Free Porn
xbporn

buy twitter followers
uk escorts escort
liverpool escort
buy instagram followers
Galabetslotsitesi
Galabetsondomain
vipparksitesigiris
vipparkcasinositesi
vipparkresmi
vipparkresmisite
vipparkgirhemen
Betjolly
Saturday, July 27, 2024

সলতে

সৌরভ হাওলাদার

মেঘের মতো দরজা খোলে। মনের আলো উপচে এসে পড়ে। কেউ দেখে রামধনু, কেউ বোঝে বর্ষা। রতনপুর গ্রামের বাইশার বিল ধারের ধান মাঠে ঘাস নিড়িয়ে দিচ্ছে কয়েকজন মেয়ে। মেঘের দরজা ধানের শীষে প্রাণ ভরে দিয়েছে, মেয়েরা বুঝতে পারে। তাদের একজন গান গাইছে। সে গান মেঘে জলে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে, “কালো মেঘ দিয়া রে, মেঘরাজা বানাইল রঙমহল…”

সলতে-র গানের গলাটি মিঠে, তা সে নিজেও জানে। রতনপুর সদর আর এই বাইশার বিল সংলগ্ন গ্রামেই তার কুড়ি বছরের জীবন কেটে গেল। ফোনের ভেতর এখন অনেক ‘রঙিন হাতছানি’ ডাক দেয়। গান গেয়ে কত শুঁয়োপোকা গুটি কেটে প্রজাপতির পাখায় উড়াল দিল। এমন ভাগ্য কি সলতের হবে না? এই গ্রামেই বাকি জীবন কাটবে? বড় সংশয় হয়।

মাঠ থেকেই খেয়াল করে, দূরের রাস্তায় দুজন সাইকেল করে যেতে যেতে দাঁড়িয়ে গেল। একজনকে দেখে মনে হয় অধীরদাদা, সম্পর্কে পিসির ছেলে, কিন্তু অন্যজন কে? এখান থেকে মুখ বোঝা যায় না। ওরা কি ওর গান শুনে দাঁড়ালো? নিজের মনে একবার হেসে নেয় সলতে। আবার কাজে মন দেয়।

আলো আর অন্ধকারের বুনোট নিয়ে এক জন্ম থেকে অন্য জন্ম পার হয়ে যায়। জন্মান্তরের জন্য মৃত্যুর অপেক্ষায় থাকতে হয় না। কয়েক বছরের ব্যবধান যেন বুঝিয়ে দেয়, ফেলে আসা সময়, ঠিক কোনো বিস্মৃতির ওপারের ঘটনা। রতনপুর স্কুল পেরোনোর প্রায় দশ বছর পর দেখা অধীর আর বিধানের। পুরানো বন্ধুকে দেখে, দুজনেই উচ্ছাসে স্টেশনের ধারে চায়ের দোকানে বসে। সব কিছুতে বদল এলেও এই দোকানটি যেন প্রাগৈতিহাসিক চিহ্ন বুকে নিয়ে রয়েছে। আধো অন্ধকার, কালো হয়ে যাওয়া বাসন, উঁচু হয়ে থাকা চা-পাতার স্তূপ আর বয়সের গাছপাথর হারিয়ে ফেলা চায়ের দোকানি নিজে।

অধীর মুম্বাইতে গয়নার দোকানে কাজ করে। দিন সাতেকের ছুটি নিয়ে রতনপুর ফিরেছে, কিছু কাজ আছে। বিধান এযাবৎ ঠাঁইনাড়া হয়নি। রতনপুর লাগোয়া গ্রাম রাঙাবন-এ  পৈতৃক ভিটে। সেখানেই জমিতে আবাদ করে, মা-আর ছেলের চলে যেত। গত বছর মায়ের মৃত্যুর পর, এখন সে একা। স্টেশনের কাছে এসেছিল মহাজনকে টাকা দিতে। বিধানকে দেখে অধীর অবাক হয়ে বলে, “তোর তো একটা বিয়ে করা উচিত। একা একা কি থাকা যায়?”

