Free Porn
xbporn

buy twitter followers
uk escorts escort
liverpool escort
buy instagram followers
Galabetslotsitesi
Galabetsondomain
vipparksitesigiris
vipparkcasinositesi
vipparkresmi
vipparkresmisite
vipparkgirhemen
Betjolly
Saturday, July 27, 2024

এক জনমের পরে

রাত সাড়ে তিনটার দিকে শহিদ সাহেবের ঘুম ভেঙ্গে গেলো হঠাৎ। বুকে কেমন যেন চিনচিনে ব্যাথা করছে, ভয়ংকর পানির পিপাসা পেয়েছে। পাশের টেবিলের দিকে তাকিয়ে একটু হতাশ হলেন, রোজ পানি এনে রাখেন বিছানার পাশে। আজ আনেননি। বুকের ব্যাথাটা বাড়ছে, তার স্ট্রোক হচ্ছে নাকি! শহিদ সাহেব বালিশের পাশে হাতড়ে ফোনটা হাতে নিলেন, কাকে ফোন করবেন, কারুর নাম মনেও আসছেনা এই মুহুর্তে। হাতটা কেমন যেনো অবশ অবশ লাগছে, চোখে ভেসে উঠছে একটা মুখ, কিন্তু কিছুতেই নাম মনে করতে পারছেননা, অস্পষ্টভাবে তীব্র ব্যাথার মাঝেও খুঁজতে লাগলেন, কার মুখ…কার!
সকালবেলার কথা:
ঠক ঠক ঠক ঠক! কেউ এসেছে মনে হচ্ছে! এ সময় কে আসবে! সকাল বেলায় ঘুম থেকে উঠে কিছুক্ষণ খবর দেখেন শহিদ সাহেব। এর পরে আয়েশ করে রান্না বসান। রিটায়ারের পর এই তার রুটিন। এই সময়টায় কোন রকম ইন্টারফেয়ারেন্স তার ভালো লাগেনা। অবশ্য বিরক্ত করার মতো তেমন কেউ নেই ও তার। শহিদ সাহেব এপাড়াতে এসেছেন খুব বেশীদিন হয়নি। ব্যাঙ্কে চাকরি করতেন, বেশিদিন এক জায়গায় মন টেকেনা তার, ঘুরে ঘুরে চাকরি করেছেন। এখানে কেউ তেমন একটা চেনেনা তাকে! কারুর সাথে খুব একটা মেলামেশা, যাওয়া আসা নেই! অমিশুক মানুষ, সংসার করেন নি।
কিছুক্ষণ শব্দ না শোনার ভান ধরে রইলেন। কলিংবেল লাগান না ইচ্ছে করে। তার ধারণা কলিংবেল লাগালে মানুষ এসে তাকে বিরক্ত করবে। এখন অজুহাত হিসেবে বলা যায় শব্দ শোনা যায়নি। তবু লম্বা সময় ধরে দরজায় ক্রমাগত কেউ কড়া নেড়েই যাচ্ছে, শহীদ সাহেব বিরস মুখে দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন। হঠাৎ করে আবার শুরু হয়েছে বৃষ্টি। দেখা যাবে ভিক্ষুক শ্রেণীর কেউ নক করছে। যেই আসুক, বৃষ্টির জন্য সে সহজে ফিরেও যাবে না। চরম বিরক্ত হচ্ছেন শহিদ সাহেব। মাত্রই কেবল রান্না চাপিয়েছেন, খিচুরি আর ডিম। বয়স হচ্ছে আর শুধু নিত্য নতুন ভালো-মন্দ খেতে ইচ্ছে করে। এই সময়ে বৃষ্টি মাথায় নিয়ে কে আসবে ভাবতে ভাবতে দরজা খুললেন। ত্রিশ একত্রিশ বছরের এক যুবক ছাতা হাতে দাঁড়িয়ে, সাথে একটা ছোট ব্যাগ, বৃষ্টির ছাঁটে আধা ভেজা হয়ে আছে।
