Friday, December 27, 2024

কোব্বাদ ও একটি শাদা বিড়াল

সাগর রহমান

শেষ.

একটা অতি মৃদু খচ্খচে শব্দে আমার ঘুম ভাঙল। খচ্খচে কিংবা সড়্সড় শব্দ। আধো ঘুমে চোখ মেলতে গিয়ে বুঝলাম শব্দটা আসছে আমার হাতের ভিতর থেকে। দু‘হাতের দশটা আঙুলের গোড়ার একটা তীক্ষ্ণ অনুভূতি হতে আসছে অতি মৃদু ঐ খচ্খচে কিংবা সড়্সড়ে শব্দটি। আমি দু‘হাত শরীর বরাবর টেনে আনার চেষ্টা করলাম। আমার নখগুলো ঘসা খেতে লাগল বিছানার চাদর বরাবর এবং খচ্খচে শব্দটি কয়েকগুন বেড়ে চড়্চড় শব্দে পরিণত হল। আমি বুঝতে পারলাম, আমার নখের ধারে চিড়ে যাচ্ছে মোটা চাইনীজ বেড কাভার।

ঠিক তখনি আমি স্বপ্ন থেকে জেগে উঠতে উঠতে ভাবলাম, খুব ভাল হতো যদি কোব্বাদের সংগে পুনরায় দেখা না হতো আরো ত্রিশ বছর, পয়ঁতাল্লিশ বছর, ষাট বছর বা কখনোই।

শুরু.

কোব্বাদ আমার ন্যাঙটা কালের বন্ধু। কোব্বাদের সংগে আমার দেখা দীর্ঘ পনের বছর পর। ন্যাঙটা কালের বন্ধুদের সাথে একেবারে যোগাযোগহীন  ছাড়াছাড়ি হয়ে গেলে এবং এরকম বহু বহু বছর পর দেখা হলে যেসব সলজ্জ অপরিচিতির অপরাধবোধ অথবা আড়ষ্টতা দেয়াল হয়ে দাঁড়ায়, আমি তাদেরকে দ্রম্নত পাশ কাটাতে চেয়ে কোব্বাদের দিকে হ্যান্ডশ্যাক করতে হাত বাড়িয়ে দিলাম। কিন্তু কোব্বাদ আমার হাত কে সরিয়ে দিয়ে কোলাকুলি করতে চাইল। অগত্যা আমরা কোলাকুলি করলাম এবং কোব্বাদের বাম কাঁধ হতে ডান কাঁধে যেতে যেতে আমার মনে পড়লো ছোটবেলায় একবার কোব্বাদের সংগে  ঝগড়া হবার পর বানানো ছড়াটি, কোব্বাদ গোব্বাদ, জীবন তোর বরবাদ।

কোলাকুলি হয়ে যাবার পর স্বভাবতঃই আশংকা ছিলো কোব্বাদের বাক্য শুরম্ন হবে তুঁই ত অহন বহুত বড় মাইনষ, বিদাশী হইয়া গেছ ইত্যকার বাক্য দিয়ে, যে ধরনের কথা আমি শুনে আসছি এবার এত বছর পর গ্রামে ফিরে নানা জনের কাছ থেকে। কিন্তু কোব্বাদ সে সবের ধারে কাছে না গিয়ে ছায়েদ নামক কাউকে ডাকল, ওরে ছাইদ্দা, মিলে যাই বলি আস্, আমার যাইতে দেরী হইব।

যাকে আমরা ছোটবেলায় ডাকতাম কোব্বাইদ্যাদের মিল, তা তার ঘরের পাশেই। কাঠ চেরাইয়ের শব্দ ভেসে আসছে একটানা। ছোটবেলায় এই মিল ছিল আমাদের পলানতি টুক টুক খেলার মূল জায়গা। বিশাল বিশাল কাঠের গুঁড়ির মধ্যে একবার লুকিয়ে গেলে খুঁজে পাওয়া প্রায় অসম্ভব। আর কাঠ গুলো থেকে একটা প্রাচীন গন্ধ উঠে আসতো, যা এখানে এসেই বার কয়েক নাক টেনে টের পেলাম, এখনো আছে। কোব্বাদের আব্বা আমাদের বকা দিয়ে বলতো, মিলের চাক্কুর তলে হান্দাবিরে পোলাপাইন, চাক্কুর তলে হান্দাবি।

কোব্বাদের আব্বার জায়গায় কোব্বাদ এখন সেই মিলের মালিক। জিজ্ঞেস করলাম, ব্যবসা কেমন?  কোব্বাদ চেয়ার টেনে আমাকে বসতে দিয়ে বলে, আছে , খারাপ ন। তুঁই বইও, আসতে আছি। বলে কোব্বাদ আমাকে রেখে ঘরের ভিতরে  ঢোকে। আমার মনে পড়ে, স্কুলের পড়ার বইয়ের গল্পের বাইরেও যে নারী পুরুষ সংক্রান্ত আরেক ধরনের গল্প আছে পৃথিবীতে, তা আমি এবং আমরা প্রথম শুনেছিলাম এই কোব্বাদের মুখে। শুনে আমাদের সেই প্রাইমারী বয়স লজ্জায় অবিশ্বাসে কেমন ভীতু আগ্রহে কোব্বাদ‘কে দেখতে শুরম্ন করেছিলাম একই সংগে সমীহ এবং দুষ্টু পোলা হিসেবে। কোব্বাদ একটা গল্প শেষ করে বলতো, আরো আছে। কাউরে আবার কই দিস না যেন। এই গুলা গোপন গল্প। গোপন গল্প শুনে আমাদের কান ঝাঁ ঝাঁ করত। ঠিক করতাম, কোব্বাদের সংগে আর মিশব না। কিন্তু কেমন করে করে যেন কোব্বাদ ছাড়া আমাদের একটা দিনও কাটেনি, কাটত না। পৃথিবীতে কোব্বাদের চেয়ে আর কারও মাথায় দুষ্টুমির এত বুদ্ধি খেলত না, তা ছিল আমাদের বদ্ধ মূল ধারণা। কোব্বাদ ছিল তাই আমাদের এক ধরণের সর্দার, যে অবলীলায় জানতো, কিভাবে একটা কিছু না করার মত বিকেল কে উত্তেজক কোন বিকেলে পরিণত করা যায়।

