(১)
হামিদ মোহাম্মদ
কথা বলছিলাম লন্ডনে থাকা বন্ধু আরেফীন ভাইয়ের সাথে। আরেফীন বন্ধু। কিন্তু তাকে আমি আরেফীন ভাই বলি। বয়সেও বড়। বড় হলেও দীর্ঘ পথচলায় কীভাবে যেন আমাদের সম্পর্কের সুঁতোটি প্যাঁচ খায় বন্ধুত্বে। ভিন্ন কলেজে পড়ালেখা হলেও সাহিত্য সংস্কৃতির জগতে আটার মতো লেগে থাকার কারণে মনে হতো সতীর্থ। জীবনের প্রশ্নে আরো দশ জনের মত আরেফীন ভাই এখন লন্ডনে। তবে যোগাযোগটা ছিঁড়ে যায়নি। অনেকদিন হয় কথা বলা হয়নি। যখন আলাপ করি তখন উঠে আসে ব্যক্তিগত, সামাজিক কথার পরেই সাহিত্য। আলাপ হচ্ছিল হুমায়ূন আহমদের লেখালেখি নিয়ে।
আমার বন্ধুটি হুমায়ূন আহমেদের প্রতি ক্ষ্যাপা। তার কথা হলো, হুমায়ূন তরুণ সমাজকে বোহেমিয়ান পথে ঠেলে দিয়েছেন তার লেখায়। হিমু চরিত্র এক উদ্ভট চরিত্র। ভবঘুরে। আরেফীন ভাই প্রশ্ন করলেন, তিনি কী পাইছেন যুব সমাজকে? ভবঘুরে বানিয়ে ছাড়তে চান কেন? মানি, সাহিত্য কোন বিধিবিধান নয়, কিন্তু স্থায়ীভাবে সমাজকে প্রভাবিত করে।
আমি বললাম, এর চেয়ে তার ছোট ভাই মুহম্মদ জাফর ইকবাল ভালো। ‘দিপু নম্বর টু’ আমার ভালো লাগা বই।
হ্যাঁ, ঠিকই বলেছো। আরেফীন ভাইও একমত হয়ে বলেন, হূমায়ূন আহমেদও প্রতিটি বইয়ে বা নাটকে একটি বা দুটি চরিত্র থাকেই গ্রাম থেকে আসা কোন যুবক বা তরুণীর। দেখানো হয় এরা কাপড় পরতে জানে না, টয়লেট ব্যবহার করতে পারে না, রাস্তায় হাঁটতে জানে না এরকম হাস্যকর চরিত্র তৈরী করেন। এটা ঠিক নয়, আস্ত বাংলাদেশটাই একটা গ্রাম। ঢাকা কি গ্রাম নয়? কবে আবার শহর হল? কংক্রিটের কয়েকটি বিল্ডিং পরেই গ্রাম।
তিনি আরো বললেন, ধরো, শাহেদ আলীর ‘জিরাঈলের ডানা’ বা ‘একই সমতলে’ গল্পের কথা। জিবরাঈলের ডানার কিশোর প্রশ্ন তুলেছে, সে বা তারা কেন গরীব। মা বলেছে, ধনী আল্লাহ বানান। এই প্রশ্নের সমাধান খুঁজতে থাকে কিশোর। আল্লাহ আসমানে থাকেন। সে আল্লাহকে ছুঁয়ে বলতে চায় তারা ধনী হবে না কেন। তাই আল্লাহকে ছুঁতে সে অনেক কষ্টে রোজগার করে পয়সা দিয়ে ঘুড়ি কেনে, সুঁতো কেনে। সুঁতো দিয়ে আকাশে ঘুড়ি উড়িয়ে আল্লাহকে ধরবে, বলবে তারা ধনী হবে না কেন?। কী অপূর্ব গল্প। শ্রেণিবৈষম্যের প্রতিবাদ। হুমায়ূন আহমদের কোন লেখায় এমন প্রতিবাদ আছে? যাচ্ছে তাই। যেখানে শিল্প নেই, মূল্যবোধ নেই, তাকে আমি সাহিত্য বলি না।
শীতের দিন। কথা বলতে বলতে আমার একটু গরমবোধ হল। মনে হচ্ছিল, ফ্যান ছেড়ে দিই। না ফ্যান ছাড়লাম না। ফ্যান ছাড়লেই আমার মনে হয়, আমার মাথাটা ফ্যানের ডানা টাস করে বাড়ি দিয়ে কেটে ফেলেছে। নিচে মেঝে রক্তাক্ত মাথা গড়াগড়ি দিচ্ছে। এরকম মনে করার পিছনে কারণ আছে। চেয়ারে উঠে উবু হয়ে লটকে আমি আলমারির ওপরে রাখা কয়েকটি বই খুঁজতে গিয়ে একবার আমার কাজের বুয়াকে বলেছিলাম, দ্যাখো, খবরদার কেউ ফ্যান ছাড়বে না, ছাড়লে আমার মাথা কাটবে। কিন্তু সে হু বলেই ফ্যানটা শা-করে ছেড়ে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে আমার মাথায় ধুম্মুত করে এক বাড়ি। মাথা কাটেনি। কিন্তু এমন ভয় পাই, মনে হয়েছে, মাথা কেটেই পড়েছে। সেই থেকে ভয় পাই ফ্যানকে। আর এই বুয়ার এক দোষ তাকে যদি বলি, এটা করো না, ওটা করো। সে কিন্তু যেটি না বলেছি, সেটিই করবে। তাই মনে হয় সে যেন আমার পিছু লেগে আছে। এবং এই বুঝি ফ্যান ছেড়ে দিচ্ছে।
