু সেখানেও ব্যাটিং অর্ডার সাজাতে ব্যর্থ রোহিত।
৫. অনন্য ক্যাপ্টেন কামিন্স
রোহিত আজে যেখানে ব্যর্থ হয়েছেন, ঠিক সেখানেই কার্যকর ভূমিকা রেখেছেন ক্যাপ্টেন কামিন্স। টস জিতে আগে ভারতকে ব্যাটে পাঠানোর সিদ্ধান্ত ছিল তার। আহমেদাবাদের এই স্টেডিয়ামটি ব্যাটিংবান্ধব হলেও শিশিরের গতিবিধি সম্পর্কে সম্যক ধারণা নিয়ে এসেছিলেন কামিন্স, যার সুফল পেয়েছে অস্ট্রেলিয়া।
তাছাড়া রোহিতকে আউট করতে ‘ম্যাক্সি অস্ত্র’ কাজে লাগানোর বিষয়টি ছিল দেখার মতো। ওই সময় মারমুখী রোহিততে আউট করতেই যে তিনি ম্যাক্সওয়েলকে বোলিংয়ে আনেন, রোহিত আউট হওয়ার পর তার বডি ল্যাঙ্গুয়েজ দেখে তা স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছিল।
আবার প্রথম ইনিংসের শেষের দিকে যখন যাকে থামাতে হবে, তাতে যে অস্ত্র যেভাবে ব্যবহার করা দরকার, সেভাবেই করেছেন তিনি। ফলে উইকেটে থিতু হয়েও হাত খোলার আগে ফিরতে হয়েছে কোহলি-রাহুলকে।
৬. প্রত্যাশার চাপ
স্বগতিক দেশ ও টুর্নামেন্টের সবগুলো ম্যাচ জিতে নিজেদের স্ট্যান্ডার্ড অনেক উঁচুতে নিয়ে গিয়েছিল ভারত। ফাইনালে তার একটা চাপ থাকাটা খুবই স্বাভাবিক।
অন্যদিকে একপ্রকার খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে শেষ চারে আসা অস্ট্রেলিয়ার ব্যাপারটি ছিল অন্যরকম। সেমিতে হারলেও সম্মানের সঙ্গে দেশে ফিরতে পারত তারা। কারণ অদম্য মনোবল ও টিকে থাকার মানসিকতা দিয়ে শেষ চারে উঠে এমনিতেই তারা প্রত্যাশার চেয়ে বেশি কিছু দিয়ে দিয়েছিল ভক্তদের। ফলে ওই চাপ তাদের গ্রাস করতে পারেনি।
আর ১ লাখ ৩০ হাজার কণ্ঠের জয়ধ্বনিতে নুব্জ হয়ে পড়েছেন রোহিত-কোহলিরা। শেষে যখন গ্যালারি নিস্তব্ধ হয়ে আসছিল, তখন ব্রেকথ্রু আনার শেষ মনোবলটুকুও নিঃশেষ হয়ে যায় ভারতের। ফলে চাপে এক প্রকার বিকল হয়ে গিয়ে গন্তব্যের আগেই থেমেছে ভারতের জয়রথ।
৭. অভিজ্ঞতা
অস্ট্রেলিয়া ও ভারত- দলদুটির মধ্যে আজ যে বিষয়টি চোখে লেগেছে, তা অভিজ্ঞতা। অভিজ্ঞতার পার্থক্যের কারণেই ম্যাচে এগিয়ে গিয়েছে এক দল, অন্য দল পিছিয়ে গিয়েছে আস্তে আস্তে।
অস্ট্রেলিয়ার এই টিমের সামর্থ্য ও অভিজ্ঞতার বিবেচনা যদি করা হয় তাহলে দেখা যাবে, কী নেই তাদের! পাওয়ার প্লেতে রানের বন্যা বইয়ে দিতে অভিজ্ঞ মারকুটে ব্যাটার। বিপর্যয় সামাল দিতে টেস্ট খেলুড়ে ব্যাটার, মিডল অর্ডারে ধারাবাহিক রান তোলা ধীরস্থির ব্যাটার, লোয়ার অর্ডারে চার-ছক্কা হাঁকানোর মতো লম্বা-চওড়া হাত ও দক্ষতাসম্পন্ন ব্যাটার।
আবার বোলিংয়ে যেমন রয়েছে বিশ্বসেরা গতিদানবরা, তেমনই রয়েছে সেরা স্পিনার। বিকল্প বোলার হিসেবে গ্লেন ম্যাক্সওয়েল-ট্র্যাভিস হেডরা বল হাতে যা করতে পারেন, বিরাট কোহলি তা করতে পারেন না।
অন্যদিকে ভারতের ব্যাটিং লাইন আপে প্রথম সাতজনের চারজনই তরুণ। এত বড় ম্যাচের চাপ ও অস্ট্রেলিয়ার বোলিং প্রতাপ সামলে মাথা ঠণ্ডা রাখার অভিজ্ঞতা তাদের এখনও হয়নি। যার ফল দেখা গেছে ফাইনাল ম্যাচে। রক্ষণাত্মক হতে গিয়ে রান তুলতে ব্যর্থ হয়েছেন, আবার হাত খুলতে গিয়ে আউট হয়েছেন। অজি বোলারদের মাইন্ড রিড করতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছেন রাহুল-গিল-শ্রেয়াস, এমনকি সূর্যকুমারও।
ব্যাট হাতে নেমে এখানে পার্থক্য গড়ে দিয়েছেন হেড ও লেবুশেন। দুজনই টেস্টের খেলোয়াড়। ফলে বিপর্যয় কীভাবে মোকাবিলা করতে হয়, তা নিয়ে তাদের পরামর্শের প্রয়োজন হয়নি।
আফগানদের বিপক্ষে ম্যাক্সওয়েলের সেই অতিমানবীয় ইনিংসটিও এখানে গণ্য। সাত-আটে নামা ম্যাক্সওয়েলের কাজ মূলত শেষদিকে রানের গতি বাড়ানো। তা হলেও তিনি যে যথেষ্ট ধৈর্যধারণে পারদর্শী, তা নিয়ে এখন আর বোধহয় কেউ তর্কে জড়াবেন না।
সব মিলিয়ে পরিবেশ, প্রকৃতি, ভাগ্য, অভিজ্ঞতা, দক্ষতা- সবকিছু যেখানে আজ অস্ট্রেলিয়াকে বরদান দিয়েছে, সেখানে উক্ত সব বিভাগেই বঞ্চিত হয়ে বারংবার দিশেহারা হয়েছে ভারত। তাই ফাইনালে সেরা পারফর্ম্যান্স প্রদর্শন করে শিরোপা মাথায় করে নেচেছেন অজিরা, আর বাজে পারফরম্যান্সের চক্রে দেহ-মন ছিন্নভিন্ন হয়েছে ভারতীয়দের।