আমি হয়তো এরকম হাবি জাবি ছোটবেলার কথা ভাবতেই থাকতাম, কোব্বাদ হঠাৎ পিছন থেকে এসে বললো, দো¯ত্ম, বাজারের চা খাওয়ান লাগব তোমারে। তুঁই তো জানো, আমি একলা মাইনষ।

আমার মনে পড়ল কবে যেন শুনেছিলাম কোব্বাদ বিয়ে করেছিল। তবে? কিন্তু সে কথা জিজ্ঞেস করার আগেই আমি হঠাৎ খেয়াল করলাম কোব্বাদের দুই হাতে গস্নাভস পরা। ভাবলাম, এটা বোধহয় কোন স্টাইল কোব্বাদের। বিচিত্র জিনিস করার ব্যাপারে কোব্বাদের আগ্রহ এখনও আছে মনে হয়। কোব্বাদ আমার মনের কথা বুঝে ফেললো। বললো, দোস্ত, আমার ব্যাপারে তোমারে কেউ কিছু কয় নাই?

আমি বললাম, তোমার ব্যাপারে? কই নাতো। তার ওপর আসলাম তো কাল রাতে। তোমার ব্যাপারে কিছু কওনের আছে নাকি?

কোব্বাদ কে মনে হল যেন কেউ তার ব্যাপারে কিছু আমাকে বলে নাই বলে সে হতাশ। বললে, আইচ্ছা, আইচ্ছা, খাড়াও আমিই কইতাছি। আমার এত বড় ঘটনা আর আমার ছোড কালের দোস্ত অইয়া তুমি জানবা না, এইটা কেমনে অয়। তার ওপর শুনছি তুঁই গল্প কবিতা লেখ। আমার ঘটনা শুইনা দেখ একটা গল্প লেইখাও ফেলতে পার।

বলে হাসতে হাসতে কোব্বাদ আমার দিকে তাকিয়ে চোখ টিপ দিল। আমিও হাসলাম। কিন্তু আমার নজর তখনও তার হাতের গস্নাভসের দিকে।     কোব্বাদ আমাকে আস্বস্ত করার ভঙিতে বলল, বুঝছি, তোমার মনে প্রশ্ন আমি হাতে মোজা পরে আছি কেন? হেই গল্পই তোমারে বলব এখন।

 

আমি অত্যন্ত আগ্রহে ভরেই কোব্বাদের গল্পের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। কোব্বাদ আবারও উঠে গিয়ে কাকে যেন তার মিলের ব্যাপারে একগাদা নির্দেশ দিয়ে এসে আমার পাশের চেয়ারে বসল। তারপর একটু চুপ করে থেকে হঠাৎ করেই বলতে শুরু করল।

আমি ছোটবেলা থেকেই জানি, কোব্বাদ খুব সুন্দর করে যে কোন সাধারণ ঘটনাকেও অসাধারণ করে বলতে পারে। আমি খানিকক্ষনের মধ্যেই কোব্বাদের গল্পের মধ্যে ডুবে গেলাম।

কোব্বাদ বলতে লাগল, তখন নয়া বিয়া করছি। কুলসুম’রে তুমি চিনতাই। ঐ যে উত্তর বাড়ীর মজনু কাকার ভাইগ্নি। ভাব-ভালবাসার বিয়ে। রাইতে বাড়ীত আইসবার পথে চানাচুর বাদাম লইয়া আইতাম নতুন বউয়ের লাগি। রাইত জাইগা খাইতাম আর দুইজনে মিল্যা গল্প গুজব করতাম। তার আবার পেভারিট আছিলো বাতাসা। কিন্তু তুঁইতো জানো, আংগো ছোট্ট বাজারে বাতাসা সবসময় পাওন যায় না।

একদিন মিলের কামে বড় বাজারে গেছি, আসতে আসতে রাইত হইয়া গেছে। বড় বাজার তনে কিনছি দুই সের বাতাসা। একদম গরম, ভাঁপ উড়ে এমন অবস্থা। দোস্ত রে কই, বউয়ের প্রিয় জিনিস কিনি আনি ভাইবলাম একটু পলাপলি খেলি। ঘরে আসি বাতাসার ঢোঙাটারে লুকাইলাম দরজার দেরাজের পিছনে। কুলসুমা গেছে উত্তর বাড়ীতে। এইরকম আমার বাড়িত আসতে রাইত বেশী অইলে কুলসুমে যাইত মজনু কাকাগো বাড়ীত। একলা একলা বেচারী আর কিই বা কইরব, ক? তো আমি তারে আনতে গেছি। মজনু কাকা ধইরল ভাত খাই আসনের লাগি। খাইলাম। আইসতে আইসতে ম্যালা রাইত।

ঘরে ঢুকিই দেই বাতাসার গন্ধে চাইরদিক ম্ ম্ করতেছে। গন্ধ পাই তো কুলসুমে খুশিতে আষ্টেখান। বুইজলাম লুকাইতে পাইরলাম না। লাইট জ্বালাই দেখি, সারা ঘরে বিছানায় মাটির উপরে খালি বাতাসার টুকরা। কুলসুমে দিল চিৎকার, খাইছে , কালা বিলাইর কাম রে, কালা বিলাইর কাম। আমার মনের অবস্থা তোঁমারে আর কি কমু। শুধু জিগাইলাম, কি কালাই বিলাই। তুঁই ত জানো, কুত্তা বিলাই এগুলো আমি জীবনেও পছন্দ কইরতাম না। আমার ঘরের আশ পাশ দিয়াও কোন কুত্তা বিলাই হাঁটতে দিতাম না।  কুলসুমে কইল, গতকাইল হইতে কত্থেইক্যা কালা বিলাই একটা ঘরে আসে। আমি যে কত বার দৌড়াই দিনের মইধ্যে। কার বাড়ির বাড়ির বিড়াল কে জানে।

