ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ পৃথিবীর অন্যতম আধুনিক মতবাদ। কমিউনিজম বা মানবতাবাদের মতো এতটা প্রসারিত না হলেও ধর্ম, বর্ণ বা গোত্রের নামে মানুষ যেভাবে একত্রিত হয় তার থেকে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের গতি অনেক প্রসারিত। ভাষা যতখানি বাস্তবতা ধর্ম-বর্ণ বা গোত্র অতখানি বাস্তবতা নয়। ভাষা মানুষের জীবনযাপনের যতটা গভীরে, ধর্ম-বর্ণ বা গোত্র সেটা নয়। ধর্ম-বর্ণ বা গোত্র মানুষকে একটি গন্ডির ভেতর আবদ্ধ করে ফেলে, যে আবদ্ধ হাওয়া প্রতি মুহূর্তে অন্ধকারকে আরও গাঢ় করে। মানুষকে তাই অন্ধকারের দিকে ঠেলে।
এর বিপরীতে ভাষাভিত্তিক সংগঠিত মানুষের চেতনা সব সময়ই চেতনা ও চিন্তার গভীরে নিয়ে যেতে সহায়ক হয়। পরিশীলিত করে মানুষকে। এ কারণে ভাষা ভিত্তিক জাতীয়তাবাদে ধর্ম, বর্ণ বা গোত্রভিত্তিক সংগঠিতদের থেকে উন্মাদনা কম, পরিশীলন বেশি। আমরা ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের একটি জাতি। আমাদের জাতীয়তার উৎপত্তি ভাষা থেকে। আমরা যে ভৌগলিক সীমারেখা অর্জন করতে পেরেছি সেখানেও বড় অবদান ভাষার। এই ভাষাভিত্তিক জাতীয়তা ও ভৌগলিক সীমারেখা হবার কারণে আমাদের রাষ্ট্রীয় চেতনার জন্ম আধুনিকতার ভেতর দিয়ে। আমাদের রাষ্ট্রীয় চেতনার দলিল সংবিধানের জন্ম ঘটে আধুনিক গর্ভ থেকে। যে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র আমাদের সংবিধানের জঠর্ সেটা সম্পূর্ণ আধুনিক রাষ্ট্র চেতনার। সেটা সম্পূর্ণ আধুনিক রাষ্ট্র চেতনার। অবশ্য যতটা আধুনিক দলিল আমরা প্রণয়ন করতে সমর্থ হয়েছিলাম ততটা – আধুনিকতা আমরা ধরে রাখতে পারেনি। এমনকি আমাদের সর্বোচ্চ আদালতে হস্তক্ষেপের পরে অনেকখানি উদ্ধার হয়েও সেই অর্জিত আধুনিকতার সবটুকু আমরা ফেরত পাইনি।
আর আমাদের প্রথম অর্জন, অর্জিত সম্পদ হারিয়ে যাওয়া এবং ট সর্বশেষ এই ফেরত পাবার মধ্যে অনেক কিছু ঘটে গেছে। যার তা বড় অংশ ছিল আমাদের জাতিকে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তা থেকে টেনে ধর্মভিত্তিক (যা বাস্তবে ভুল ধারণা) জাতীয়তায় পরিণত করা এবং এই সময়টা আমাদের স্বাধীনতা উত্তর জাতীয় জীবনের অনেকটা সময়। এই সময়ের ভেতর আমাদের কয়েকটি প্রজন্ম বড় হয়ে উঠেছে। এই প্রজন্ম ক’টি বড় হয়েছে বেশ বৈপরীত্য নিয়ে। সকল বৈপরীত্য যেমন একটি লেখায় উল্লেখ করা সম্ভব নয়, তেমনি সব অতি সহজে ক ক ক ত খুঁজে বের করা সম্ভব নয়। কারণ একটি সমাজকে যখন জোর ক করে আধুনিকতা থেকে অন্ধত্বতে ঢুকিয়ে দেয়া হয় তখন মূলত সমাজকে এক ধরনের লৌহ নির্মিত অন্ধকার কারা প্রকোষ্ঠে ফেলে দেয়া হয়। একটি স্বাভাবিক জীবনে বেড়ে ওঠা মানুষের সঙ্গে একটি কারাগারে বেড়ে ওঠা মানুষের যে পার্থক্য থাকে- এখানেও তেমনটি ঘটে যায়। আমাদের সমাজেও তেমন ঘটে গেছে।
