Free Porn
xbporn

buy twitter followers
uk escorts escort
liverpool escort
buy instagram followers
Galabetslotsitesi
Galabetsondomain
vipparksitesigiris
vipparkcasinositesi
vipparkresmi
vipparkresmisite
vipparkgirhemen
Betjolly
Saturday, July 27, 2024

মনীষী ইবনে সিনা’র চিকিৎসাশাস্ত্রে অবদান: হাসান হাফিজ

মধ্যযুগের বড়ো এক বিস্ময় তিনি। অল্প বয়সেই চিকিৎসা শাস্ত্র ও দর্শনে। । এতোটাই পারদর্শী হয়ে ওঠেন যে, পাশ্চাত্যে তাঁকে বলা হতো ‘চিকিৎসক সম্রাট’। দর্শন ও বিজ্ঞানে অসাধারণ মেধা ও পাণ্ডিত্যের জন্যে প্রাচ্য দেশে তিনি ‘সেরা জ্ঞানী’ হিসেবে বিখ্যাত। পুরাকালের মানব সভ্যতার জন্মস্থান গ্রিসে চিকিৎসা বিজ্ঞানে দুই পথিকৃতের সম্মান দেওয়া হয় হিপোক্রেটিস ও গ্যালেনকে। গোটা পৃথিবীর জ্ঞানী-গুণীরা ইবনে সিনাকে চিকিৎসাজগতে সর্বকালের ওই দু’জন বিশ্বনন্দিত চিকিৎসক ও দার্শনিকের সমান মর্যাদা দিয়ে থাকেন ।

পুরো নাম তাঁর আবু আলি আল হুসেন ইবনে আবদাল্লা ইবনে সিনা। সংক্ষেপে বু আলি বা ইবনে সিনা । ইউরোপীয়দের কাছে তিনি আভিসিনা নামে পরিচিত। জন্মেছিলেন আরব ভূখণ্ডের অন্তর্গত পারস্য দেশের বুখারা শহরে। জন্মবছর ৯৮০ খ্রিস্টাব্দ, মৃত্যু ১০৩৭ খ্রিস্টাব্দ। অনেকের মতে, বুখারার আফসানায় এই মহৎ প্রতিভার জন্ম। স্থানটি বর্তমান উজবেকিস্তানের অন্তর্গত। কারো কারো ধারণা, ইবনে সিনা জন্মগ্রহণ করেন বলখ প্রদেশে। বাবা আবদুল্লাহ ছিলেন বুখারার বাদশাহ নূহ বিন মনসুরের দেওয়ান বা গভর্নর। মায়ের নাম সেতারা বিবি। তিনি ছিলেন তুর্কিস্তানের ঐতিহ্যবাহী গ্রাম আফসানার এক বিত্তবান পরিবারের মেয়ে।

বাবা আবদুল্লাহ উঁচু রাজপদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। অবশ্য অনেক আগে থেকেই তাঁদের বংশের লোকজন যুক্ত ছিলেন রাজনীতির সঙ্গে। ইবনে সিনার শিশুকাল কেটেছে থাকে। আভিজাত্য ও প্রাচুর্যের মধ্যে। শৈশবেই তাঁর তীক্ষ্ণ বুদ্ধি ও অসামান্য মেধার পরিচয় পাওয়া গেল। ছেলের শিক্ষা-দীক্ষার ব্যাপারে বাবা ছিলেন অত্যন্ত সজাগ। মাত্র পাঁচ বছর বয়সেই এর জন্যে গৃহশিক্ষক নিযুক্ত করেন তিনি। শিশু ছাত্রটি মাত্র দশ বছর বয়সেই পুরো কোরআন শরিফ মুখস্থ করে ফেলেন। একাধিক গৃহশিক্ষকের কাছ থেকে নিবিড় পাঠ নেন ইবনে সিনা। এসব বিষয়ের মধ্যে ছিল অক্ষ, দর্শন, বীজগণিত, চিকিৎসাশাস্ত্র, জ্যোতির্বিদ্যা, गान পদার্থবিদ্যা, ন্যায়শাস্ত্র, ফিকাহ, জ্যামিতি, মনোবিজ্ঞান ইত্যাদি।

