নতুন শিক্ষাক্রমে শিক্ষার্থীদের পড়ার সুযোগ বিস্তৃত হলেও এর বিরুদ্ধে কিছু গোষ্ঠী ভয়াবহ মিথ্যাচারে নেমেছে বলে মন্তব্য করেছেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর সঙ্গে সরকারের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ইন্টারনেটের মাধ্যমে অপপ্রচারে নেমেছে উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, নতুন শিক্ষাক্রমে প্রশিক্ষণের অংশ নয় এমন কিছু ভিডিও ছড়িয়ে দিয়ে মিথ্যাচার করা হচ্ছে।
রবিবার সকালে রাজধানীর বাংলামটরে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে এক অনুষ্ঠানে শিক্ষামন্ত্রী এ কথা বলেন। অনুষ্ঠানে ৬৪ জেলার ৩০০ উপজেলার ১৫ হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ২৫ লাখ শিক্ষার্থীর জন্য প্রায় ৩১ লাখ নির্বাচিত বই বিতরণ হয়। অনুষ্ঠানে আটটি বিভাগের ১০টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধানেরা উপস্থিত থেকে বইগুলো গ্রহণ করেন।
স্ট্রেংদেনিং রিডিং হ্যাবিট অ্যান্ড রিডিং স্কিলস অ্যামাং সেকেন্ডারি স্টুডেন্টস স্কিমের আওতায় ‘পাঠাভ্যাস উন্নয়ন কর্মসূচি’ মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়ন করছে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র। এই কর্মসূচি মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন সেকেন্ডারি এডুকেশন ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম (এসইডিপি)-এর অন্তর্ভুক্ত।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়ানো ভিডিওগুলোর ব্যাখ্যা দিয়ে দীপু মনি বলেন, অতীতে শিক্ষকদের কোনো প্রশিক্ষণে বিরতির ফাঁকে বিনোদনের জন্য করা কিছু ভিডিও এখন ফেসবুকে ছড়ানো হচ্ছে। এসব ভিডিও বিনোদনের অংশ হিসেবে প্রশিক্ষণার্থীরাই করে থাকেন। সেসব ভিডিও এখন নতুন শিক্ষাক্রমের অংশ হিসেবে ছড়ানো হচ্ছে। উদ্দেশ্যমূলকভাবে নতুন ভিডিও তৈরি করেও বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে।
শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে অপপ্রচার করা হচ্ছে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর স্বার্থ হানি হওয়ার ভয়ে। কিছু ব্যক্তি এবং গোষ্ঠী শিক্ষাক্রমের বিরুদ্ধে অপপ্রচারে নেমেছেন। এর সঙ্গে এখন নির্বাচনের মৌসুমে কিছু ঝামেলা থাকেই। নির্বাচনের ক্ষেত্রে যারা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ থাকেন, তাদের উসকানি যুক্ত হয়ে গেছে। অতি ডান ও অতি বামের উসকানিও যুক্ত হয়ে গেছে।’
নতুন শিক্ষাক্রমে দেশের আট শতাধিক বিশেষজ্ঞ জড়িত ছিলেন উল্লেখ করে ডা. দীপু মনি আরও বলেন, ‘সবাইকে কোনও না কোনোভাবে এর সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। ওয়েবসাইটে রেখে জনগণের মতামত, পরামর্শ নেওয়া হয়েছে এবং সংসদীয় কমিটিতে আলোচনা হয়েছে। সবশেষে প্রধানমন্ত্রীর কাছে উপস্থাপন করা হয়েছে, কিছু পরামর্শসহ তিনি অনুমোদন দিয়েছেন। আমরা পাইলটিং করেছি। তারপর আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু হয়েছে। সব বইগুলো পরীক্ষামূলক সংস্করণ। আমরা মনে করিনি আর পরিশীলন, পরিমার্জন দরকার নেই, একবারে চূড়ান্ত। আমরা মনে করি এই বইগুলো আরও পরিশীলন, পরিমার্জনের সুযোগ রয়েছে। সে জন্য সবার পরামর্শ গ্রহণ করছি।’
নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে মিথ্যাচারে কান না দিতে অভিভাবকদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের অভিভাবকরা দীর্ঘদিন থেকে অভ্যস্ত— সন্তান কত নম্বর পেলো; জিপিএ-৫ পেলো কিনা; প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় হলো কিনা; অন্যের সন্তানের চেয়ে আমার সন্তান বেশি নম্বর পেলো কিনা; এই বিষয়গুলো নিয়ে অতিমাত্রায় ব্যস্ত ছিলেন তারা। সে জায়গা থেকে বেরিয়ে প্রত্যেকটি কাজে সহযোগিতার জায়গায় তারা কাজ করছেন। এই বিষয়গুলোর জন্য বাবা-মায়ের কিছু সংশয় তো কাজ করছেই। সেগুলোকে কিছু গোষ্ঠী কাজে লাগাচ্ছে এবং মিথ্যাচার করছে।
শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘আপনার সন্তানদের দিকে তাকিয়ে দেখুন। আপনার সন্তান যদি সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে থাকে তাহলে তার আচার-আচরণ পরিবর্তন হয়েছে। সে কত নম্বর পেয়েছে সেদিকে নজর না দিয়ে সে শিখলো কিনা সেদিকে নজর দিন।’ এসময় নতুন শিক্ষাক্রমের বাস্তব প্রয়োগ দেখতে অভিভাবকদের ধৈর্য ধরারও আহ্বান জানান তিনি।