সংগে সংগে ঠিক করলাম, যার বিলাই-ই হোক, বিলাই টারে মারি ফালামু, আলস্নায় যা করে। ছোট বেলায় বিলাই মারছিলাম একবার, তোঁর মনে আছে নি? ঐ যে ডাকতর বাড়ীর বিলাই। মার বাড়া ভাতের থেইকা মাছ নিয়া দিছে দৌড়। আমিও গেছি মুগুর লইয়া পিছে পিছে। এক বাড়ীত কাম শেষ। এইটা লই ডাক্তাররা পরে বহুত ঝামেলা করছিলো, তোঁর মনে হয় মনে নাই।

যাই হোক, ঘটনা সংড়্গপে করি। বউ আমারে বহুত বোঝাইল। কিন্তু আমার মনের জিদ যে চাইপছে। দুই দিন আমি কাম কাইজ ফালাই বিলাইটারে ধরার জন্যে তক্কে তক্কে থাকলাম। দ্বিতীয় দিন সন্ধ্যায় বাতাসের টুকরার লোভ দেখাই দেখাই ধরলাম। ধরি দিলাম ছোড করি এক আছাড়। হারামজাদা বড় বড় নখ দিয়া দিল আমার হাতের মধ্যে আঁচড়াই। একদম রক্ত বার করি ফালাইলো। বউ আসি আমারে কয় , ছাড়ি দেন। ছাড়ি দেন। ছাড়ি আমি দিতাম। কিন্তু রক্ত দেই মাথা মুথা গেছে আমার পুরা খারাপ হই। বিলাইরে শক্ত কইরা ধরি ঘরের থেইক্যা বাইর অইলাম। মেলে গেলাম। মেশিনে চড়ানো আছিলো তিন নম্বরী বেস্নড। ডাইরেক্ট বেস্নডের মধ্যে ধইরলাম হারামজাদার চার পায়ের নখ, সবগুলারে কিলিন করি দিলাম গোড়ার তন কাটি। জবাই করি দেওন দরকার আছিল। তোমার ভাবির কতা ভাবি কইরলাম না। যা বিলাইর বাইচ্ছা বিলাই, এবার চরি-বরি খা।

এই ঘটনার পর তিনদিন রাগ করি তোমার ভাবি আমার লগে কতা রাখছে বন্ধ। মাইয়া মাইনষের মন তো বুঝই। যাই হোক। পোলাপাইনে বিলাইরে বস্তায় বান্দি দূরে ফালাই দিয়া আসছে। আমার মনে আসলো শান্তি। কুত্তা বিলাইরে আল্লা কি লাগি বানাইছে, আল্লাই জানে। কিন্তু আমার মনের শান্তি সাতদিনও টিকে নি, সেই কথাই তোমারে এখন কই।

এমন সময় সম্ভবত ছাইদ্দা নামের লোকটা ফ্লাস্কে করে চা আর নোনতা বিস্কুট নিয়ে ঢুকল। কোব্বাদ কথা থামিয়ে আমাকে কাপে চা ঢালতে ঢালতে বললো, দোস্ত, সহজে কোন কথা আমি শেষ কইরতে পারি না তুমি তো জানো। তুঁই আবার বিরক্ত হইতেছ না তো।

ভাবলাম, কোন কালেই কোব্বাদ দুই কথায় মূল গল্প শেষ করতে পারতো না। সে তুলনায় আজকে বেশ দ্রম্নতই বলছে। আমার উত্তরের জন্য কোব্বাদ অপেড়্গা করলো না। নোনতা বিস্কুট আমার হাতে তুলে দিয়ে নিজে একটাতে সশব্দ কামড় দিয়ে বললো, ছাইদ্দা , তুই যা। যা হোক দোস্ত , তারপর আসল ঘটনা তোমারে কই। গেরামের মাইনষ রে এসব গল্প কইয়া আরাম পাই না। বিষয়টাই বোঝে না। খাও খাও। চা টায় চুমুক দেও। মনা মিয়ার চা, দুই ঘন্টা দুধ জ্বাল দেয়া না হইলে মনা চা বেচে না। কয়, মনার চা খাইয়া কেউ খারাপ কইলে মনা নিজে জীবনে আর চা খাইব না। সকাল বিকাল মিয়া বাড়ির দীঘির তনে ডুব দিয়া দুই ঢোক পানি খাইয়া থাকব সারাজীবন। হা হা হা। মাথায় ছিট আছে মনার, বুইজলা না।

চোখ টিপে বলে কোব্বাদ। চুমুক দিলাম চায়ে। আসলেই স্পেশাল কিছু। এত ঘন মালাই যেন ক্রিম দিয়ে বানানো। পর পর দু’চুমুক দিয়ে ফেললাম। কিন্তু তারপরও পেটের মধ্যে কেমন যেন লাগছে। কোব্বাদের বিভৎস গল্পের কারণেই মনে হয়। কিন্তু কোব্বাদের বলার ভঙ্গিতে মনে হল, বিড়াল নিয়ে তার এসব কর্মকান্ড যেন খুব স্বাভাবিক। মনে হচ্ছে, মনার না, কোব্বাদের মাথায়ই কি ছিট আছে?