একজন বিদগ্ধ গৃহশিক্ষকের নাম ছিল আন নাতিলি। তিনি ছিলেন নানা বিষয়ে পণ্ডিত। বহু জটিল সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে ছাত্রটির প্রথর বিচারবুদ্ধি, মেধা ও স্মৃতিশক্তি দেখে হতবাক হয়ে যেতেন নাতিলি। শিক্ষা খুব অল্প বয়সেই গুরুকে ছাড়িয়ে গেল। পরাজন স্বীকার করতে কুণ্ঠিত হননি নাতিনি। ছাত্রের তীক্ষ্ণ মেধার পরিচয় পেয়েছিলেন আগেই। ওর বাবাকে তাই বলেছিলেন, আপনার এই ছেলেটি একদিন মত বড় পণ্ডিত হবে। আমার অনুরোধ, আপনি ওকে অন্য কোনো কাজে লাগাবেন না। ও যেন লেখাপড়াতেই লেগে থাকে।

ইবনে সিনার ৫৭ বছরের জীবনটা ছিল নানা নাটকীয় ঘটনা ও রোমাঞ্চে ভরপুর তাঁর গুণাবলী ও অবিশ্বাস্য ক্ষমতা সম্পর্কে দুনিয়াজোড়া কত কাহিনি যে আছে, তা শুমার করা মুশকিল। মুসলিম স্বর্ণযুগে স্মরণীয় বরণীয় অনেক মানুষ বিশ্বের ভাবজগতে আলোড়ন সৃষ্টি করেন। তাদের মধ্যে ইবনে সিনার নাম বিশেষ শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারিত হয়। গুণী এই মানুষটির বিপুল কর্মকার ও অবদানের খুব অল্প ইতিহাসই উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। যেটুকুই পাওয়া গেছে, তাতেই মুগ্ধ ও চমৎকৃত হয়েছে গোটা পৃথিবী। সসম্ভ্রমে তাঁর স্মৃতির উদ্দেশে মাথা নুইয়ে সম্মান জানিয়েছে অহংকারী ইউরোপ। গ্রিক মনীষী এ্যারিস্টটল, প্লেটো এ সক্রেটিসের মতো ইবনে সিনার নাম সংস্কৃতি, জ্ঞান-বিজ্ঞানের ইতিহাসে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। দুঃখজনক সত্য, আল বেরুনী, আল রাজি অথবা ওমর খৈয়ামের মত ইবনে সিনার প্রতিও ইতিহাসের সুবিচার আমরা দেখতে পাই না। কিন্তু এতে কী আসে যায়, স্বমহিমায় ও সগৌরবে ইবনে সিনার নাম ও অবদান উদ্ভাসিত হয়েছে।