কারাগারে কারও কারও ভেতর খাঁচার পাখির চরিত্র জন্ম নেয়। সে উড়তে ভুলে যায়। আমাদের সমাজে তেমনটি ঘটেছে। আমাদের অনেকেরই পাখা উট পাখির মতো ছোট হয়ে গেছে। তাই গোত্রে পাখি হলেও অসীম আকাশ বিচরণ ক্ষেত্র নয়। কেবল বালুময় ঊষর মরুভূমিই তাদের বিচরণ ক্ষেত্র। যেখানে কোন ফুল, ফল বা শস্য জন্ম নেয় না। আবার আরও একটু এগুলে দেখা যাচ্ছে, এই যারা কারাগারে থেকে কেবল ওড়া ভুলে গেছে তারাও অনেক ভাল অন্তত তাদের থেকে, যারা অপরাধী হয়ে গেছে। কারগারে থেকে নানান অপরাধী মন জন্ম নিয়েছে এবং এরা সকলেই আমাদের সমাজের ও আমাদের জনগোষ্ঠীর অংশ। অন্ধকার প্রকোষ্ঠে ফেলে জনগোষ্ঠীর যখন এই পরিবর্তন ঘটানো হয়েছে এবং এই পরিবর্তিত একশ্রেণীর মানুষ যখন সমাজ ও রাষ্ট্রের অংশ সেই সময়ে আবার রাষ্ট্র তার ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ সংবলিত সংবিধান উদ্ধার করতে পেরেছে। তবে সম্পূর্ণটুকু পারেনি, বরং সেখানে সৃষ্টি হয়েছে আরেক বৈপরীত্য; যা সোনার পাথরের বাটির মতো। কারণ যে সংবিধান ভাষাভিত্তিক বাঙালী জাতীয়তাবাদকে স্বীকৃতি দিচ্ছে ওই সংবিধান ধর্মকেও রাষ্ট্রের বলে স্বীকৃতি দিচ্ছে। ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ ও ধর্মকে রাষ্ট্রের বলে স্বীকৃতি এই দুই এক সঙ্গে চলতে পারে না। এটা কেবল বৈপরীত্য নয়, ভুলও। তাই এই বড় ভুল যখন আমাদের বর্তমান বাস্তবতা তখন শরীরের কতটুকু অংশ এখনও কারা প্রকোষ্ঠে সেটা চিন্তার বিষয় এবং এটাও ভেবে দেখা দরকার, শরীরের কোন অংশ কারাগারে। মাথা কারা প্রকোষ্ঠে না পায়ের দিকটা। যদি পায়ের দিকটা হয় সেটা হয়ত অতি সহজে টেনে বের করা সম্ভব হবে, কিন্তু মাথা যদি এখনও কারাগারে থেকে থাকে তাহলে এখনও অনেক দুর্গম পথ সামনে। যদি পথ দুর্গম হয়, তাহলে দুটি প্রশ্ন সামনে চলে আসে।
এক, এই দুর্গম পথ যাত্রার সাথী হবে কে? দুই, এই দুর্গম পথযাত্রা কি এখন ভাষাভিত্তিক জাতীয়তার পথে না একটি সামগ্রিক আধুনিকতার পথে? শুধু ভাষাভিত্তিক জাতীয়তার পথে যাত্রা করার পরিবেশ এখন কি আর পৃথিবীতে আছে! কারণ রাষ্ট্রীয় আধুনিকতা ইতোমধ্যে তার পরবর্তী সিঁড়িতে পা দিয়েছে। যে কারণে এখন একটি সামগ্রিক আধুনিকতার পথেই যাত্রার সময়। হয়ত তার ভিত্তি হতে পারে। ভাষাভিত্তিক জাতীয়তা কিন্তু লক্ষ্য হবে মহামিলনে অর্থাৎ বিশ্বায়নে। একটি মিলনের পৃথিবী এখন বাস্তবতা । এটা কোন মতেই কোন বুর্জোয়া অর্থনীতি বা বুর্জোয়া রাষ্ট্র চিন্তার ফল নয়, বরং এর চরিত্র মিলে যায় কমিউনিজমের আন্তর্জাতিকতাবাদের সঙ্গে এবং