খেলা তার বাদে কেমন জমল হুন দোস্ত। বিলাইর ঘটনার পর সপ্তাহ খানেক গেছে। দিন হইল গিয়া বিষ্যুদবার। সারাদিন বড় দৌড় ঝাঁপ গেছে মিলে। তার ওপর বড়বাজারের হাটের দিন। আসতে আসতে গেল রাত হইয়া। বাজার তনে আসার সময় বাতাসা আনলাম। তোমার ভাবী প্রথমে খাইব না খাইব না করল কিছুক্ষন। হের অভিমান তখনও যায় নাই। যাই হোক পরে বুঝাইয়া সুঝাইয়া পেট ভইরা দুইজনে বাতাসা খাইলাম। ঘুমাইলাম একটু রাত কইরা।

ঘুমাই আছি। হঠাৎ কেমন যেন খচ্খচানির শব্দে আমার ঘুম গেল চটকে। আমার আবার সহজে ঘুম ভাঙে না, ঘুমাই মরার মত। রাত বিরাতে সামান্য শব্দে ঘুম ভাঙার বান্দা আমি না। কিন্তু ঘুম ভাঙল। বুঝলাম না ক্যান! চোখ মেইল্যা বিনা কারণেই উইঠা বসলাম। ঘরের বাত্তি জ্বালাইয়া আমি ঘুমাইতে পারি না। তাই ঘর থাকে অন্ধকার। একটা বাত্তি জ্বলে বাগানে। বাগানের বাত্তির হালকা আলো আসে ঘরে। সে আবছা আলোতে দেখি ড্রেসিং টেবিলের সামনে একটা বিলাই বইসা আছে। শাদা রঙের বিলাই। আমি ভালো কইরা নজর কইরা দেখি শো কেসের সামনে বইসা তোমার ভাবীর নেইল কাটার দিয়া হে একটা একটা কইরা নখ কাটতেছে, নখ কাটার কুট্টুস কইরা শব্দ হইতাছে, বিশ্বাস কর দো¯ত্ম কাটা নখের মেঝে তে টুপ কইরা পড়ার শব্দ পর্যন্ত আমি শুনলাম। হঠাৎ করে বিলাইটা আমার দিকে ফিরে তাকাল। দুইটা ধক্ ধক্ কইরা জ্বলা চোখ দেখলাম, তারপর কিছুড়্গনের লাইগা আমার আর কিছু মনে নাই।

শুধু এরপর মনে আছে তোমার ভাবী আমার হাত ধইরা চিলস্নাইয়া কইতাছে, এ্যই, এ্যই, হুশ হুশ কর ক্যান? কই, বিলাই কই। কি কর? এই সব কতা বার্তা কানে আসতে আসতে আমি হুঁশে আইলাম খানিকটা। পরে তোমার ভাবীর মুখে শুনছি, আমি নাকি জোরে জোরে – হুশ, হুশ, যা, যা, বিলাইর বাইচ্চা বিলাই – এই সব কইতে ছিলাম। সারা ঘর তন্ন তন্ন কইরা দুইজনে মিইল্যা খুঁজলাম, কিন্তু বিলাইয়ের কোন নাম উদ্দেশ পাইলাম না।

তোমার ভাবী আমারে বুঝানোর চেষ্টা নিল, কয়, আমি নাকি স্বপ্নে দেইখছি। আমি কইলাম, বিশ্বাস কর, আমি নিজ চোখে দেখছি, হেই বিলাইটা। তোমার ভাবী কইল, হেইটা তো কালা আছিল। তুমি তো শাদা একটা চোখে দেখছো? ভাইবলাম, তাইতো।

কতা সত্য। কিন্তু এমন জ্যাšত্ম স্বপ্ন কেউ দেখে ভাইব্যা তব্দা খাইয়া গেলাম। যাই হোক, আয়াতুল কুরসী পইড়া আমার বুকে তোমার ভাবী ফুঁ দিল, তারপর আমরা লাইট নিভাইয়া ঘুমাইতে গেলাম। আমার কেমন কেমন জানি একটু ভয় লাগতেছিলো, তোমার ভাবীর হাত ধইরা রাইখতে গেলাম। সংগে সংগে সে উফ্ কইরা উঠল। আমি কইলাম, কি অইছে। সে কইল, ব্যথা পাইছি। তুমি খোঁচা দিছ ক্যান? আমি কইলাম, খোঁচা দিলাম কই? সে কইল, দিলা তো তোমার নখ দিয়া, দেখি, তোমার নখ দেখি। আমি কইলাম, দেখ।

হের বাদে তোমারে কই দোস্ত, হে আমার হাতের নখ পরীড়্গা কইরা প্রায় চিলস্নাইয়া উঠল, ও মাগো, এমন খবিশের মত নখ অইছে তোমার। নখ কাটো না কয় হপ্তা ধইরা তুমি? আমি  নিজেও তখন আমার নখ দেইখা ভিরমি খাইবার জোগাড়। এইটা ঠিক, নিয়ম কইরা নখ কাটা আমার স্বভাবে নাই। তাই বইলা প্রায় এক ইঞ্চি লম্বা নখ রাখার তো প্রশ্নই আসে না। তোমার ভাবী আমারে আরো কিছু বকাবকি কইরা লাইট জ্বালাইয়া নেইল কাটার নিয়া বসল। বিশ্বাস কর দোস্ত, বিলাইরে আমি ঠিক এই নেইল কাটারটা দিয়াই নখ কাটতে দেখছি। যাই হোক, কিছু আর কইলাম না। হের সামনে হাত মেইলা বসলাম। আসলেই, এত বড় বড় নখ অইছে, মনে হয় কমসে কম তিন মাস নখ কাটি নাই। মনে করার চেষ্টা করেও লাস্ট কবে নখ কাটছিলাম মনে করতে পারলাম না। এমন ডাইনীর নখের মত নখ রাখছো ক্যান, এই গুলা লইয়া ভাত খাও কেমনে… এইসব হাবি জাবি বকাবকি কইরা তোমার ভাবী আমার নখ কাইটা দিল সুন্দর কইরা। পরে সারারাইত বড় শান্তিতে ঘুমাইলাম, কোন খারাপ স্বপ্ন দেখলাম না। দোস্ত, তুমি কিন্তু চা খাইয়া শেষ করলানা, চা ভাল অয় নাই?

আমি আসলেই এই অদ্ভুত গল্প শুনতে শুনতে চা খাওয়ার কথা ভুলে গিয়েছিলাম। ঠান্ডা চায়ে চুমুক দিয়া বললাম, না, না, চা খুব ভালো অইছে। তুমি ঘটনা থামাই না। বলো যাও। তারপর?