দেশ ও কালের সীমা পার হয়ে তিনি লাভ করেছেন অমরত্ব। ইবনে সিনার পিতার বাড়িতে অনেক বিদ্বান লোকের সমাগম হতো। অনেক কিছু শেখার সুযোগ হতো তাঁদের কাছ থেকেও। মাত্র ১৮ বছর বয়সের মধ্যে ইবনে সিনা ইসলামী । আইন-কানুন, ন্যায়শাস্ত্র, অধিবিদ্যা এবং চিকিৎসা শাস্ত্রের অনেক কিছু জেনে নিতে সমর্থ হন। তৎকালে পারস্য দেশের শাসনকর্তা ছিলেন সামানিদ বংশোদ্ভূত। একজন রাজপুত্র কঠিন রোগে আক্রান্ত হন। ইবনে সিনার চিকিৎসায় রাজপুত্র সেরে ওঠেন। এতে রাজার প্রিয়ভাজন হয়ে ওঠেন নবীন চিকিৎসক। রাজা তাঁকে সমৃদ্ধ পাঠাগার ব্যবহারের অনুমতি দেন। যুবক ইবনে সিনা এতে উপকৃত হন। কিছু সময়ের জন্যে তাঁকে প্রশাসনিক দায়িত্বও দেওয়া হয়। অল্পবয়সী যুবকটির পাণ্ডিত্য, মেধা ও দক্ষতার পরিচয় পেয়ে অভিভূত হন রাজা। কিন্তু দুর্ভাগ্য, অল্প কিছুদিন পরেই ইবনে সিনার জীবনে মর্মান্তিক বিপর্যয় ঘটে। তিনি পিতৃহীন হন। সামाনিদ রাজপরিবারের পরাজয় ও পতন ঘটে তুরস্কের রাজা গজনীর মামুদের কাছে। ইবনে সিনা তখন রাজধানী খোরাসান থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। বেশিদিন এক জায়গায় নিরাপদে বসবাসের সুযোগ হলো না। জীবনের অন্তিম সময় ওই অঞ্চলের রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে বিপন্ন থাকতে হয়েছে তাঁকে। এতসব প্রতিকূলতার মধ্যেও গভীর নিবিড় জ্ঞানসাধনা ও মহার্ঘ পুস্তক রচনায় তিনি মনোযোগ দিতে পারতেন। তাঁর জ্ঞানস্পৃহা ছিল অত্যন্ত প্রবল।। বাইরের দুনিয়ার বিশৃঙ্খল অস্থির পরিস্থিতি, যুদ্ধবিগ্রহ কিছুই তাঁর মনোজগতের স্থৈর্য ও জ্ঞানের সাধনাকে ব্যাহত করতে পারেনি। প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে পারস্য দেশের এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় তাঁকে আত্মগোপন করে থাকতে হয়। এক পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছান পারস্যের মধ্য-পশ্চিমাঞ্চলের হামাদান রাজ্যে। ওই রাজ্যে তিনি রাজচিকিৎসকের পদে নিযুক্ত হন। ইবনে সিনা তাঁর যোগ্যতা, দক্ষতা, প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতার পরিচয় দেন। তাঁকে দু’বার প্রধান উজিরের দায়িত্ব প্রদান করা হয়। ফলে নানা ষড়যন্ত্র, ঈর্ষা, বিশ্বে‍ ও চক্রান্তের শিকার হন তিনি। পরিস্থিতি। মোকাবেলায় আত্মগোপনে থাকতে তো হয়ই, এমনকি জেলেও যেতে হয় অসামান্য জী এই মানুষটিকে। এত বাধা বিপত্তির মধ্যেও জ্ঞানসাধনা অব্যাহত রেখেছিলেন তিনি। ছিলেন কাজপাগল মানুষ। কাজের বিঘ্ন ঘটবে- এই ভয়ে তিনি বিয়ে করেননি। সম্ভ্রান্ত বংশের অনেক রমণী তাঁকে বিয়ে করতে ইচ্ছুক ছিলেন। এমনকি কয়েকজন রাজকুমারীও তাঁর সহধর্মিণী হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এসব প্রস্তাবে সায় দেননি তিনি।