শহিদ সাহেবের বিরক্তি চরম পর্যায়ে পৌছালো, কে না কে! দেখে দরজা খোলা উচিত ছিল। নিশ্চয়ই বৃষ্টির অজুহাতে এখন এসে বসতে চাইবে, গপ্পো জুড়বে। দেখে যদিও ভদ্রলোকের ছেলেই মনে হচ্ছে, তবে আজকাল চেহারা দেখে লোক চেনা মুশকিল। অবশ্য তিনিও তো এমন কোন ধনাঢ্য ব্যাক্তি নন যার ধনসম্পত্তির জন্য চোর-ডাকাত এতো হোমওয়ার্ক করে আসবে। শহিদ সাহেব জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতে ছেলেটা বেশ পরিষ্কার শুদ্ধ উচ্চারণে জিজ্ঞেস করলো, ‘আপনি জনাব শহিদ উল্ল্যাহ, ঊষাপুরে বাড়ি? আমি পলাশ’। শহিদ সাহেব বেশ একটু অবাক হয়েই দরজা থেকে সরে দাঁড়ালেন। এখানে তার আদিবাড়ির নাম কেউ জানেনা। বাড়ির সাথে তার খুব বেশী যোগাযোগ নেই। এই ছেলেকে দেখে তিনি মনে করতে পারলেন না এঁকে কখনো আগে দেখেছেন কিনা। ছেলেটা বেশ অপ্রস্তুত হাসি দিয়ে বললো, আমাকে একটা গামছা জাতীয় কিছু দেবেন প্লিজ। আমার ঠাণ্ডার ধাত আছে’। দেবেন না ভেবে কি মনে করে আবার ভেতর থেকে একটা পরিষ্কার গামছা এনে দিলেন। গামছা দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে পলাশ হাসলো একটু ‘আমি আসলে বুঝতে পারিনি এমন বৃষ্টি আসবে, নয়তো অন্যসময়েই আসতাম’। শহিদ সাহেবের মনে হলো এই হাসি যেনো আগে কোথাও দেখেছেন! কিন্তু কার হাসি ?
‘চা চলবে তো? একটু চা করি’ ভদ্রতা করে বললেও শহিদ সাহেবের মনে ক্ষীণ আশা ছিল, এই ছেলে হয়তো তাড়াতাড়ি বলবে, না না চায়ের দরকার নেই, আমি এখনি চলে যাবো; কিন্তু সেরকম কিছুই হলনা। বরং চায়ের কথায় ছেলেটা বেশ রিলাক্স হয়ে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলো। খিচুরির চুলাটা একটু ছোট করে দিয়ে চায়ের জল চড়ালেন, এই ছেলের তার কাছে কি দরকার কে জানে!
‘আপনি মদিনা বেগম বলে কাউকে কি চিনতেন? ‘ ঘরের অস্বস্তিকর নীরবতা ভেঙ্গে শহিদ সাহেবের জিজ্ঞাসু চোখের দিকে তাকাল পলাশ, ‘মদিনা বেগম আমার দাদী”। শহিদ সাহেবের ভাবলেশহীন তাকিয়ে থাকা দেখে পলাশ যেনো একটু বিব্রত হলো, ‘উনি গত মাসে মারা গেছেন। মারা যাবার আগে আপনাকে এই দুটো জিনিস দিয়ে যেতে বলেছেন’। যন্ত্রের মত হাত বাড়ালেন শহিদ সাহেব, একটা কথাও বললেননা। ‘দাদী স্ট্রোক করে হাসপাতালে ছিলেন প্রায় দশদিন, একটা পাশ সম্পূর্ণ অবশ হয়ে গিয়েছিল’, পলাশ ক্রমাগত অনেক কিছুই বলে যাচ্ছে, শহিদ সাহেবের কানে কিছুই গেলনা, ধীরে ধীরে প্যাকেটটা খুললেন। এক জোড়া নূপুর আর কচি কলাপাতার রঙের অনেক পুরনো একটা সুতির শাড়ি বেরিয়ে এলো প্যাকেট থেকে। স্মৃতির পাতায় একটা ছবি যেনো উঁকি