“তুই করেছিস?”

“এখনও করিনি। বাড়িঘর ঠিক করতেই সব রোজগার খরচ হয়ে গেল। তোর তো আর সেই সমস্যা নেই।”

বিধান হাসে, “বড্ড আলসেমি। অভিভাবক কেউ নেই, যে তাগাদা দিয়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসাবে।”

“তাহলে তোর বাড়ি ফেরার কোন তাগিদ নেই। চল আজ আমাদের বাড়ি।”

সত্যিই তো, এতদিন পর দেখা হলে, এটুকু আড্ডায় কি মন ভরে? অধীরের সাথে রতনপুরের ওদের বাড়ির দিকে চলল। আকাশে তখন মেঘ কেটে গেছে। এক পশলা বৃষ্টির পর, গাছপালা স্নান সেরে পরিপাটি হয়ে পথ আগলে দাঁড়িয়ে। দুই বন্ধু পাশাপাশি সাইকেল নিয়ে চলতে থাকে। দুইপাশে ফসলের ক্ষেত, একরাশ ভালোবাসার কথা নিয়ে মাটির কাছে, মেঘ ঝুঁকে পড়ে। ভিজবে বলে মাটিও অপেক্ষায় থাকে বর্ষার। কোথা থেকে যেন গান ভেসে আসছে। খুব সুরেলা মেয়ের গলায় কেউ গাইছে।

বিধান থমকে দাঁড়িয়ে বলে, “কে গাইছে রে?”

অধীর বলে, “সলতে হতে পারে। শ্রীনিবাস মামার মেয়ে। ও এখন বেশ নাম করেছে। ফেসবুক ইউটিউব-এ ওর গানের অনেক শ্রোতা।”

সাইকেল টেনে দুজনে অধীরের বাড়ি এসে উপস্থিত হয়। গ্রামের ছোট বাড়ি যেমন হয়, সামনে পরিপাটি করে গুছোনো উঠোন, বৃষ্টি হয়ে মাটিতে জলের দাগ। ডান দিকে তুলসী মঞ্চ, একটা মাচাতে কুমড়ো লতা বাইয়ে দেওয়া, পাতাগুলো জলে ভিজে ডগডগে হয়ে আছে। পিছনে পুকুর, তারপর টান করা ধান ক্ষেত। অধীর মুম্বাই থেকে নিয়মিত টাকা পয়সা পাঠিয়ে বাড়িটা পাকা পোক্ত করেছে। অধীরের বাবা এখনও হাট থেকে ফেরেনি। অধীরের দাদা বিয়ে করে আলাদা হয়ে গেছে।

অধীরের মা দুই বন্ধুকে যত্ন করে খেতে দেয়। খাওয়া শেষে ওরা মাঠের দিকে গিয়ে, একটা খেজুরপাতার চাটাই পেতে বসে। ভেজা ঘাসে পোকা মাকড় চরছে আর কয়েকটা বক সেই সব খুঁটে খুঁটে খাচ্ছে। দিগন্তপার থেকে হু হু হাওয়া এলোমেলো করে দেয়। এমন সময়, আলপথ ধরে হেলতে দুলতে একটা নারী মূর্তিকে অধীরদের বাড়ির দিকে আসতে দেখা যায়। কাছে আসতে বোঝা যায় শ্যামলা বরণ মেয়েটা, বেশ ধারালো চেহারা। পরিশ্রম করা মুখে ঘাম আর বৃষ্টি জমে আছে। অধীর বলে ওঠে, “কীরে? মাঠে তুই গাইছিলি নাকি?”

মেয়েটি ঝপ করে উত্তর করে, “কেন? নিষেধ আছে?”

বিধান বলে ওঠে, “না না নিষেধ কেন হবে? খুব ভালো লাগছিল।”

অধীর বলে, “এই হল সলতে, শ্রীনিবাস মামার মেয়ে।”

সলতে এবার একটু অপ্রস্তুত হয়ে যায়, “তোমরা শুনছিলে?”