ইবনে সিনা দর্শন ও বিজ্ঞানকে নবতর দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করেছিলেন। উদারমনা মানুষটি ধর্মের নামে বাড়াবাড়ি পছন্দ করতেন না। সবার উপরে মানুষ সত্য এই সত্যে তিনি বিশ্বাসী ছিলেন। বুঝতেন যে সংস্কৃতি সকলের জন্যে। আলো বা হাওয়া যেমন কখনো কোনো সীমারেখার ধার ধারে না, সংস্কৃতিও তেমনি মুক্ত ও সর্বত্রগামী। তাকে বাঁধা যায় না কোনো দেশ, জাতি কিংবা ধর্মের বেড়াজালে। সে কারণে যাঁরা দর্শন, বিজ্ঞান ও কৃষ্টিচর্চায় নিয়োজিত, তাঁদের অবদান কারো একক সম্পত্তি নয়। সেসব গোটা দুনিয়ার মানুষের জন্যে। কর্মমুখর জীবনে তিনি জ্ঞানজগতের সর্বত্র বিচরণ করেছেন। এক কালে শুধু গুণী চিকিৎসক হিসেবেই গণ্য করা হতো তাঁকে। এই ধারণা বিদ্যমান ছিল ষোড়শ শতাব্দী পর্যন্ত, প্রাচ্য- পাশ্চাত্য সবখানে। পরে তিনি একজন উঁচু মাপের দার্শনিক হিসেবেও স্বীকৃতি পেয়েছেন। দার্শনিক-চিকিৎসক এই মানুষটি কবিও ছিলেন। অনেকেরই জানা নেই যে, ওমর খৈয়াম ছিলেন মূলত একজন বিজ্ঞানী। কিন্তু তাঁর কবি পরিচয়ই প্রবল হয়ে উঠেছে বিজ্ঞানী সত্তাকে ছাপিয়ে। ঠিক তেমনি সিনার বেলায়ও। অন্য সব পরিচয় ছাড়িয়ে প্রধানত চিকিৎসক হিসেবেই খ্যাতি পরিচিতি পেয়েছেন। তিনি যে কবি, এ তথ্য জানা গেছে অনেক পরে। তাঁর লেখা কিছু আরবি ও ফারসি কবিতার খোঁজ পেয়েছেন গবেষকরা। মাতৃভাষা ছিল ফারসি। তা সত্ত্বেও প্রায় সবগুলো বই-ই লেখা হয়েছিল আরবিতে। ডা. এধি নামের একজন নির্দিষ্ট গবেষক প্রথম খোঁজ পান ফারসিতে লেখা ১৫টি ছোট ছোট কবিতার।

শুধু কবিতা নয়, ইবনে সিনা অনেক গদ্য লিখেছেন। দর্শন ও সাহিত্যের সঙ্গে বিজ্ঞানের ঐক্য বিশেষ নেই। কিন্তু এই মনীষীর মধ্যে এই দুয়ের বিচিত্র সমন্বয় ঘটেছিল। জীবদ্দশায় তাঁর দার্শনিক সুনাম ততটা বিস্তৃত হয়নি। সত্য। কিন্তু চিকিৎসক হিসেবে তাঁর নৈপুণ্য ও কৃতিত্বের সংবাদ ছড়িয়ে পড়েছিল সময় প্রাচ্যে। চিকিৎসা বিজ্ঞানে তাঁকে ‘আল মুয়াল্লিম আসানি’ অর্থাৎ দ্বিতীয় শিক্ষক বলা হয়। প্রথম শিক্ষক হিসেবে অভিহিত করা হয় গ্যালেনকে।

 