দিয়ে গেলো, কলাপাতা শাড়িতে ঘোমটা পরা অপূর্ব এক মুখ! শহিদ সাহেবের মনে হল এই তো সেদিন, বাবুগঞ্জের হাটে গিয়ে খুব পছন্দ করে কিনেছিলেন শাড়িটা। হামিদের সাথে গিয়ে অনেক বাছাবাছির পর এই শাড়িটা মনে ধরেছিল; হামিদ খুব বিরক্ত হয়ে বলেছিল একটা শাড়ি পছন্দ করতে এতো সময় লাগে তোর…অথচ মেয়ে পছন্দ হয়ে গেলো এতো তাড়াতাড়ি’! ঝাকুনি খেয়ে সম্বিত ফিরলো শাহিদ সাহেবের, পলাশ চিন্তিতমুখে তার হাত ধরে আছে, ‘আপনি ঠিক আছেন তো’? প্যাকেটটা একপাশে সরিয়ে ভালো করে পলাশের দিকে তাকালেন, মদিনার নাতির চেহারায় কি কোথাও মদিনার ছায়া দেখা যায়?  নিজের কাছেই অচেনা লাগলো নিজেকে, এতো বছর পরেও তার মদিনাকে দেখতে ইচ্ছে করে! দীর্ঘশ্বাসটাকে গোপন করার চেষ্টা করতে গিয়েও তার মনে হলো এর কোন প্রয়োজন নেই।
এবার নাইওর এসেই হুস্না বড় ভাই মনসুর আলীকে ধরেছেন একমাত্র ভাতিজা শহিদের বিয়ে দেয়ার জন্য। বড়ভাইকে হুক্কার নল এগিয়ে দিতে দিতে শুরু করেছেন, ‘ভাইজান, বিয়া না করাইয়া জোয়ান ছেলেরে শহরে পড়তে দিলেন, শহরের মাইয়ারারে দেইখ্যা কিন্তু মাথা ঘুইরা যাইবো। আমার সন্ধানে উপযুক্ত মাইয়া আছে, আপনে দেখেন। মাইয়ার বংশ ভালা। আমরার শহীদের লগে খুব মানাইব। মেট্রিক পরীক্ষা দিব, পরীর লাহান মাইয়া। আপনে নিজে একবার দেখেন’।
পাশ থেকে মনসুর সাহেবের স্ত্রীও মৃদু স্বরে একমাত্র ননদের কথায় তাল দেন, ‘হুস্নার কথামতে একবার মেয়ে দেখলে দোষ কি শহীদের আব্বা। আমার মনেও তো খালি দুশ্চিন্তা লাগে। ঢাকা শহরে কত কত মেয়েছেলে! একটু ভাইব্যা দেখেন শহিদের আব্বা, সিয়ান পোলা, কখন কি কইরা বসে !’
-‘এই শহিদ, তোর টেলিগ্রাম এসেছে, দেখ তো’
দ্রুত হাতে কাগজটা হাতে নিলেন শহিদ, ‘কাম শার্প, মাদার ইল’। কাগজটা মুঠোয় ভাজ করে ফেললো শহীদ, ইকবাল চাচাকে দিয়ে করানো টেলিগ্রাম, চাচা সারা জীবন এই চারটা শব্দই সবাইকে টেলিগ্রাম করে দিয়েছেন। বাড়ি থেকে এসেছে শহিদ এক মাস হলো মাত্র, এর মাঝে সবাইকেই সুস্থ, ঠিকঠাক দেখে এসেছে। বাড়িতে উৎসব উৎসব ভাব ছিল, আম কাঁঠালের দিনে ধান তোলা শেষ হলেই ফুপু বাপের বাড়ি নাইয়র আসেন, ভাইবৌরা একমাত্র ননদদের খাতিরদারীতে ব্যতিব্যস্ত থাকেন ভীষণ! তিন ভাইয়ের অতি আদরের এক বোন, ফুপুর শ্বশুর বাড়ি তাদের বাড়ি থেকে অনেক দূর। প্রায় সাত আট ঘণ্টার পথ। প্রতিবার পুরো একটা মাস বাপের বাড়ি থেকে, গলা ছেড়ে কাঁদতে কাঁদতে ফুপু শ্বশুর বাড়ি ফেরেন। মা-চাচীরা শাড়ির আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে তাকে নৌকায় তুলে দিয়ে আসেন! এবারো এর কোন ব্যতয় হবেনা। শহীদের সামনে পরীক্ষা, তাই সে আগেই হলে ফিরে এসেছে। এর মাঝে আবার কি হল, শহীদের একটু একটু দুশ্চিন্তাও হচ্ছে।