অধীর বলে, “ভালোই তো গাইছিলি। বিধান তো সাইকেল থেকে নেমে দাঁড়িয়ে গেলো।”

সলতে আর দাঁড়ায় না। মাথা কাত করে দ্রুত হেঁটে বাড়ির দিকে চলে যায়। চলার পথের গতি যেন বিধানের মনের ভেতর গেঁথে যায়।

সে রাতে, খাওয়া দাওয়ার পর দুই বন্ধুর ঘুম আসে না। এত বছরের জমানো গল্পের খনন হতে থাকে। কথার মধ্যে বার কয়েক সলতে-র নাম উঠে আসে। বিধানের চোখ মুখে প্রতিবার যেন বর্ষা মেঘের ছোঁয়া লেগে যায়। অধীর বলেই ফেলে, “তোর কি ওকে পছন্দ হয়েছে?”

তখন ভীষণ জোর শব্দ করে বাজ পড়ে, আর সাথে সাথেই তুমুল বৃষ্টি শুরু হয়ে যায়। বিধান বলে, “আবার বৃষ্টি শুরু হল। কোথাও জানলা খোলা নেই তো?”

অধীর উঠে যায় সরজমিনে দেখে আসতে।

রাতে খাওয়ার সময় বাবা মার কাছে অধীর তার বন্ধুর জন্য প্রস্তাব করে, “ঝাড়া হাত পা বিধান। জমি জিরেত থেকে সারা বছরের খোরাকি হয়ে, বাড়তি কিছু রোজগারও হয়। একটা পরিবারে আর কী চাই?”

ক্রমে কথাটা সলতে-র কানে যেতে চমকে ওঠে। বিধানকে এক ঝলক দেখে যে খারাপ লেগেছে তা নয়, কিন্তু ওর গানের কী হবে? গ্রামের ছেলেদের সেই মন মানসিকতাই নেই, যে বউকে বিয়ের পর গান গাইতে দেবে। আর গান তো শুধু ঘরে বসে হারমোনিয়াম বাজিয়ে গলা সাধা নয়, সলতে জমিয়ে রেখেছে স্বপ্ন, যে স্বপ্ন ইউটিউব, টিকটক, ইনস্টা, ফেসবুক ঘুরে কলকাতা মুম্বাই উড়ে যায়।

একদিন সুযোগ বুঝে বিধানের সাথে দেখা করে। ততদিনে অধীর নিজের আস্তানায় ফিরে গেছে। রতনপুর থেকে দুই স্টেশন উজিয়ে একটা প্রায় আধুনিক চায়ের দোকানে গিয়ে বসে। বিধানের কাছে পঞ্চাশ টাকার চায়ের কাপ, অনেক দামী। তবু হবু বউএর ডাকে এখানে এসেছে। সলতে কথার শুরুতেই দাবী পেশ করে, “আমাকে কিন্তু গান গাইতে দিতে হবে।” তারপর আবার তার সাথে যোগ করে, “শুধু ঘরে বসে গান নয় কিন্তু। ভেবেচিন্তে বলবেন।”

“আপনি মানে তুমি স্টেজ-এ গান গাইবে নাকি?”

“শুধু স্টেজ কেন? টিভিতে বা সিনামাতেও গাইতে পারি।”

বিধান কী উত্তর দেবে বুঝতে পারে না, একটু থেমে বলে, “আমার বাড়িতে বাধা দেবার কেউ নেই, তবে এইসব লাইনে কী করতে হয়, সে সব জানা নেই। তোমাকেই সে সব খুঁজে নিতে হবে।”

সলতে বলে, “আপনার আপত্তি নেই তো? বাকী আমি খুঁজে নেবো।”