ইবনে সিনা গ্রিক, রোমক, ভারতীয় ও চৈনিক চিকিৎসা পদ্ধতির সার সংগ্রহ করেন। রচনা করেন ‘কানুন’ বা ‘চিকিৎসা বিজ্ঞানের সূত্রাবলী’। বইটি মোট পাঁচ খণ্ডের। এর দ্বিতীয় খণ্ডে বর্ণনা রয়েছে ৭৮৫ টি ভেষজ, প্রাণিজ ও খনিজ ঔষধির। তার অনেকগুলোই আজো পর্যন্ত ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। মধ্য এশিয়ার সোনালি ঈগল ও দীর্ঘপুচ্ছ সমুদ্র ঈগলের পিত্তে ঔষধি গুণ রয়েছে, এটা পামীর অঞ্চলের লোকজনের বিশ্বাস। এই ওষুধ তীব্র মাথাব্যথা ও মানসিক রোগে বেশ কাজ দেয়। আলপাইন-টার্কির মাংসেও রয়েছে ঔষধি গুণ। এই মাংস এখনো কাজে লাগে পামীর এলাকায়। গ্যাস্ট্রিক ও চক্ষুরোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। ইবনে সিনা হাজার বছর আগে এইসব ঔষধি সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে লিখে গেছেন। বেশ কিছুকাল আগে তাঁর লেখা চিকিৎসা বিষয়ক মূল্যবান একটি গ্রন্থ পাওয়া গেছে। তাতে দেখা যায়, তিনি সাইকোথেরাপি বা মনোচিকিৎসারও উদ্ভাবক। তিনি নানা দেশের চিকিৎসাশাস্ত্র পাঠ ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে সার সংকলন করেন। এজন্য অনেকে তাঁর তত্ত্ব ও তথ্যের মৌলিকতা সম্পর্কে প্রশ্ন তোলেন। কিছুকাল আগে অধ্যাপক শিফাউল মুলক হাকিম আবদুল লতিফ দিল্লির জামিয়া মিলিয়া গ্রন্থাগারে ইবনে সিনার একটি গ্রন্থ আবিষ্কার করেন। অধ্যাপক শিফাউল মুলক গবেষণা করে দেখেছেন, ইবনে সিনা হৃদরোগের চিকিৎসায় যে ওষুধের বিধান দিয়েছেন, সেটা ছিল সম্পূর্ণ মৌলিক ।

 

সাতান্ন বছরের জীবনে সর্বমোট ৯৯টি গ্রন্থ রচনা করেছেন তিনি। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড়ো ও বিখ্যাত হচ্ছে দুটি গ্রন্থ- আশ-শেফা’ এবং ‘আল কানুন’। ২০ খণ্ড বিশিষ্ট আশ-শেফায় সবিস্তারে আলোচনা করা হয়েছে প্রাণী, উদ্ভিদতত্ত্ব, রাজনীতি ও অর্থনীতির প্রসঙ্গ। ‘আল কানুন’ লিখিত হয়েছে পাঁচ খণ্ডে। প্রায় ১০ কোটি শব্দ রয়েছে এই গ্রন্থে। সাধারণ হিসাবে এ গ্রন্থের পৃষ্ঠা প্রায় পাঁচ লক্ষ। ‘আরযুজাফিল তিব্ব’ হচ্ছে পদ্যের আকারে লেখা চিকিৎসা বিষয়ক একটি গ্রন্থ। এ বইয়ে আছে এক হাজার ৩৩৬ টি কবিতা। নবীন চিকিৎসকদের জন্যে লেখা হয়েছে এ বই। এতে আছে রোগের বর্ণনা ও ব্যবস্থাপত্র। তরুণ চিকিৎসকদের কাছে বেশ সমাদৃত হয়েছে বইটি। সারা বিশ্বেই মধ্যযুগে ইবনে সিনার প্রচণ্ড প্রভাব ছিল। তাঁর অনন্য চিকিৎসাগ্রন্থ ‘আল কানুন’ এর ল্যাটিন অনুবাদ ইউরোপীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিল পাঠ্য। এটি বহাল ছিল দ্বাদশ থেকে সপ্তদশ শতাব্দী পর্যন্ত। ইউরোপীয়রা ইবনে সিনাকে ‘মাস্টার অব মেডিসিন’ বা চিকিৎসা বিজ্ঞানের শুরু বলে অভিহিত করতো। এখনো বিরলপ্রজ এই মনীষীকে ইউরোপে প্রাচ্যের গ্যালেন হিসেবে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হয়। ইবনে সিনা ছিলেন অত্যন্ত শান্তিপ্রিয় মানুষ। চিনি স্বৈরাচারী, দাম্ভিক রাষ্ট্রনায়কদের তিনি ভীষণ অপছন্দ করতেন। যুদ্ধবিগ্রহও বরদাশত দিে করতে পারতেন না। যদিও রাজনীতির পাকেচক্রে তাঁকে বারবার যুদ্ধের সঙ্গে জড়িয়ে প্রশ পড়তে হয়েছিল। তিনি মনে করতেন, শাসকের একমাত্র কর্তব্য হওয়া উচিত রাষ্ট্র এবং জাতিধর্ম নির্বিশেষে জনগণকে রক্ষা করা। তিনি আরো বিশ্বাস করতেন, শাসক ন্যায়বুদ্ধির দ্বারা পরিচালিত হলেই দেশের সর্বাঙ্গীণ উন্নতি হওয়া সম্ভব।