আইচ্ছা, তার পরে কই। ঐ রাতের সাত দিন পরের ঘটনা। এবারও মাঝ রাইত। ঘুমাইয়া আছি। ঘুমের ঘোরে পা চুলকাইল। পা চুলকাইলাম এবং ব্যথায় চিৎকার কইরা জেগে উঠলাম। দেখি পা রক্তারক্তি। হাতের দিকে তাকায়া দেখি, হাতের নখ সেই এক ইঞ্চি লম্বা, নখের আগায় পায়ের রক্ত লাইগা আছে। চুলকাইতে যাইয়া নিজের লম্বা নখ দিয়া নিজেরে জখম কইরা বইসা আছি।

কারো কথার মাঝখানে সাধারণতঃ আমি কথা বলি না। কিন্তু বলে উঠলাম, কিন্তু তুমি না কইলা, ভাবী তোমার হাতের নখ কেটে দিছে নেইল কাটার দিয়ে? তাইলে বড় নখ পাইলা কই?

কোব্বাদ আমার গল্প শোনার আগ্রহ দেখে মজা পাচ্ছে। মৃদু হেসে এবং যেন খানিকটা গর্বিত ভঙ্গিতে বললো, এই কথাই তো তোমারে কই দোস্ত। ভাব দেখি কান্ড খান! নখ তো কাইটা দিছে একদম ক্লিন কইরা। এখন সাত দিনের মধ্যে কাটা নখ প্রায় এক ইঞ্চি লম্বা হওয়া কি সম্ভব? সম্ভব না। কিন্তু ঘটনা ঘটছে তাই। আমি একা দেখলে ভাবতাম চোখে ধান্দা দেখতাছি। কিন্তু তোমার ভাবীও জাইগা উঠছে আমার চিৎকার শুইনা। লম্বা নখ দেইখা হে কি কইব প্রথমে বুইঝা পাইতাছে না। পরে কয়, কারো কারো নখ থাকে দ্রম্নত বড় হয়। তুমি এক হপ্তা ধইরা নখ কাট নাই, এর লাইগা বড় বড় অইয়া গেছে। অখ্খন কাট। কি দিন দিন খবিশ অইতাছ কও দেখি?

তারে বুঝ দেয়ার লাইগা নিজেই বসলাম সেই মাঝরাতে নখ কাটার মেশিন লইয়া। কিন্তু আমার মনের ধান্দা কিন্তু কাটতাছে না, বুঝলা দোস্ত। এক হপ্তা নখ কাটলে নখ কত টুকু আর বড় অয়? হঠাৎ মনে অইল, তয় কি আমার উপর অভিশাপ লাগছে কালা বিলাইয়ের?

অভিশাপের কথাটা চট কইরা সেই যে আমার মাথায় ঢুকলো, আর বেরম্নয় না। দিনের মধ্যে পঞ্চাশ বার কইরা দেখি হাতের নখের কি অবস্থা। নখ কাটার মেশিন এক লগে দুইটা কিইন্যা পকেটে রাখি সারাক্ষণ। কিন্তু দোস্ত, তিন-চার দিন পার না অইতেই দেখি একই ঘটনা। বুঝলা না, যা ভাবছিলাম তাই! রাতের ঘুম আমার এমনিতেই কইমা গেছিল। রাতে আষ্টে বার কইরা উঠি পানি খামু, ছোড ঘরে যামু, রান্না ঘরে কিয়ের শব্দ এই সব বইলা। আসলে আমি চেক করি আমার নখের কি অবস্থা।

দোস্ত, তিন দিনের মধ্যে আবার ঘটল ঘটনা। দেখি এইবার শুধু বড় নখ না, নখের আগা গুলা পর্য কেমন ধারালো আর বিলাইর নখের মত চিকন হইয়া গেছে। আমি তোমার ভাবীরে জিগাইলাম না। মাথা রাখলাম ঠান্ডা। এই বার আমি শিওর, আমার উপর অভিশাপ লাগছে। ঘর থেকে বাইর হইয়া বারান্দায় গিয়া নখ কাটার মেশিন লইয়া বসলাম। ধৈর্য্য ধইরা একটা একটা নখ আস্তে আস্তে কাটতাছি, পাছে আবার নখ কাটার শব্দে তোমার ভাবীর ঘুম ভেঙে যায়। প্রায় শেষ কইরা আনছি, এমন সময় তোমার ভাবী ঘর থাইকা ডাক দিল, এ্যই, বারান্দায় এত রাইতে কি কর? আমি কাটা নখ গুলো গোছাইয়া পেপারে মুইড়া জঙ্গলের দিকে ছুঁড়ে মাইরা কইলাম, এমনি বইসা আছি। ঘুম আহে না। সে ডাকল, আসো, শুইয়া পড়। শুইলেই ঘুম আসবো। আমি আইসা শুইলাম। কিন্তু দো¯ত্ম, দুই চোখের পাতা এক করতে পারি না। এইটা কি ঘটতাছে? ভাবলাম, জীবনে আমি বদমাইশি কম করি নাই। পাপও বহুত করছি। কিন্তু শেষে একটা কালা বিলাইয়ের অভিশাপ লাগল আমার উপরে! এর মধ্যে কিন্তু আমি আর শাদা কিংবা কালা কোন রকম বিলাই আর চোখে দেখি নাই।

আর একটা জিনিস দোস্ত তোমারে কওন দরকার। আমার ঘরে আছিল ইঁদুরে ভরা। তোমার ভাবী কত কইরা কইত, একটা বিলাই ঘরে রাখলে ইঁদুরের উৎপাত কমব। কিন্তু আমি রাজী হই নাই। ঐ যে কইলাম, ছোড বেলার থেইক্যাই আমি কুত্তা বিলাই দেখতে পারি না। ইঁদুরের লাইগা কত রকম কল পাতলাম, ওষুধ দিলাম। কিছুতেই কিছু অয় না। হঠাৎ এই কয়দিন ধইরা ইঁদুরের উৎপাত গেছে একদম কইমা। ঘটনা আমার নজরে আনছে তোমার ভাবী। সে কইল, কেমনে কেমনে জানি কয়দিন ধইরা ইঁদুর সব বিদায় হইছে। আলস্নাহ বাঁচাইছে। কিন্তু দো¯ত্ম, আমার মনে অইল, আমার নখের লগে ইঁদুর বিদায় হয়ার কোন যোগ আছে।