পরদিনই বাড়ি ফিরে শহিদ শুনলো তার বিয়ের কথা। বাবার কথার উপর কথা বলার মত ছেলে শহিদ কখনোই না। তবু বিয়ের কথায় একটু যেনো দমে গেল! শহুরে হাওয়া গায়ে লেগেছে একটু আধটু, জীবনানন্দের কবিতাও পড়তে শুরু করেছে, মাত্রই যেনো পেয়েছেন মুক্তির স্বাদ। আজকাল পুঁজিবাদ আর সমাজতন্ত্র নিয়ে তর্কবিতর্কের আড্ডায় নিয়মিত উপস্থিতি শহিদের। চারপাশে কেমন একটা যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব, বঙ্গবন্ধুর নির্বাচনে যাওয়া উচিত কি উচিত না এই বিতর্কেই সময় চলে যাচ্ছে। এর মাঝে এইসব বিয়ের কথাবার্তা ! তাও এতো কম বয়সী এক মেয়ের সাথে!
বাবার সব সিদ্ধান্তই যে খুব খুশীমনে মেনে নিতে ভালো লাগে তাও নয়! সত্তরের টালমাটাল অস্থির এই বিপ্লবী গন্ধ লাগা সময়ে বিয়ে করতে যাওয়া রীতিমত অবিবেচকের মত কাজ মনে হতে লাগলো শহীদের। বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠিনীদের কথাও কখনো সখনো মনে হয়। কতবার ভেবেছে এমন কাউকে জীবনসঙ্গী করবে যার সাথে কিনা মার্ক্স-লেনিন কিংবা মাওবাদ নিয়ে তর্ক করা যাবে। তবুও মাঝরাতে খোলা জানালা দিয়ে মাতাল করা হাসনাহেনার গন্ধ যখন ভেসে আসে, তখন বুকের ভেতরটায় কেমন যেনো হুহু করে ওঠে! মনে হয় খুব গোপনে লুকিয়ে রাখা যেসব কথাগুলো কাউকে কখনো বলা হয়নি, সেগুলি বলবার সময় খুব কাছেই! কবিতাগুলির অস্পষ্টতা যেন কমে আসছে একটু একটু করে! খুব জানতে ইচ্ছে করে সে দেখতে কেমন, কল্পনার চেহারায় দাঁড় করাবার চেষ্টা করে আজকাল খুব অচেনা কাউকে! চোখ বন্ধ করলেই মনে হয় বড় বড় এক জোড়া চোখ রাজ্যের প্রশ্ন নিয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে! মাঝরাতে মোমের আলোয় বই খুলে বসে শহিদ ,
‘পান্ডুলিপি কাছে রেখে ধূসর দীপের কাছে আমি
নিস্তব্ধ ছিলাম ব’সে;
শিশির পড়িতেছিলো ধীরে-ধীরে খ’সে;
নিমের শাখার থেকে একাকীতম কে পাখি নামি
উড়ে গেলো কুয়াশায়, — কুয়াশার থেকে দূর-কুয়াশায় আরো।
তাহারি পাখার হাওয়া প্রদীপ নিভায়ে গেলো বুঝি?
অন্ধকার হাৎরায়ে ধীরে-ধীরে দেশলাই খুঁজি;
যখন জ্বালিব আলো কার মুখ দেখা যাবে বলিতে কি পারো?’
নির্ঘুম রাত কেটে চোখের নীচে পরে কালি। শহিদের আম্মা মাঝে মাঝে খুব উৎকণ্ঠা নিয়ে প্রশ্ন করেন, ‘ও আব্বা, শরীর কি খারাপ লাগে’?