১৯৮০ সালে ইবনে সিনার জন্মহস্রবর্ষ  উদযাপিত হয়েছে। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন সাড়ম্বরে সেই বছরটি নানা কর্মসূচিতে উদযাপন করে। ইবনে সিনার গ্রন্থাবলি বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। জ্ঞান-বুদ্ধির মনন-যুক্তিভিত্তিক জগতে আপন মেধা ও প্রজ্ঞার পরিচয় তো তিনি দিয়েছেনই। শিল্প-সংস্কৃতি, বিশেষত সংগীত সম্পর্কেও তাঁর আগ্রহ ও পাণ্ডিত্য ছিল, তা রীতিমত বিস্ময়কর। রোগ নিরাময়ের পুস্তক’ এ সংগীত বিষয়ে বিস্তারিত পর্যালোচনা করেছেন তিনি। অনেকের ধারণা, আরবা সংগীত সম্বন্ধে সে আলোচনা এখনো পর্যন্ত সর্বশ্রেষ্ঠ। তাঁর রচনাবলির মধ্যে পাওয়া যায়। পাহাড়-পর্বত, পাথর এবং নানা প্রকার খনিজ ধাতব পদার্থের কীভাবে উত্তর হলো, তার বর্ণনা। এসব উদ্ভবের সঙ্গে জড়িত রয়েছে। ভূপৃষ্ঠের নানা ঘটনাবলি এবং প্রাকৃতিক অবস্থা, ভূমিকম্পের ফলাফল, পানি এবং বায়ুপ্রবাহের ভূমিকা ইত্যাদি। আরো আছে ভূ-পৃষ্ঠের তাপমাত্রার পরিবর্তন, পলিপতন, ভূমিধস, ভূমিক্ষয় এবং ভূমি সংগঠন ইত্যাদি। আরব অঞ্চলের বিজ্ঞান ও চিকিৎসাশাস্ত্রের স্বর্ণযুগ ধরা হয় মোটামুটিভাবে ৯০০ খ্রিস্টাব্দ রায় থেকে ১১০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কালকে। ওই শিখ সময় পরিধির মধ্যাংশে জীবিত ছিলেন ইবনে চল সিনা এবং মানব কল্যাণে মহার্ঘ অবদানসমূহ निय রেখেছিলেন তিনি।

হামাদানের রাজসভায় থাকাকালীন তিনি ‘কানুন ফিত্তির’ (ওষুধের বিধি) নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন। চিকিৎসাশাস্ত্রের বিশ্ব ইতিহাসে ঔষধ বিষয়ে এতো বড়ো আকারের সিন বই এখনো পর্যন্ত অন্য কেউ লিখতে সমর্থ হননি। ওই গ্রন্থের ভিত্তি ছিল ইবনে সিনার পূর্ববর্তীকালে যেসব গ্রিক চিকিৎসক খ্যাতিমান ছিলেন এবং আরব অঞ্চলে যাঁরা চিকিৎসা বিজ্ঞান নিয়ে কাজ করেছিলেন, তাঁদের অর্জিত জ্ঞান সম্পর্কিত সুসংবদ্ধ ও বিস্তারিত আলোচনা। এই পুস্তকে তিনি যোগ করেন চিকিতান হিসেবে তাঁর যেসব অভিজ্ঞতা হয়েছে সেসবও। দিনের বেলা তিনি ব্যস্ত থাকতেন রাজপরিবারের সদস্যদের চিকিৎসা ও প্রশাসনিক দায়িত্ব পালনের কাজে। প্রায় প্রতি

 