ফ্যান না ছেড়ে জানলা খুলে দিই। একটু ঠান্ডা বাতাস ঝপাৎ করে আমার রুমে ঢুকে। গা’র মধ্যে শীতল পরশ বেয়ে গেল আস্তে করে, ভালো লাগল। এ রুমটি আমার নিজের। এখানে বসে ব্যক্তিগত ফোনালাপ, বইপড়া, গান শোনা বা আপন কেউ এলে একান্তে কথা বলি বসে বসে।
সকাল এগারোটা হবে। জানালা খুলতেই আমি কান্নার শব্দ পেলাম। নারী কণ্ঠ। এই ভাটি এলাকার সুরমা নদীর কোলঘেঁষা ছোট্ট শহরটিতে বিয়ে হয়ে আসার পর থেকে আমি ভয় পাই কাঁন্নার শব্দ। বেশিরভাগ নারী বা শিশুকণ্ঠ আমাকে বিচলিত করে তোলে। মূলত ছোট্ট শহর যেকোনো শব্দই টাস করে কানে ভাসে। আমার বাড়িটি সুরমা নদীঘেঁষা। বাড়ি নয়, বাসাই বলতে হয়। পাশে মার্কেট। মাকের্টের কামলা, কুলিমজুরের চেঁচামেচি আর চিৎকারে কান ভারী হয়ে থাকে সব সময়। দরজা-জানালা বন্ধ থাকলে তেমন শোনা যায় না। জানালা খুললেই একটু বেশি করে ছুটে আসে নানা শব্দ, অস্পষ্ট অথচ উচ্চৈঃস্বরের কথাবার্তাও। তাই সামনের দিকের কোন জানালা বা দরজা তেমন খুলি না। পেছন দিকের দরজা বা জানালা খুললেই চোখে নদীর রূপটা দেখি। মালবাহী নৌকা বা জাহাজ ভাটিতে ছুটছে বা উজান পানি ঠেলে যাচ্ছে। অসম্ভব জীবন বাজি-রাখা নদীর ওপর টালমাটাল, উতাল-পাতাল দৃশ্য। বা মানুষজন যেন যুদ্ধ করছে এমন করে লাগে আমার বুকে। কোন সময় হৈ হৈ করা এক কর্মযজ্ঞে না-থামা পৃথিবীকে দেখি আমি। তারপর দূরে তাকালেই চোখকে ধাঁধিয়ে দেয় উত্তরের মেঘালয় পাহাড়। কখনো মেঘাক্ত, কখনো মেঘমুক্ত আবার ঘন কুয়াশায় ঢাকা খাসিয়া পাহাড়। আমি লেখালেখি করি বলেই এসব দৃশ্য আমার কাছে অন্যরকম জীবন, অর্থপূর্ণ। সাধারণের কাছে এদৃশ্য এমন কিছু নয়। হয়তো নতুন কেউ এলো, বলবে খুব সুন্দর আপনার এ দৃশগুলো। অনেকে আবার বলে কী করে আপনি সহ্য করেন এতো চেঁচামেচি বা নদীতে নাও, মাঝির কর্মকা-, এতো হুলস্থুল! আমি হেসে উড়িয়ে দিই। বলি না যে এটাই প্রাণ, এ দৃশ্যাবলিই আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। জীবন দেয় আমাকে।
আবার কান্নার শব্দ। গলার আওয়াজ শুনে মনে হল, চিকনও নয়, আবার ভরাটও নয়। কাঁচা কণ্ঠ। ষোল বা পনেরো। তবে মেয়ে কণ্ঠ। নারীকণ্ঠ বলা যাবে না। কান্নার মধ্যে কষ্টটা স্পষ্ট। মনে হচ্ছে কারা যেন জোর জবরদস্তি করছে আর সে প্রাণপণে বাঁধা দিচ্ছে।
আরেফীন ভাইকে বললাম, পরে কথা বলবো। এখন রাখি, কী একটা ঘটছে মনে হচ্ছে, কান্নার শব্দ পাচ্ছি, নদীর চর থেকে কান্নার শব্দটি আসছে।
ফোন কেটেই উঁকি দিলাম নদীর দিকে। শীতের দিনে নদীর তলায় পানি। চরটা তেরচা হয়ে নেমেছে নিচে। চমকে গেলাম। একটি মেয়েকে স্নান করানো হচ্ছে। চার পাঁচজন মহিলা জোর জবরদস্তি করছে। মাথায় পানি ঢালছে, সাবান মাখিয়ে দিচ্ছে চুলে। একজন হাতের শাখা ভাঙছে হাতুড়ির মত কী দিয়ে। বুঝা গেল হিন্দু মেয়ে। কেন শাখা ভাঙছে? ডাক দিয়ে একজনকে জিজ্ঞেস করতেই বললো, একসিডেন্টে স্বামী মরেছে, তাই শাখা ভাঙা আর স্নান করিয়ে পবিত্র করা হচ্ছে।
বুকের মধ্যে চ্যাঁৎ করে ওঠে। এই বাচ্চা মেয়ের স্বামী মরেছে! ঝাৎ করে প্রশ্নটি মনকে নাড়িয়ে দেয়। বিয়ে কবে হল, বয়সই হয়নি। এতেই স্বামী-মরা! অবাক হয়েই থমকে গেলাম। শুনলাম ছেলেটি রং মিস্ত্রী ছিল। এর বেশি কিছু জানতে পারা হয়নি।