একটা বয়সে, সব স্বপ্নগুলো নাগালের মধ্যে মনে হয়, যেন ছোঁয়ার অপেক্ষাতে তারা সব আকাশ থেকে ঝুলে রয়েছে। চায়ের দোকান থেকে বের হয়ে স্টেশন যাওয়ার রিক্সাতে উঠলো, আর ঠিক তখনই বৃষ্টি ঝেঁপে এলো। সলতে বোঝে, গ্রামের ভেতর হয়তো এর থেকে ভালো পাত্র সে পাবে না; আর বিধান ভাবে, ওর একাকী জীবনে একজন কেউ তো আসবে। বয়স আর বৃষ্টি, যৌক্তিকতার যোগ বিয়োগ বোঝেনা। পাশাপাশি বসে থাকতে থাকতে ওদের শরীরে আগুন ধরে যায়। পুড়তে থাকে দুজনের ঠোঁট, হাতের আঙুল।

এরপর শুভদিন দেখে লোক খাইয়ে সলতে-কে নিজের ঘরে নিয়ে আসে বিধান। ছোট দু’কামরার বাড়ি, সামনে এক টুকরো বারান্দা। উঠোন একটা আছে, তা সব আগাছায় ভর্তি। বিধান সরল মনে বলে, “মা যাওয়ার পর বাড়ির ছিরিছাঁদ নষ্ট হয়ে গেছে। এখন তোমাকে একটু ঠিকঠাক করে নিতে হবে।”

সলতে শোনে, কিন্তু কোন উত্তর করে না। ওদের বাইশার বিলের গ্রাম আর এই  রাঙাবন-এ কোন তফাত খুঁজে পায় না। বিয়ের পর বাবা-মার গলগ্রহ থেকে মুক্তি পেলো বটে, কিন্তু আবার নতুন কোনো ফাঁদে পড়ল কিনা, বোঝে না। ওর মনে জমে আছে আকাশ ছোঁয়ার ইচ্ছে। একদিন এই মাঠঘাটের মামুলি জীবন থেকে উড়ে যাবে। সলতে জানে, বাইশার বিল থেকে রাঙাবন সেই উড়ালের পথ নয়।

অধীর কয়েকদিন আগেই ঘুরে গেছে, তাই বিয়েতে আর আসতে পারেনি। তবে ওদেরকে বলে রেখেছে হানিমুনে যেন মুম্বাইতে আসে। মুম্বাইএর নামেই সলতে-র মন চঞ্চল হয়ে ওঠে। বিধানকে ঠেলতে থাকে, “চলো না, দাদার ওখান থেকে ঘুরে আসি।”

মাঠে রবিশস্যের চাষ দেওয়া হয়ে গেছে, এখন সপ্তাহ খানেকের ছুটি নেওয়া যায়। ঘরে তক্তোপোষের ওপর পাতা তোষক, গুটিয়ে রাখে। দরজা জানালা ভালো করে বন্ধ করে, তালা দিয়ে, দুজনে রওনা দেয়, মুম্বাইএর উদ্দেশ্যে।

অধীরের ছোট আস্তানা, সঙ্গী নিয়ে থাকার মতো নয়। তার ওপর, আরও অনেকের সাথে ভাগ করে থাকে। বিধানদের জন্য কাছাকাছি একটা সস্তার হোটেলে ব্যবস্থা করে দিয়েছে। বাইরে কাচ দিয়ে ঘেরা কিন্তু ভেতরে ঢুকলেই বোঝা যায়। ফুটপাথ দখল করে বেআইনি অস্থায়ী নির্মাণ। পুরোটা লোহার খাঁচা। সিঁড়ি, মেঝে, দেওয়াল সব। ঘরের ভেতর হাঁটলেও ক্যাঁচক্যাঁচ করে আওয়াজ হয়। সলতের অবশ্য খারাপ লাগে না। তবে জায়গাটা যেন কেমন! হিন্দি সিনামায় দেখা সুন্দর পথঘাটের মতো নয়। বরং রাস্তার দুই পাশে, নোংরা পুরানো ভাঙা আসবাব ডাঁই করা। রতনপুরের বাইরে এসে রাত কাটানো এই প্রথম, তাও আবার মুম্বাইএর মতো শহরে। রাতে অধীরের সঙ্গে একসাথে একটা কমদামি রেস্তোঁরায় খায়। অধীর ফিরে গেলে, ওরা হোটেলে চলে আসে।