রাতেই মনোনিবেশ করতেন গ্রন্থরচনায়। তাঁর রাতের ‘অধিবেশনে সমবেত হতো অনেক শিক্ষার্থী। তাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চলতো জ্ঞান-বিজ্ঞান ও দর্শনের নানা দিক নিয়ে। সেই সঙ্গে মাঝে মধ্যে আয়োজন থাকতো সংগীতানুষ্ঠানের। আনন্দ উল্লাস চলতো অনেক রাত পর্যন্ত। আমোদ-প্রমোদ ও জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার সে ছিল এক আশ্চর্য 1 সুন্দর সমন্বয়। বেশ ভালো স্বাস্থ্য ছিল ইবনে সিনার। একজন প্রকৃত জ্ঞানী ও রসপিপাসু মানুষ কীভাবে নিজের জীবন অন্যের কল্যাণ ও আপন উপভোগে সুন্দরভাবে অতিবাহিত করতে পারেন- এই মনীষীর জীবন যেন। তারই এক অনন্য উদাহরণ। তিনি বিশ্বাস করতেন, মানুষের দেহ বিভক্ত হলেও আত্মা কখনো বিভক্ত হয় না। সুতরাং শরীর বিনষ্ট হওয়ার পর আত্মা থেকে যায় অবিকৃত। তিনি বিশ্বাসী ছিলেন অদৃষ্টবাদেও। ইবনে সিনার মতে, জনা-মৃত্যু ও সুখ-দুঃখের ওপর কোনো হাত নেই মানুষের। সবকিছুই ভাগ্যের অধীন। এক মহাশক্তি এই ভাগ্যকে নিয়ন্ত্রণ করে যা কিনা অনাদি ও অবিনশ্বর। আত্মা সম্পর্কে ফরাসি দার্শনিক দেকার্তের যে অভিমত, তার সঙ্গে ইবনে সিনার মতের অনেক মিল রয়েছে।

 

এসব মতামতে তৎকালীন মুসলমান সমাজ ক্রুদ্ধ হয়েছিল। জানা যায়, ওই সময়কার বিশিষ্ট এক দার্শনিক মৃত্যুশয্যায় এই মন্তব্য করেন যে, আল্লাহ যা বলেছেন, তাই সত্য। ইবনে সিনাই মিথ্যাবাদী। এই প্রতিক্রিয়া জেনে ইবনে সিনা কিন্তু উত্তেজিত হননি। তিনি বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিতে মুক্তি দিয়ে বিচার করেছেন ধর্মের বিভিন্ন জটিল মতবাদকে। তাঁর সঙ্গে অকাট্য যুক্তি দিয়ে ইমাম গাজ্জালীর মত খণ্ডন করেছেন ইবনে রুশদ নামের আরেকজন দার্শনিকও। ইমাম গাজ্জালী ইবনে সিনাকে ‘কাফের’ বলে অভিযুক্ত করেছিলেন। পরবর্তীকালে পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটে। ইসলামী মতবাদের সঙ্গে নিজস্ব মতবাদের সমন্বয় ঘটানোর চেষ্টা করেন ইবনে সিনা । তিনি আত্মার অমরত্ব ও অবিনশ্বরতার কথা তুলে ধরেছেন সহজভাবে। সেই সময়ে এই মতবাদ প্রাচ্যে পরিচিত ছিল এ্যারিস্টটলের মতবাদ হিসেবে। বিপরীতে ছিল প্লেটোর মতবাদ। এক সুন্দর সাম্য লক্ষ্য করা যায় ইবনে সিনার মতবাদ ও ধর্মমতের মধ্যে। তিনি সেকালের অন্যসব মুসলিম দার্শনিকের মতো কবিতায় নিজের চিন্তাধারা তুলে ধরেন। আত্মাকে একটি কবিতায় তিনি তুলনা করেছেন পাখির সঙ্গে। এই পাখি মায়াভরা দুনিয়ায় বাঁধন ছিঁড়ে ঊর্ধ্বলোকে চলে যেতে চায়। পরমাত্মার কাছে। জীবনভর এই আকাঙ্ক্ষা বুকে পুষে রেখে ছটফট করে সে। অবশেষে মরণের দূত এসে খুলে দেয় তার খাঁচার দরোজা।

