চারদিক ডেস্ক
ঈদের আগে বেতন-বোনাস নিয়ে ৪১৬টি তৈরি পোশাক কারখানায় অস্থিরতা দেখা দিতে পারে। শিল্পাঞ্চলের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিট শিল্প পুলিশের এক প্রতিবেদনে এই চিত্র উঠে এসেছে।
মালিকেরা বলছেন, এবার তিনটি কারণে সঙ্কট হতে পারে। এরমধ্যে আছে প্রথমত, গত দেড় বছরে অর্ডার অনেক কমে গেছে। এখন কারখানাগুলো সক্ষমতার ৫০ থেকে ৬০ ভাগ উৎপাদনে রয়েছে। ফলে মালিকদের ভর্তুকি দিয়ে প্রতিষ্ঠান চালাতে হচ্ছে। দ্বিতীয়, ব্যাংকগুলো গার্মেন্ট মালিকদের সহযোগিতা করছে না। আর তৃতীয়ত, কাস্টমসের অহেতুক ঝামেলার কারণে শিপমেন্টের সময় ফেল করছেন তারা। সাত থেকে ১০ দিন মাল ফেলে রাখছে। এর ফলে ঠিকমতো টাকাও আসছে না।
তৈরি পোশাক শিল্পে বিজিএমইএর কারখানা রয়েছে এক হাজার ৫৮৯টি, বিকেএমইএর ৬২৮টি, বিটিএমএর ৩৫৬টি, বেপজার ৩৮৩টি ও অন্য কারখানা রয়েছে ৬৫১টি। এসব কারখানা থেকে তথ্য সংগ্রহ করে প্রতিবেদন তৈরি করেছে শিল্প পুলিশ।
তাদের তথ্যানুযায়ী, ঈদের আগে বেতন না হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে ১৩১টি কারখানায়। বোনাস না হতে পারে ১০৮টি, বেতন-বোনাস দুটিই না হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে ১৭৭টিতে। সব মিলিয়ে সঙ্কট হতে পারে এমন কারখার সংখ্যা ৪১৬টি। উদ্বুত পরিস্থিতিতে সোমবার বিজিএমইএ, বিকেএমইএ, বিটিএমএর নেতৃবৃন্দ এবং বেপজা, কলকারখানা অধিদপ্তর, শ্রম অধিদফতরের প্রতিনিধিদের নিয়ে বৈঠকে বসেছিল শিল্প পুলিশ। সেখানেও আলোচনায় এই সঙ্কটগুলো উঠে এসেছে।
জানতে চাইলে শিল্প পুলিশের প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি মো: মাহাবুবুর রহমান বলেন, ‘আমরা তো মালিকদের নির্দেশনা দিতে পারি না, অনুরোধ করেছি। আমরা একটি তালিকা করেছি, সেখানে যেসব ফ্যাক্টরিতে সঙ্কট হতে পারে সেগুলো তাদের জানিয়েছি।
মালিকেরা বলেছেন, শ্রমিকদের বেতন এবং ভাতা ঈদের আগে তারা পরিশোধ করবেন। অধিকাংশ কারখানাই যথাসময়ে পরিশোধ করতে সক্ষম হবে। তবে কেউ কেউ ব্যর্থ হতে পারেন। নানা সঙ্কটের কারণে অতীতে যারা কখনো ব্যর্থ হয়নি তারাও এবার তাদের সঙ্কট হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আমরা তাদের বিকল্প উপায়ে বেতন-বোনাস পরিশোধের জন্য বলেছি।
পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন,‘আমরা যে তালিকাটি করেছি, সেখানে কিছু প্রতিষ্ঠান শ্রমিকদের বেতন ভাতা না দিয়েই বন্ধ করে দিয়েছে। আবার ফেব্রুয়ারির বেতন মার্চে হওয়া কথা। এখনো কিছু কারখানায় শ্রমিকেরা ফেব্রুয়ারির বেতন পাননি। মার্চের বেতন এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে হওয়ার কথা। এবার যেহেতু ঈদ হচ্ছে তাই আমরা বলেছি, বোনাস যেন এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে দিয়ে দেওয়া হয় এবং মার্চ মাসের বেতন যেন ঈদের ছুটির আগেই পরিশোধ করা হয়। মালিক ও শ্রমিকদের বোঝাপড়ার ভিত্তিতে ঈদের ছুটি নির্ধারণ করা হবে। ঈদের আগে শ্রমিকদের বেতন-ভাতাকে কেন্দ্র করে কোনো অপশক্তি যেন আইনশৃঙ্খলা অবনতি ঘটাতে না পারে, সে বিষয়েও গোয়েন্দা কার্যক্রম বৃদ্ধি করা হয়েছে।’
শিল্প পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীর উপকণ্ঠে তিন পাশে শিল্পাঞ্চল রয়েছে। এই পথ ধরেই ঈদে ঘরমুখী মানুষ গ্রামে যাবেন। ঈদের আগে বেতন-বোনাস পরিশোধ না করলে শ্রমিকদের মধ্যে অসন্তোষ তৈরি হবে। এতে করে সড়ক অবরোধসহ সহিংসতা হতে পারে। শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দিলে দুর্ভোগে পড়তে হবে ঘরমুখো মানুষকে।
বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম ডয়চে ভেলেকে বলেন,‘শিল্প পুলিশ যে তালিকা দিয়েছে, আমার ধারণা সঙ্কটের আশঙ্কা আছে আরো বেশি কারখানায়। এখন পর্যন্ত যে আমরা এই সেক্টর টিকিয়ে রেখেছি, সেটাই বড় ব্যাপার। প্রথমত, ১২ টাকার গ্যাসের দাম হয়েছে ৩০ টাকা। বিদ্যুতের দামও বেড়েছে। ৫৬ শতাংশ বেড়েছে শ্রমিকদের বেতনও। এর মধ্যে গত দেড় বছরে রফতানি আদেশ কম এসেছে। যাও এসেছে সেগুলো সময়মতো ডেলিভারি করা যাচ্ছে না। কারণ বেশি দাম দিয়েও গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে না। এখন প্রতিটি কারখানা সক্ষমতার ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ উৎপাদনে আছে। কোনো কারখানা যদি সক্ষমতার ৮০ শতাংশের বেশি উৎপাদনে না থাকে তাহলে কোনোভাবেই প্রতিষ্ঠান লাভজনক হবে না।’
আর কী ধরনের সঙ্কট আছে? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ব্যাংকগুলো আমাদের সহযোগিতা করছে না। আমাদের নগদ প্রণোদনা বাবদ সরকার থেকে সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা পাওনা রয়েছে। ঈদের আগে এই টাকা পাব কিনা জানি না। এটা না পেলে বহু কারখানা বিপদে পড়বে। আমি নিজে অর্থ মন্ত্রণালয়ে কথা বলেছি। কাস্টমসের হয়রানি তো আছেই। বিনা কারণে তারা শিপমেন্ট পিছিয়ে দিচ্ছে। আবার বায়ররাও অনৈতিক সুবিধা নিচ্ছে। পণ্য সেখানে পৌঁছানোর পর তারা খালাস করছে না। দাবি করছে, দুই মাস পর টাকা দেবে, এই শর্তে তারা পণ্য খালাস করবে। বাধ্য হয়ে আমাদের তাদের সেসব শর্ত মেনে নিতে হচ্ছে।’
শিল্প পুলিশের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় চার হাজারের মতো গার্মেন্ট কারখানা রয়েছে। এতে প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক কাজ করেন। এই খাতে উৎপাদিত পোশাক বিশ্বের প্রায় ১৬৭টি দেশে রফতানি হয়। ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে প্রায় পাঁচ হাজার ৫৫৬ কোটি ডলারের পণ্য রফতানি হয়েছে। এরমধ্যে পোশাক রফতানি হয়েছে প্রায় চার হাজার ৬৯৯ কোটি ডলার মূল্যমানের, যা রফতানি আয়ের শতকরা ৮৪ দশমিক ৫৭ শতাংশ। ফলে এ খাতে বিশৃঙ্খলা-সৃষ্টি করে বিধি নিষেধ আরোপ করানো গেলে সরকার অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। দেশ বিরোধী একটি শক্তি দেশকে অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করার চেষ্টা করছে।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে অতিরিক্ত আইজিপি মো: মাহাবুবর রহমান বলেন, ‘আমরা সতর্ক অবস্থায় আছি। সমাধানের চেষ্টা করছি। কেউ অযাচিত হস্তক্ষেপ করে ঝামেলা সৃষ্টি করতে পারবে না।’
বিজিএমইএ’র নবনির্বাচিত কমিটির পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, ‘শিল্প পুলিশের প্রতিবেদনটি আমরা দেখেছি। এরমধ্যে বিজিএমইএ’র সদস্য আছে ১৩১টি কারখানা। আমরা এর আগেও এসব সমস্যার সামাধান করেছি। এবারো হয়ে যাবে। আমরা বিজিএমইএ থেকে একটি মনিটরিং কমিটি করেছি, তারাও প্রতিনিয়ত পর্যবেক্ষণ করবেন। শেষ মুহূর্তে যে কারখানাগুলো সমস্যা থাকবে, আমরা সেগুলো সমাধান করে ফেলব।’
বিএমএমইএ’র সাবেক সহ-সভাপতি এ বি এম শামসুদ্দিন বলেন, ‘এখন যে সঙ্কটগুলো দেখা যাচ্ছে, এগুলো এলে হতো না যদি আমরা সাংগঠনিকভাবে ব্যবস্থা নিতে পারতাম। একটা উদাহরণ দিয়ে বলি, আগের এলসির টাকা না আসা পর্যন্ত ব্যাংকগুলো নতুন এলসি খুলতে দিচ্ছে না। ওই টাকা হয়ত পাইপলাইনে আছে। কয়েকদিনের মধ্যেই চলে আসবে। এখানে সংগঠন থেকে যদি দায়িত্ব নিয়ে ব্যাংকের সাথে কথা বলে তাহলে সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। আবার ছোট ছোট ফ্যাক্টরিগুলোর সমস্যা ট্রেডবডির নেতারা গুরুত্বের সাথে নেন না। কারণ তাদের ফ্যাক্টরিগুলো বড়। সরকারের উচ্চ মহলে তাদের যোগাযোগ আছে। আবার সরকার আমাদের যে সুবিধা দিয়ে চায়, সেটাও আমরা নিতে পারছি না, নেতৃত্বে দুর্বলতার কারণে। এগুলো যদি কাটিয়ে উঠা যায় তাহলে এসব সঙ্কটের কিছুই আর থাকবে না।’
সূত্র : ডয়চে ভেলে