যাই হোক দো¯ত্ম, এর পরের থেইকা আমার এই নখ বড় হওনের ঘটনা ঘটতে লাগলো যখন তখন। একদিন দুইদিন পর পর ঘটতে লাগলো। আমার মনের অবস্থা তোমারে কইয়া বুঝানো সম্ভব না, সে চেষ্টাও করলাম না। দিন রাত আমার মনের শান্তি গেল বিনষ্ট অইয়া। কাজে কামে মন দিতে পারি না। তোমার ভাবীর লগে সামান্য সব কারণে কুৎসিত সব ঝগড়া করতে শুরু করলাম। আগে দেখা যাইত, হে ঝগড়া করতে চাইলেও আমি কোন দিন ঝগড়া করতাম না। এখন আমি কোন কথা গায়ে সইতে পারি না। উল্টা পাল্টা কথা যা মুখে আসে তাই কই। সারা দিন ভয়ে ভয়ে থাকি, কেউ যেন আমার নখের ঘটনার আভাস পর্যšত্ম না পায়। হাত লুকাইয়া লুকাইয়া রাখি। রাতের ঘুম গেছে পুরো নষ্ট অইয়া। কেননা, খেয়াল করলাম, ঘটনা যা ঘটে, সব রাতের বেলা।

কয়েক দিনের মধ্যে বুঝতে পারলাম আমি যেন নিজের অজান্তেই আমার নখ কখন বড় অইব- তার লাগি অপেড়্গা করি। কেননা, যে দিন নখ বড় অইব, সেইদিন নখ কাইটা ফেলার পর বড় শান্তিতে ঘুমাইতে পারি। দুই এক দিন পর পরই রাতে বাথরম্নমে বইসা আমার নখ কাটা লাগে। তারওপর প্রতিদিন সকালে উঠাই ব্রাশ করার আগে নখ কাটার মেশিন লইয়া বসি। আবার গোড়া থেইক্যা নখ কাটি।

তোমার ভাবী আমার আচরণ দেইখা ত্যক্ত বিরক্ত, হওয়াই স্বাভাবিক। আমার নাকি মাথা খারাপ হয়ে গেছে, আমারে বড় ডাক্তার না হয় পীর ফকির দেখানোর দরকার, এই সব বলে। আমি কিন্তু তারে আর বলি নাই যে আমার এই অবস্থা চলতাছে। কিছু বলি নাই, তাতেই যে অবস্থা। কিন্তু সে আমারে চোখে চোখে রাখার চেষ্টা করা শুরম্ন করল। এ দিকে বাইরের লোকজনের কানেও ক্যামনে ক্যামনে জানি এ কথা সে কথা যাইতে লাগল। লোক জনে আড়ে আড়ে আমার দিকে চায়। আমার নখের দিকে চায়। মোট কথা আমার জীবন পুরাই চেড়া বেড়া লাইগা গেল। কিন্তু আমি মুখ ফুইটা অন্য কাউরে দূরে থাক, তোমারে ভাবীরেও বলতে পারতাছি না যে, দুই তিন দিন পর পর আমার নখ খবিশের নখের মত বড় অইয়া যায়। তারে যদি কই, মাইয়া মানুষ, ভয়ে অস্থির অইয়া যাইব। তাছাড়া কাউরে ঠান্ডা মাথায় কিছু বলার মত অবস্থাও আমার ছিলো না।

দিন কতেকের মধ্যে তোমার ভাবী কি বুঝল কে জানে, কোন পীর থেইক্যা একটা তাবিজ আইনা দিল। দেখ কান্ড। এখন যদি আমি এই তাবিজ গলায় দিয়া ঘুরি, তয় আমার মধ্যে যে একটা গন্ডগোল চলতাছে তা মাইন্যা নেয়া হয়। আমি ঘাড় ত্যাড়া কইয়া কইলাম, তোমার দরকার লাগলে তুমি সোনার চেইনে তাবিজ বাইন্দা ঘুর। আমার কোন অসুবিধা নাই। আমি তাবিজ বাধুম না।

যাই হোক দো¯ত্ম, এমন কইরা আমার জীবনে সব এলোমেলো হইয়া যাইতে লাগল। ব্যবসা বাণিজ্যের অবস্থা খারাপ। কাস্টমারের সাথেও র্দুব্যবহার শুরম্ন করলাম। রা¯ত্মায় হাটতে পারি না, পোলাপাইনে অখনও কিছু মুখ ফুটে কওয়া শুরম্ন করে নাই, তয় ভয়ে ভয়ে চাইয়া থাকে আর নিজেরা নিজেরা ফুসুর ফুসুর করে। মসজিদে নামাজে গেলে পাশ থেইকা দুই একজন সইরা যায়। মানে তোমারে কি কমু দো¯ত্ম। কেউ কিছু দেখে নাই, শুনে নাই ঠিক মত, অথচ আমার মনে হয় পুরো গেরামে যেখানেই যার লগে দেখা হয়, সে আমারে পাগল না হয় ভয়ংকর কিছু ভাবতেছে। মোটকথা, ঘরে বাইরে আমার শান্তি বইলা কিছু নাই। ঘটনা আর বাড়ামু না । মূল কথা কই তোমারে এইবার।

ইতিমধ্যে তোমার ভাবীর লগে সম্পর্ক এত খারাপ অইছে, প্রায় রাতেই আমি বাইরের ঘরে সোফার উপরে শুইয়া থাকি। এতে আমার ভালই অইছে। সে উল্টা পাল্টা কিছু দেইখা ফেলব- এই চিন্তা থাকল না। কিন্তু সে যে আমারে মাঝে মাঝে রাতে আইসা দেইখা যায়, এইটা আমি টের পাই। টের পাইয়াও কিছু কই না। মটকা মাইরা থাকি।