 

ইবনে সিনা তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন। যে, এমন অনেক দিন-রাত গেছে, যে সময় ক্ষণিকের জন্যেও তিনি ঘুমোননি। শুধুমাত্র জ্ঞান চর্চাই ছিল একমাত্র কাজ। কখনো কোনো বিষয় বুঝতে না পারলে, জটিল কোনো সমস্যার মুখোমুখি হলে চলে যেতেন। মসজিদে আদায় করতেন নফল নামাজ। সেজদায় পড়ে আকুল হয়ে আল্লাহর দরবারে কান্নাকাটি করতেন। বলতেন, হে আল্লাহ। তুমি আমার জ্ঞানের দরজা খুলে দাও। জ্ঞান লাভ ছাড়া দুনিয়াতে আমার অন্য কিছু চাওয়ার নেই তারপর ঘরে ফিরে মন দিতেন পড়াশোনা ও গবেষণায়। ক্লান্তিতে অবসন্ন হয়ে এক পর্যায়ে ঘুমিয়ে পড়তেন, তখন অমীমাংসিত প্রশ্নগুলো তাঁর মনের মধ্যে ভাসতো। যেন খুলে যেত জ্ঞানের দরজা। হঠাৎ ঘুম থেকে জেগে উঠেই পেয়ে যেতেন সমস্যাগুলোর সমাধান। মাত্র ২১ বছর বয়েস তিনি  ‘আল মজমুয়া’ নামে একটি বিশ্বকোষ প্রণয়ন করেন। এই গ্রন্থে গণিত শাস্ত্র ছাড়া প্রায় সকল বষিয় তিনি অন্তর্ভূক্ত করেন। এই বিশ্বকোষ তাঁকে খ্যাতি এনে দেয়। ইবনে সিনা ছিলেন অত্যন্ত স্বাধীনচেতা মানুষ। আত্মমর্যাদার প্রশ্নে আপোষহীন। ধন সম্পদের প্রতি কোন মোহ ছিলো না। শুধু জ্ঞান চর্চাই ছিল তাঁর আরাধ্য। নিজের স্বাধীনতা ও সম্মান অন্যের কাছে বিকিয়ে দিতে রাজি ছিলেন না কোন সময়। অন্যায়ভাবে কারো কাছে মাথা নত করতে জানতেন না। বিনা যুক্তিতে কারো মত মানতেনও না। এমনকি ধর্মের ব্যাপারেও যুক্তির সাহায্যে সিদ্ধান্ত নিতেন। সেই কালে অনেকে তাঁকে ধর্মীয় উগ্রপন্থী এবং পরে কয়েকজন বিখ্যাত পন্ডিত ‘কাফের’ বলে ফতোয়া দেন। যারা এই নিষ্ঠুর পতোয়া দিয়েছিলেন, তারা ভুল বুঝেছিলেন। আসলে তিনি ছিলেন খাঁটি মুসলমান। যারা তাঁকে কাফের বলেছিলেন, তাদের উদ্দেশ্যে একটি কবিতা লেখেন ইবনে সিনা। এতে লিখেছেন তিনি, “ যারা আমাকে কাফের বলে আখ্যায়িত করে, তারা পৃথিবীতে বিখ্যাত হোক। এতে আমার আপত্তি নেই। তবে আমার মতো যোগ্য ব্যক্তি তোমরা পাবে না। আমি এ কথাও বলতে চাই যে, আমি যদি কাফের হয়ে থাকি, তাহলে দুনিয়ায় মুসলমান বলতে কেউ নেই। পৃথিবীতে যদি একজন মুসলমানও থাকে, তাহলে আমিই সেই ব্যক্তি।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক।

 

- Advertisement -spot_img

আরো পড়ুন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisement -spot_img

সর্বশেষ খবর