জুম্মা নামাজের পর পরেই বিয়ে পড়ানো হয়ে গেছে ভালোভাবেই, ঠিক হয়েছে কনের মেট্রিক পরীক্ষার পর উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে। পরীক্ষার আরও আট মাস দেরী। নব্বইজনের বরযাত্রীর দল পৌঁছেছে ভর সন্ধ্যাবেলায়। আজ কিছুতেই ফেরা সম্ভব নয়, আকাশ কালো করে মেঘ জমেছে, যে কোন সময় শুরু হবে কালবৈশাখী। মনসুর সাহেব বাইরে বরযাত্রীর সাথে বসে গল্প করছেন, খাওয়া দাওয়া চলছে। শহিদ চোখে মুখে অস্বস্তি মেখে বসে আছে ভেতর বাড়ির কোন একটা ঘরে। দরজায় টোকার শব্দে সোজা হয়ে বসলেন, তার গলা শুকিয়ে যাচ্ছে ভীষণ, পানি খেতে পারলে ভালো হত। দরজা ঠেলে মোমবাতি হাতে দুই মাঝবয়সী মহিলা ঘরে ঢুকলেন, মুখ ভরা পান। হাসি হাসি মুখে বললেন, ‘ওমা জামাই দেখি একলা ঘরে বইসা আছে, ও বুবু, মদিনারে পাঠান এইখানে! যে গরম, জামাইরে একটুক বাতাস করুক’! কলকল করতে করতে ওই দুই মহিলা ঘরে দাঁড়া করিয়ে রেখে গেল পাখা হাতে মদিনাকে, ‘মদিনা, ঠিকমত জামাইরে বাতাস কর, আইজ এমন গরম, দ্যাখ কেমনে ঘাম দিতেসে’! শহিদ মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ লজ্জাবনত মদিনার দিকে, মোমবাতির নরম আলো যেনো আজ ম্লান নববধূর কাছে। চেয়ার ছেড়ে উঠে বাতিটা হাতে তুলে নিল শহিদ, ধীর পায়ে কাছে গিয়ে আলোটা মদিনার মুখের সামনে ধরলো। মিষ্টি একটা লজ্জাবনত মুখ, নাকের ডগায় শিশির বিন্দুর মতো ঘাম। এক মুহুর্ত অপেক্ষা করে আস্তে আস্তে মুখটা ফেরালো নিজের দিকে; মদিনার অবাক করা বড় বড় চোখে চোখ রেখে মৃদু কণ্ঠে আবৃত্তি করলো,
‘কার মুখ? —আমলকী শাখার পিছনে
শিঙের মত বাঁকা নীল চাঁদ একদিন দেখেছিলো তাহা;
এ-ধূসর পান্ডুলিপি একদিন দেখেছিলো, আহা,
সে-মুখ ধূসরতম আজ এই পৃথিবীর মনে।
তবু এই পৃথিবীর সব আলো একদিন নিভে গেলে পরে,
পৃথিবীর সব গল্প একদিন ফুরাবে যখন,
মানুষ র’বে না আর, র’বে শুধু মানুষের স্বপ্ন তখন :
সেই মুখ আর আমি র’বো সেই স্বপ্নের ভিতরে।’
সে রাতে প্রবল বর্ষণে ভেসে গিয়েছিল পৃথিবী আর সাথে দুটি মানুষের মন!
৪.
আজকাল বন্ধুদের আড্ডায় আগের মতো মন বসেনা শহিদের। বিপ্লব টিপ্লব সব পানসে লাগে ভীষণ। বন্ধুরা যে তাকে নিয়ে খুব হাসাহাসি করে সেও খুব বুঝতে পারে শহিদ। একটা রাত দুজন মানুষকে কোথা থেকে যে ধরে এতো কাছে এনে দিলো ভেবেই খুব অদ্ভুত লাগে! লম্বা লম্বা চিঠি লেখে শহিদ, মদিনাকে। অষ্টম ক্লাস পড়ুয়া ফুপাতো ভাই সেই চিঠি পৌঁছে দিয়ে আসে মদিনাকে। পুরো চিঠি জুড়ে থাকে কাছে না পাবার আকুলতা। শহিদ জানেনা মদিনার ও এমন লাগে কিনা, শহিদ জানেনা মদিনাকে স্পর্শ করে কিনা তার এই আকুলতা! তবু মনে হয় পাতার পর পাতায় এঁকে ফেলা এইসব তীব্র অনুভূতিগুলোর ঠিকানা হচ্ছে কারুর হৃদয়ের খুব কাছাকাছি। কেউ রাতে ঘুমোবার আগে, খুব গোপনে ঢিমে করা হারিকেনের আলোয় পড়ে নেয় তার মনটাকে, জেনে নেয় কেউ একজন তীর্থের কাকের মত দিন গোণে একটা ফিরতি চিঠির আশায়। বাপের কড়া হুকুম বউ উঠিয়ে আনবার আগে শ্বশুর বাড়ি যাওয়া চলবেনা, তবু এক বিকেলে গাড়িতে উঠে বসে শহিদ একবার প্রিয় মানুষটাকে এক পলক দেখার জন্য। ফুপু হাসি লুকিয়ে অবাক হবার ভান করে, ‘কিরে বাবা, এদিকে আইলে যে, তোর আব্বায় জানে’?