গভীর রাতে অনেকের চেঁচামেচিতে ঘুম ভাঙে। হোটেলে পুলিশ এসেছে। সব ঘর থেকে, জোড়া জোড়া ছেলে মেয়েকে টেনে বার করছে। ওদেরকেও বাদ দেয়না। বিধান আর সলতে কাকুতি মিনতি করে বলে যে ওরা স্বামী স্ত্রী, এখানে বেড়াতে এসেছে। পুলিশ কোন কথা শোনে না, ওদের ধরে থানায় নিয়ে যায়। সেই রাতে অধীর খবর পেয়ে, হন্তদন্ত হয়ে আসে। ভালো করে বোঝানোর পর ওরা ছাড়া পায়। দারোগা বলে, “এই রকম বেআইনি হোটেলে অনেক খারাপ কাজ হয়। এখানে উঠবেন না।” বিধান আর সলতে জবাব দেওয়ার মতো অবস্থায় ছিল না। অধীর উত্তর দেয়, “পরের দিন অন্য হোটেল ঠিক করে দেবো।”

ঘরে ফিরে বিধান বলে, “আর এখানে থাকা নয়। কালকেই ফেরার টিকিট কাটবো।”

সারা রাস্তা সলতে কোন কথা বলেনি। বিধানের কথা শুনে বলে, “আমি কিন্তু যাবো না।”

বিধান কথাটার অর্থ বোঝেনি, জিজ্ঞেস করে, “মানে?”

“মানে কিছু না, আমি এখানে কিছুদিন থাকতে চাই।”

“এখানে? কী কারণে?”

“আমি কয়েকটা জায়গায় গান শোনাতে যাবো।”

“গান?”

“বাঃ রে! এত বড় ইন্ডাস্ট্রি! এদের গান লাগবে না?”

বিধান বলে, “তুমি চেনো?”

“চিনে নেবো। আমার কাছে এখানে আসা একটা স্বপ্ন। সেটা পূরণের চেষ্টা না করে তো ফিরবো না।”

পরদিন সকাল হতেই অধীর এসে হাজির হয়। ওদেরকে অপেক্ষাকৃত ভালো জায়গাতে নিয়ে যায়। হোটেলে ঢোকার আগে বিধান বলে, “আমি আজকেই ফেরত যেতে চাই।”

শুনে অধীর আর সলতে দুজনেই চমকে ওঠে। অধীর বলে, “কালকের ঘটনার জন্য আমি দায়ী। আমি সস্তা করতে গিয়ে, ওখানে ঠিক করেছিলাম। এবার আর হবে না। এত কান্ড করে এসেছিস, এভাবে চলে যাব, বললেই যাওয়া যায় নাকি?”

সলতে বলে, “ও যায়, যাক। আমি থাকবো। আমায় ঘর দেখে দাও।”

নতুন বউকে বিধান ঘাঁটাতে চায় না। চুপ করে থাকে।

সেদিন দুজনে কাছাকাছি ঘোরাঘুরি করে। অধীর নিজের কাজে চলে যায়। রাতের খাওয়ার সময় আবার একসাথে হয়। একটা পেল্লায় শপিং মলে খেতে এসেছে। ফটকের সামনে দুজন রক্ষী লোকজনকে পরীক্ষা করে ভেতরে ঢুকতে দিচ্ছিল। একদিকে ছেলেরা অন্যদিকে মেয়ে। সলতে যখন রক্ষী মেয়েটির কাছে পৌঁছয়, মেয়েটি পরিস্কার বাংলায় বলে, “কটা বাজলো?”