শিক্ষামন্ত্রী বলেন, পবিত্র ধর্মগ্রন্থে সৃষ্টিকর্তা নবীজিকে প্রথম কথাটাই বলেছিলেন ‘পড়ো’। যদিও আমরা ধর্মের কথা অনেক বলি এবং এই কথা যারা বেশি বলি তারাই আমাদের পড়া থেকে বেশি দূরে সরিয়ে দিতে চান। সেটিই বেশি কষ্টের জায়গা। কিন্তু আমরা সেই জায়গায় থাকতে চাই। আমরা আরও পড়তে চাই, জানতে চাই, শিখতে চাই। বর্তমানে নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী শিক্ষার্থীরা অনেক পড়ছে। শুধু পাঠ্যবইয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে না। শিক্ষার্থীরা নানা জায়গা থেকে তথ্য সংগ্রহ করছে। নিজেদের সঙ্গে আলোচনার মধ্য দিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছে এবং পরে সেগুলো উপস্থাপন করছে। ফলে শুধু মুখস্থ পড়ায় আর সীমাবদ্ধ নয়।
মন্ত্রী বলেন, এখন যারা প্রাথমিকে ভর্তি হচ্ছে তারা যে সময়ে কর্মজগতে প্রবেশ করবে এখন যে পেশা আছে এর ৬০ থেকে ৭০ ভাগ কোনো অস্তিত্বই থাকবে না, এমন গবেষণা হচ্ছে। তাহলে সেই সময়ের কর্মজগৎ কেমন হবে তা স্পষ্ট জানি না। তবে এটা আমরা জানি যে তখন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বেশ ভূমিকা পালন করবে। শিক্ষার্থীদের সেই প্রযুক্তির জগতের জন্য তৈরি করতে হচ্ছে। নতুন শিক্ষাক্রমের মাধ্যমে তারা নিজেদের খাপ খাইয়ে নেয়াই নয়, তারা ভবিষ্যতের পরিস্থিতিতেও সফল হবে। ফলে তারা অন্যের উদ্ভাবনের ব্যবহারকারীই হবে না তাদের উদ্ভাবনই সারা পৃথিবী ব্যবহার করবে।
অনুষ্ঠানে বিতরণ করা বইগুলো সম্পর্কে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, বইগুলো শুধু শিক্ষার্থীরাই পড়বে এমন নয়, পরিবারের অন্য সদস্যরাও চাইলে সেই সুযোগটা গ্রহণ করতে পারবেন। শিক্ষার্থীদের বই পড়া শেষে একটা মূল্যায়ন হবে। এই মূল্যায়নের মাধ্যমেই বোঝা যাবে কতগুলো বই কতটা ভালোভাবে শিক্ষার্থীরা পড়েছে।
মন্ত্রী বলেন, শিক্ষার্থীদের মন ও বয়স উপযোগী নানা ধরনের বই রয়েছে। জাতীয় পর্যায়ের খ্যাতিমান বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠিত একটি কমিটির মাধ্যমে বইগুলো নির্বাচন করা হয়েছে। যদিও এটি শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক, কিন্তু সামাজিকভাবেই পড়ার অভ্যাস তৈরি এবং এই অভ্যাস যতো বেশি এগিয়ে নেওয়া যায় সেই চেষ্টা করতে হবে। এই কর্মসূচির মধ্য দিয়ে প্রধান যে কার্যক্রমগুলো রয়েছে অর্থাৎ বই পড়ার অনুকূল পরিবেশ তৈরি, প্রতিষ্ঠানে বই পড়ার বিষয় তদারকি এবং সবাইকে বই পড়ায় উদ্বুদ্ধ করাসহ লাইব্রেরির মান উন্নয়নে সহযোগিতা করতে হবে। এছাড়াও ই-বই পড়ার কার্যক্রম এবং ডিজিটাল লাইব্রেরি করাও বর্তমানে খুব প্রয়োজন বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সভাপতি অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেন, ব্রিটিশরা যেমন আমাদের চা ধরিয়েছে তেমনি আমরা এ দেশের মানুষের হাতে বই ধরিয়েছি। ৪৫ বছর আগে আমরা মাত্র ১০টি বই দিয়ে বইপড়া কার্যক্রম শুরু করেছিলাম, আজ ৩১ লাখ বই কর্মসূচির কার্যক্রমের জন্য বিতরণ করা হচ্ছে। এটি আমাদের জন্য অনেক আনন্দের বিষয়। আমরা সারাদেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এই কার্যক্রম ছড়িয়ে দিতে চাই। মনকে বড় করার জন্য, জাতিকে উন্নত করার জন্য বই পড়ার কোনো বিকল্প নেই। আমরা বইয়ের সঙ্গেই সবসময় আছি এবং থাকব।
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক নেহাল আহমেদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সভাপতি ও পাঠাভ্যাস উন্নয়ন কর্মসূচির টিম লিডার অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সাঈদ, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (উন্নয়ন) এবং এসইডিপির জাতীয় কর্মসূচির সমন্বয়ক মোহাম্মদ খালেদ রহীম, এসইডিপির কর্মসূচি সমন্বয়ক এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (কলেজ) আনম আল ফিরোজ, স্ট্রেংদেনিং রিডিং হ্যাবিট অ্যান্ড রিডিং স্কিলস অ্যামাং সেকেন্ডারি স্টুডেন্টস স্কিমের পরিচালক প্রফেসর সৈয়দ মইনুল হাসান এবং বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের পরিচালক শামীম আল মামুনসহ অন্যান্য কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।