খুব সকাল সকাল হুসনা এসে মদিনাকে সাথে করে নিয়ে এলো। নতুন বউকে এক বেলা ভাত খাওয়াবে। শহিদকে দেখে মদিনার চোখ থেকে গড়িয়ে আসা দু’ফোটা মুক্তোর মত জলের জন্যেই বোধ হয় পুরো পৃথিবীকে তুচ্ছ করে ফেলা যায়! বিকেলে বাড়ি রেখে আসবার আগে নিজের হাতে মদিনার পায়ে পরিয়ে দেয় নূপুর জোড়া আর বাড়িয়ে দেয় কলাপাতা রং এর শাড়ি। শাড়ি হাতে পেয়ে কিছুক্ষণ স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে থেকে আবার ভেতরে ফিরে যায়। ফিরে আসে শহিদের দেয়া শাড়ি পড়ে। বুকের খুব কাছটায় দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে জানতে চায় মদিনা, ‘বলেন তো আমারে কেমন লাগে?’
পরীক্ষা শুরু হয়ে যায় শহিদের। এর মাঝে চারপাশের পরিবেশও কেমন উত্তাল, আস্তে আস্তে উত্তাল হয় ঢাকা, উত্তাল হয় সারাদেশ। পঁচিশে মার্চের কালো রাতে পুকুরে ডুবে ঠেকে কোন রকমে প্রাণে বেঁচেছিল শহিদ। পরদিনই একটা স্বাধীন দেশের বুকে একদিন মদিনার সঙ্গে হবে তার ছোট একটা সংসার এইটুকু আশা বুকে নিয়ে পরদিনই যুদ্ধে চলে গেল শহিদ। এদিকে শহিদের আব্বা আম্মা কোনভাবেই তার কোন খোঁজ পেলোনা। তারা জেনেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছে পাকবাহিনী। মদিনাদের বাড়িতেও খবর পাঠানো হলো বেঁচে নেই শহিদ।
যুদ্ধশেষে বীরের বেশে ফিরেছিল শহিদ। ছুটে গিয়েছিল মদিনার কাছে, মদিনাদের বাড়ির কেউ নেই! এই নয় মাস যুদ্ধে শহিদের কোন কষ্ট হয়নি, যতটা হচ্ছিল মদিনাকে খুঁজতে খুঁজতে। কেউ জানেনা তারা কোথায় গেছে। অনেক খোঁজ করে শুধু জানা গেলো যুদ্ধের শুরুর দিকেই মদিনার চাচাতো ভাইরা যুদ্ধে চলে যাবার পর এক রাতে ওদের বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছিল পাকিস্তানী সেনারা। ওদের আর কেউ দেখেনি।
বেশ কত বছর চলে গিয়েছিল মাঝে। কত কিছু পাল্টে গেলো। যে মানুষটার জন্য এসেছিল স্বাধীনতা, তাকে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল পাকিস্তানীদের প্রেতাত্মারা। শহিদের বাবামা কেউ বেঁচে রইলেন না। মদিনাকেও খুঁজে  পাওয়া গিয়েছিল অবশেষে। অন্যের ঘরণী হিসেবে। যুদ্ধের ভয়াবহতার মাঝে মদিনাকে সাথে নিয়ে ঘোরা নিরাপদ ভাবেননি মদিনার আব্বা-আম্মা। সোমত্ত মেয়ে, কিছু হয়ে গেলে কে দায় নেবে! জামাই এর কোন খোঁজ নেই, এতোদূর কি করে যাবেন তারা! দুঃসম্পর্কের এক আত্মীয় বাড়িতে উঠেছিলেন মদিনাকে নিয়ে, যুদ্ধের সেই ভয়ংকর অবস্থার মাঝেই সেখানেই মদিনাকে বিয়ে দেয়া হয়েছিল।