সলতে বাংলা শুনে অবাক হয়ে বলে, “প্রায় সাড়ে আটটা।”

“আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না। টানা বারো ঘন্টা একভাবে দাঁড়িয়ে থাকা যায়?”

সলতে অবাক হয়ে তাকায়, “আপনি বাঙালি?”

“আমার বাড়ি মুর্শিদাবাদে। এখানে চাকরি করতে আসা। আপনারা বেড়াতে?”

সলতে প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে নিজে পাল্টা প্রশ্ন করে, “কোথায় থাকেন? ফ্যামিলির সাথে?”

“আমার বাড়ির লোক মুর্শিদাবাদেই আছে। মীরারোডে একটা মেয়েদের হোস্টেল আছে, আমি সেখানে একাই থাকি।”

সলতে চট করে বলে, “সেই হোস্টেল আর আপনার ফোন নম্বর পাওয়া যাবে?”

সলতে ফোন নম্বর আদান প্রদান করে, ততক্ষণে বিধান আর অধীর দূরে চলে গেছে।

সলতে হোস্টেলের সাথে কথা বলে, একটা বেড বুক করে ফেলে। আর অধীরকে বলে, “আমাকে কাল ওখানে নিয়ে একটু রাস্তাঘাট চিনিয়ে দেবে। টাকাও জমা দিতে হবে।”

বিধান আর অধীর অবাক হয়ে দেখে, সলতে-র জেদ। বিধানের কোথাও যেন তাল কেটে যায়। আরও দিন দুয়েক থাকল মুম্বাইতে, তারপর হোস্টেলে মাসখানেকের টাকা দিয়ে ফেরত চলে আসে। সলতে হাসিমুখে বিদায় জানিয়ে বলে, “চিন্তা কোরো না, অধীরদাদা তো রইল। আর আমি রোজ ফোন করব।”

অধীর এসেছিল, ট্রেনে তুলে দিতে। বিধান অবাক চোখে তাকিয়ে বলে, “তোর বোনকে ঠিক চিনতে পারলাম না। নতুন সংসার ফেলে, এইভাবে থেকে গেলো?”

“আমিও অবাক হয়েছি। আশাকরি ক’দিনের মধ্যেই তোর টান অনুভব করবে। তবে ওর মনের ভিতরের ইচ্ছেটার কথা ভাব। গানকে কতটা ভালোবাসে, সেটা ভাব।”বিধান একটা শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, “বেশ তা না হয় ভাবলাম, কিন্তু আমার কথাটা কেউ ভাববে না?”

দুই বন্ধুতে খুব বেশি কথা হয়না। নিঃশব্দে পরস্পরের হাত ছুঁয়ে থাকে। অধীর জানালার ভেতরে আর বিধান প্ল্যাটফর্মে। ট্রেন চলতে শুরু করে। বিধান ক্রমশঃ অপসৃয়মান স্টেশনের দিকে তাকিয়ে থাকে। একবার মনে হয়ে ট্রেন থেকে নেমে যায়, পরমুহূর্তে ভাবে ‘কার জন্য?’ ট্রেনের গতি বাড়তে থাকে। এ কোন জন্মের স্টেশন ছেড়ে যাচ্ছে? আর কি কোনদিন এখানে আসবে? ফিরে আসলেই কি সলতেকে আর পাবে? ওকে কোনদিন কি আদৌ পেয়েছিল, নাকি পুরোটাই স্বপ্ন?

সারা রাস্তা বিধান নিজের ভেতর বোঝানোর চেষ্টা করে, কাজটা কি ঠিক হল? নতুন বউএর সব আবদার মেনে নেওয়া কি ঠিক? অধীরও জোর দিয়ে কিছু বলল না।

রতনপুর স্টেশনে ওকে একা নামতে দেখে অনেকেই তাকিয়ে থাকে। রাঙাবন-এর পথে কৌতুহলী মানুষ কম নেই। “বৌকে কি শ্বশুর বাড়ি রেখে এলে?” “তোমার স্ত্রী আসেনি?” “তোমাদের শরীর ভালো আছে তো?”