দিনটা আছিল শনিবার। বাইরে বাতাস ছাড়ছে। ঝড় বৃষ্টি আসার সম্ভাবনা। একটু শীত শীত টের পাইতেছিলাম। অন্যদিনের মতোই আধা ঘুম আধা জাইগা আছি। হঠাৎ টের পাইলাম কি সব জানি ঘরের মধ্যে হাটতাছে। ভালো করে নজর দেয়ার আগে জিনিসটা কি বুঝতে পারলাম। ম্যাওঁ কইরা উঠছে আ¯েত্ম কইরা। বুঝলাতো, বিলাই। আমার হাতের কাছে আছে লাইটের সুইচ। ফস্ করে দিলাম জ্বালাইয়া। দো¯ত্ম, একটা না, মনে অইল হাজারে হাজারে বিলাই সার বাইন্দা একটার পর একটা বইসা আছে। সব কালা রঙের। তাগো সবার সামনে আছে শাদা একটা। সব গুলার হাজার হাজার ফক্ফকা চোখ আমার দিকে তাকাই আছে। আমি আতংকে অস্থির অইয়া চিৎকার দিছিলাম না বিলাইর দিকে কিছু ছুঁড়ে মারছিলাম কইতে পারম্নম না, শুধু দেখলাম প্রথমে ঐ শাদাটা তারপর হাজার হাজার কালা বিলাই আমার ডান হাতের উপর ঝাঁপাইয়া পড়ল। পুরা হাতের উপর না, আমার কব্জির উপর। কামড়াইয়া কামড়াইয়া আমার কব্জি হতে আঙুল গুলো ছিঁড়ে ফেলতে লাগল। ধারালো কিরিচের মতন কুটি কুটি দাঁত দিয়া আমার চোখের সামনে ডান হাতের সব গুলা আঙুল একটা একটা কইরা  হাতের তালু হতে আলাদা করে ফেললো, বুঝলা দো¯ত্ম। তারপর সবগুলা আমার বাম হাতের দিকে নজর দিয়া যখন ঐ দিকে আগাইলো, দো¯ত্ম, খোদার কসম, আমার আর কিছু মনে নাই।

না দো¯ত্ম, পুরা গল্প শেষ অয়নাই, শোন। এইটা তো আমি নিজে ঐ রাতে যা দেখছি , তা কইলাম। এরপরের আমার যখন হুঁশ আসছে, তখন দেখি উঠানে রাজ্যের লোক জড়ো হওয়া, তোমার ভাবী চিৎকার কইরা কাঁদতেছে। জহির ডাক্তারে আমার ডান হাতে ব্যান্ডিজ বান্ধতেছে, স্কুটার আনতে লোক গেছে, আমারে নাকি গঞ্জের সরকারি হাসপাতালে নেয়া লাগবে। যাই হোক, এই সব শুইনা তোমার আর লাভ নাই।

তোমার ভাবীর মুখের কথায় ঐ দিন রাইতের কথা তোমারে আমি কই। সে কইল, রাত বাজে আড়াইটা। তার ছোড ঘরের যাওন দরকার পড়ছে। উঠছে। যাওয়ার পথে সে বাইরের ঘরে উঁকি দিল, দেখে ঘরে আলো জ্বলতাছে, কিন্তু আমি ঘরে নাই। সে ভাবল আমি গেছি ছোড ঘরে। খানিড়্গন সে অপেড়্গা করল। কিন্তু কোন সাড়া শব্দ না পাইয়া সে ছোড ঘরের দিকে হাঁটা ধরল । ঠিক তখনি সে শুনলো মেইল ঘরে মেশিন চলার শব্দ। প্রথমে ভাবল, আজকে মনে হয় কোন ওভারটাইম চলতাছে। মাঝে মাঝে কাজ বেশি জমে গেলে আমার মেইলে রাতে কাজ চালু রাখি। তারপর তার মনে অইল, তাই বইলা এত রাইতে! সে মেইল ঘরের দিকে যাবার দরজার দিকে আগায়া আসল। এই যে দেখতাছ দো¯ত্ম, আমার বাইরের ঘরের থেইক্যা দরজা খুলে ডাইরেক্ট মেইল ঘরে যাওনের রা¯ত্মা আছে। তো দরজার কাছাকাছি আসতেই সে নাকি আমার গলার বিকট চিৎকার শুনল। বেচারি দিশ বেদিশ ভুইলা দিল দৌড়। মেইলে ঢুইক্যা সে নাকি দেখছে, মেইলের বেল্ট ঘুরতেছে পুরো দমে। আমি বেডের নিচে আমার ডান হাতের বাড়াইয়া ধইরা দাঁড়াই দাঁড়াই চিৎকার করতেছি। আর বাম হাতে আস্তে আস্তে বাড়াইতেছি।  রক্তে চারদিক ভাইসা যাইতাছে। সে উড়ে আইসা আমারে ধাক্কা দিয়া ফেললো এক পাশে, চিৎকার কইরা লোকজন ডাকাডাকি করতে লাগলো। ছাইদ্দারে দেখছ যে, ঐ যে চা আইনা দিছে তোমারে, সে থাকতো মেইলের পাশে ঘুপচি ঘরে। সেই প্রথম দৌড়ে আসে।

তারপরের কথা তো তোমারে কইলাম দোস্ত। কিন্তু আমি কি তাইলে বিলাইর ব্যাপারটা স্বপ্নে দেখলাম তুমি কও দো¯ত্ম। কেমনে আমি মেইল ঘরে গেলাম, কে মেশিন চালাইলো, আমি নিজে কেমনে আমার কব্জি মেশিনে ঢুকাইলাম, এক বিন্দু কথা আমার মনে নাই। তোমার ভাবীর কতা, হে যদি আর এক সেকেন্ডও দেরী কইরা আইতো, আমার বাম হাতের আঙুলও নাকি সব কাটা পড়তে।