এই বহুকে রক্ষা করে একক মানববিশ্বথ এটা বাস্তবতা, যা ইতোমধ্যে আমাদের ভাষাভিত্তিক জাতীয়তার আন্দোলনের স্মারক দিনকে নিয়েও ঘটে গেছে। বাংলাভাষার আন্দোলনের স্মারক দিবসটি আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা টি দিবস। অর্থাৎ প্রতিটি ঘটনায় এসে সকলের হাত পড়ছে। একের হাতের ওপর অন্যের হাত রাখছে। একটি সামষ্টিক চিন্তা এসে বড় হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
পৃথিবীর এ সময়ে সামগ্রিক প্রপ আধুনিকতার পথটি তাই স্বাভাবিক সঠিক পথ হয়ে সামনে আসে। সামগ্রিক আধুনিকতার সব থেকে বড় দিক হলো, গ্রহণ কর উদারভাবে, সৃষ্টি কর আধুনিকতার নতুন সোপান। এই নতুন সোপান নিয়ে যদি আমরা ভাবি তাহলে আমাদের ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাকে ভিত্তি ধরে, তার সকল উপাদানকে শ্রদ্ধা করে একটি সামগ্রিক আধুনিকতার দিকে যেতে হবে। সেই আধুনিকতার চেতনা নতুন মিলিনিয়ামের এক দশক পরের ও আরও দুই দশকের সামনের চেতনা। তাই যত বড় ঐতিহ্য ষাটের দশক হোক না কেন, আজকের আধুনিকতা ও আধুনিক রাষ্ট্র গড়ার চিন্তা করতে হলে নতুন মিলিনিয়ামের এক দশক পার করে এসে পৃথিবী যেখানে দাঁড়িয়েছে সেখান থেকে শুরু করতে হবে। আর সেই শুরুর কোন উদ্যোগ নেই। এটাই বাংলাদেশের বর্তমানের সব থেকে বড় সঙ্কট।
বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীকে অন্ধকার কারা প্রকোষ্ঠে ফেলে এই সঙ্কট সৃষ্টি করা হয়েছে। কারাগারে থাকার কারণে এর একটি অংশ অন্ধ 1 হয়ে গেছে। তারা চলে গেছে সেই অন্ধকার আচ্ছন্ন মধ্যযুগে। न আরেকটি অংশ পেছনে চলে না গেলেও আর এগুতে পারেনি। তারা অনেকটা বনসাই হয়ে গেছে। বসে আছে সেই ষাটের দশকে। তাই বাংলাদেশকে মধ্যযুগে নিয়ে যাবার এই ঘোর দুর্দিনের সমাধান করার চেষ্টা হচ্ছে তাকে বিগত ষাটের দশকে টেনে তোলার চেষ্টার ভেতর দিয়ে। কিন্তু দেশকে টেনে তুলতে হবে নতুন মিলিনিয়ামের এক দশক পার হবার চেতনার সৈকতে। কিন্তু সেখানে টেনে তোলার কোন হাত এখনও দেখা যায়নি। নতুন মিলিনিয়ামের চেতনায় তৈরি হওয়া হাতগুলো এখনও দেশকে টেনে তোলার জন্য তৈরি হয়নি বা তাদের কোন প্রস্তুতি, কোন পদক্ষেপ দেখা যায় না, তাই সময়ের সামগ্রিক আধুনিকতা দিয়ে কোন কিছু নির্ধারণ হচ্ছে না। আর তাদের সময়ের আধুনিকতা দিয়ে সামগ্রিক আধুনিক রাষ্ট্র তৈরির কাজটি শুরু না হওয়া অবধি কোনভাবেই দেশ নতুন পৃথিবীতে পা রাখতে পারবে না। অন্ধকারাচ্ছন্ন মধ্যযুগ থেকে বিগত ষাটের দশকের ভেতরই দেশ ঘোরাফেরা করবে। ভাষা চেতনা, জাতীয়তা চেতনা, রাষ্ট্র চেতনা ওই সময়সীমার ভেতর ঘোরাফেরা করবে। কোন মতেই বর্তমানে পা রেখে ভবিষ্যতকে স্পর্শ করতে পারবে না।