শহিদ মদিনার সাথে আর দেখা করতে যায়নি। কি হবে দেখা করে!  মদিনা বলে কেউ আর তার জন্য অপেক্ষা করে নেই। শুধু মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকের মত ভেসে ওঠে মদিনার মুখটা। মনে পড়ে শেষবার বাড়ি পৌঁছে দিয়ে ফেরার সময় চোখে চোখ রেখে জানতে চেয়েছিল মদিনা, ‘আবার কবে আসবেন? কবে নিয়া যাইবেন আমারে’? দুই বেলার সংসারের স্মৃতি নিয়েই কেটে গেল এক জীবন। না , মদিনার উপর তার নেই কোন রাগ, কোন প্রশ্ন করে তাকে বিব্রত করবার ইচ্ছে হয়না শহিদের! শুধু কোন ঝড়ের রাতে অস্থির লাগা শুরু হয়, খুব ছেলেমানুষি ইচ্ছে হয় তার। মদিনার কাছে গিয়ে জানতে ইচ্ছে করে, কোনদিন কি মদিনার স্বপ্নে তার মুখ ভেসে ওঠে? কখনো কি মনে পড়ে? মদিনা কি তার জন্য অপেক্ষা করে?
বুকে হালকা চিনচিনে ব্যথা নিয়ে উঠে বসলেন শহিদ সাহেব। তারও কি স্ট্রোক হচ্ছে নাকি! গ্যাসের ব্যাথাও হতে পারে! পলাশ চলে যাবার পর আর কিছুই করতে ইচ্ছে করেনি। চুলা বন্ধ করে এসে শুয়ে পরেছিলেন বিছানায়। আধোয়া চায়ের কাপ পরে আছে বসার ঘরে, সিঙ্কের পাশে ডাই হয়ে আছে পেয়াজ রসুনের খোসা। আজ তার শুধু মনে হচ্ছে এই একা জীবন ভীষণ অর্থহীন। এতদিন তবুও মদিনা ছিল, এই পৃথিবীর কোথাও! হোক না অন্য কারো ঘরে, তবুও সে ছিল। আজ আর কেউ নেই! এই পৃথিবীর সাথে যেনো শহিদ সাহেবের সব যোগ আজ শেষ! বুকের ব্যাথাটা বাড়ছে, সব কেমন যেনো ঝাপসা হয়ে আসছে ! তবু মাথা থেকে মদিনার ভাবনা সরিয়ে দেয়া যাচ্ছেনা! মদিনার তো সবাই ছিল, সব ছিল! তবু মদিনা চলে যাবার সময় তার কথা ভেবেছিল, এতো বছর পরও যে কেন ভালো লাগে! মদিনা চলে গেছে! এই নামের সাথে অবশেষে ছিন্ন হলো সব মায়া। আর কেউ তার জীবনে ছিলনা, যে ছিল সে তো শুধু ছায়া! তবু এইটুকু তৃপ্তি মদিনা তাকে ভুলেনি… মরণ সাগর পাড়ে দাঁড়িয়ে মদিনা তাকে খুঁজেছে, এই সুখটুকু পাবার জন্যই হয়তো এতকাল অপেক্ষায় ছিল শহিদ…।
পৃথিবীর সব গল্প একদিন ফুরাবে যখন,
মানুষ র’বে না আর, র’বে শুধু মানুষের স্বপ্ন তখন :
সেই মুখ আর আমি র’বো সেই স্বপ্নের ভিতরে।
- Advertisement -spot_img

আরো পড়ুন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisement -spot_img

সর্বশেষ খবর