জবাব দিতে দিতে কাহিল হয়ে পড়ে। তার মধ্যে একজন তো বলেই ফেলে, “অধীরের মা তো, ওই মেয়ের নিজের পিসি নয়, গ্রামতুতো সম্পর্ক।” বিধানের বুকটা যেন হালকা হয়ে যায়।

অধীরের কথা মনে পড়ে, “সলতে-র ইচ্ছে”-র কথা বলেছিল। তবে কী ও সব জানতো? সেখানে বিধানের কোন ইচ্ছে অনিচ্ছে থাকবে না? আবার বিয়ের আগে, সেই দামী চায়ের দোকানে সলতে কথা আদায় করেছিল, বলেছিল ওর স্বপ্নের কথা। বর হিসেবে, স্ত্রীর স্বপ্নপূরণে বিধানের দায়িত্ব আছে। বিধান বুঝতে পারে না, ও কোনদিকে ঝুঁকবে? কোন পাল্লা ভারী?  সলতের দৃষ্টিকোণে যা স্বাভাবিক, তাকে বিধানের মেনে নিতে কেন কষ্ট হচ্ছে? ওর গান যদি সম্মান পায়, তবে তো বিধানের না-খুশি হবার কোন কারণ নেই। কিন্তু তবু এই ঘটনা, বিধানের কোথাও যেন আত্মসম্মানে এক বিরাট ধাক্কা দিলো! বড় ব্যথাময় সেই ধাক্কা। এই বয়সে কি কাঁদা যায়? রাস্তায় চলতে চলতে চোখ জ্বালা করতে থাকে।

ঘরে এসে চাবি ঘুরিয়ে তালা খোলে বিধান। কতদিন হাত দেওয়া হয়নি বলে ওজনটা খেয়াল নেই। আজ দরজাটা বেশ ভারি মনে হয়। একটু আওয়াজ করে পাল্লাটা সরে দাঁড়ালো। ঝপ করে একটা গন্ধ নাকে প্রবেশ করে। অনেকদিন ঘর বন্ধ থাকলে, একটা ঘ্রাণ তৈরী হয়। অনুপস্থিতির ঘ্রাণ। এই ক’দিনেই আশেপাশের আগাছা লকলক করে বেড়ে উঠেছে। সেই লতাপাতায় রাস্তা থেকে দরজা পর্যন্ত পথ ঢেকে গেছে। খাটের ওপর তোষক গুটিয়ে রেখে গিয়েছিল। তার ওপর ধুলোর আস্তরণ পড়ে আছে।

এতটা পথ পার হয়ে, বেশ ক্লান্ত। চেয়ারের ওপর ব্যাগটা রেখে, খাটে এসে বসে। ক্লান্তিতে শরীর এলিয়ে দেয় গোল করা তোষকের উপর। সঙ্গে সঙ্গে কিছু যেন নড়ে উঠল। পিঠের দিকে হলেও, বিধানের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় সাড়া দেয়। খুব ধীরে পিঠ তুলে নিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখার চেষ্টা করে। মিশমিশে কালো রঙের সরীসৃপের দেহের অংশ, আরও গোল হয়ে তোষকের ফাঁকে সেঁধিয়ে যাচ্ছে। মাথা বা লেজ বোঝা যায় ন। একটা মোটা কালো আঁশযুক্ত নলের মতো শরীর আরও গভীরে ঢুকে যাচ্ছে। মুহূর্তে বিধানের পা থেকে মাথা পর্যন্ত একটা শিহরণ বয়ে গেল। এক লাফে দরজার দিকে চলে আসে।

সেদিন পর্যন্ত যে ঘর বিধানের আশ্রয় ছিল, আজ অন্যদিক দিয়ে দেখে, সেই ঘরের জন্যই ও নিরাশ্রিত হচ্ছে।

- Advertisement -spot_img

আরো পড়ুন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisement -spot_img

সর্বশেষ খবর