বলতে বলতে কোব্বাদ তার ডান হাতের গ্লাভস খুলে ফেলল। আমি কি দেখব জানা সত্ত্বেও দেখে একটু শিউরে উঠলাম, দেখলাম, কোব্বাদের হাতের সব গুলো আঙুল হাতের তালুর গোড়া থেকে অত্যšত্ম যত্ন করে যেন কাটা। এমন ভাবে, যেন ওখানে কোন আঙুল ছিল না কখনও।

কোব্বাদ বলতে লাগল, দো¯ত্ম, এই ঘটনার পর আমি হাসপাতাল থেকে বাড়ীত আসতে না আসতে মজনু কাকা তোমার ভাবীরে লইয়া গেল। তোমার ভাবীও নাকি কথা, আমার লগে নাকি খবিশ আছে। মজনু কাকার মতে, আমার মাথার ঠিক নাই। কোনদিন আমি কুলসুমরেই মাইরা ফালামু। তাগোরে আমি দোষ দিই নাই, বুঝলা দো¯ত্ম। যদি আসলেই আমি এই কান্ড কইরা নিজের পাঁচটা আঙুল গোড়া থেইকা কাইটা ফেলতে পারি, তা অইলে এইটা অসম্ভব কিছু না। নিজেরে বুঝাইলাম, তারে আমি আর আনতে গেলাম না। আমাগো ডিভোর্স হইয়া গেল।

মজার ব্যাপার কি জানো দোস্ত, সেই দিনের পর থেইক্যা কিন্তু আমার নখ বাড়নের ঘটনা শেষ। উল্টা পাল্টা স্বপ্নও আর কোনদিন দেখি নাই। শুধু বাম হাতের নখ কাটা আমি বন্ধ কইরা দিছি তার পরের থেইক্যা। কোনদিন না আবার নখ কাটতে গিয়া কি সব উল্টা পাল্টা করে বসি।  থাকুক একটা স্মৃতি, কি কও?

এ বলে কোব্বাদ এবার তার বাম হাতের গস্নাভস খুললো। আমি তাকিয়ে দেখলাম, তার বাম হাতের পাঁচটি নখ কালো লম্বা হয়ে বাঁকিয়ে প্যাঁচ খেয়ে আছে। সোজা করলে লম্বায় কত টুকু হবে ওগুলো। দশ ইঞ্চি? বার ইঞ্চি? কিংবা তারও বেশি?

তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমার গা গুলিয়ে উঠল। প্রচন্ড চেষ্টা করলাম কোব্বাদ যেন আমার মনোভাব বুঝতে না পারে। কিছু একটা বলার চেষ্টা করলাম। কিন্তু বলার মত কোন একটা বাক্যও আমার মাথায় আসলো না। একটু খানি ফ্যাকাসে হেসে বললাম, কুলসুম এখন কই আছে?

কোব্বাদ আমাকে চোখ টিপ দিয়া কইল, আছে, আছে, তোমারে কইতে অসুবিধা নাই। আবার যোগাযোগ হইতেছে। মাঝে মাঝে আসে আমার এখানে। মজনু কাকার মন কিছুদিন ধইরা গলতেছে মনে হয়। বুইড়া হইছে তো। আর বুঝতে পারছে অবশেষে আমার লগে খারাপ কিছু নাই। অখন তারে একটা হিলস্না বিয়া দিয়া ভাল দিন দেইখ্যা ঘরে নিয়া আসমু আবার। হিলস্না বিয়া দেয়া লাগবো, এইটাই হইছে ঝামেলা। কিন্তু কি করমু কও। এ দিকে হে আমারে আবার শর্ত দিছে, বিয়ার আগে আগে বাম হাতের সব নখ কাইটা ফেলতে হইব। তা না হয় কাটলাম। শুধু একটা জিনিস, শরীরের লগে এতদিন ধইরা আছে, কেমন যেন মায়া পড়ে গেছে। তবে একটা মনের দ্বন্ধ যাইতাছে না বুজলা দো¯ত্ম। কালা বিলাইটা বিলাই দলের নেতৃত্ব দিলে না হয় একটা যুক্তি খুঁইজা পাইতাম, কিন্তু শাদা বিলাইর ব্যাপারটা কিছুই বুঝলাম না। বলতে বলতে কোব্বাদ কেমন মায়া মায়া চোখে তার বামহাতের লম্বা নখের দিকে তাকিয়ে থাকে।

 

শেষ.

একটা অতি মৃদু খচ্খচে শব্দে আমার ঘুম ভাঙল। খচ্খচে কিংবা সড়্সড়ে শব্দ। আধো ঘুমে চোখ মেলতে গিয়ে বুঝলাম শব্দটা আসছে আমার হাতের ভিতর থেকে। দু‘হাতের দশটা আঙুলের গোড়ার একটা তীড়্গ্ন অনুভূতি হতে আসছে অতি মৃদু ঐ খচ্খচে কিংবা সড়্সড়ে শব্দটি। আমি দু‘হাত শরীর বরাবর টেনে আনার চেষ্টা করলাম। আমার নখগুলো ঘসা খেতে লাগল বিছানার চাদর বরাবর এবং খচ্খচে শব্দটি কয়েকগুন বেড়ে চড়্চড় শব্দে পরিণত হল। আমি বুঝতে পারলাম, আমার নখের ধারে চিড়ে যাচ্ছে মোটা চাইনীজ বেড কাভার।

ঠিক তখনি আমি স্বপ্ন থেকে জেগে উঠতে উঠতে ভাবলাম, খুব ভাল হতো যদি কোব্বাদের সংগে পুনরায় দেখা না হতো আরো ত্রিশ বছর পয়ঁতাল্লিশ বছর ষাট বছর বা কখনোই।

-০-

- Advertisement -spot_img

আরো পড়ুন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisement -spot_img

সর্বশেষ খবর