ড. পৌলমী চক্রবর্তী
তৃষার সাথে পার্থের সদ্য বিয়ে হয়েছে। একবছরের প্রেম, তারপর বিয়ে। তৃষা আপনমনে লাল-নীল উলের ছোট ছোট মোজা বোনে। মোজার সাথে বোনে লাল-নীল স্বপ্ন। তৃষা তিনমাস সন্তানসম্ভবা। পার্থ অফিসে গেছে, তৃষা আপনমনে ভাবে একবছর জোড়া অপেক্ষার কথা…. কত রাত বিনিদ্র জেগে কাটিয়েছে তারা বিয়ের পর একসাথে থাকার সুখস্বপ্ন দেখতে দেখতে। মনে আছে দীর্ঘ একবছর প্রতীক্ষার পর যে রাতে বিয়ে হ’ল, সে রাতে বাসরঘরে ঢুকে একে অপরকে দেখে প্রথমেই জড়িয়ে ধরেছিল, তখনও যেন তারা ঠিক বিশ্বাস করতে পারছিলনা যে সত্যিই তাদের বিয়ে হয়ে গেছে, এখন থেকে তারা সবসময় একে অপরের পাশে একে অপরের কাছে থাকতে পারবে….এসব কথা ভাবতে ভাবতে মুখে আনমনা হাসি ফোটে পৃথার।
হঠাৎই একটা তীব্র ঝনঝন শব্দে তৃষার ব্যস্ত আঙুল কাঁটার খোঁচা খায়, সঙ্গে সঙ্গে তার সুখচিন্তাতেও পড়ে ছেদ। বিরক্ত হয়ে তাকায় তৃষা উলটোদিকের বাড়ির দিকে। এই এক রোজকার ঝামেলা। ষাটোর্ধ এক দম্পতির বাস ও বাড়িতে। দু’ ছেলে চাকরি নিয়ে বাইরে সেটলড। এ বাড়িতে বিয়ের পর ভাড়াটে হয়ে আসা ইস্তক তৃষা দেখে যাচ্ছে স্বামী -স্ত্রীর নিত্যি খিটিমিটি। আজ ঝোলে নুন হয়নি তো কাল বাজার থেকে তাজা মাছ আসেনি…. সাধারণ কারণে রীতিমতো তুমুলউত্থান যাকে বলে! এ নিয়ে তৃষা আর পার্থ নিজেদের মধ্যে কত হাসাহাসি করেছে, কখনও কখনও তৃষা পার্থের বুকের ওপর আঙুল দিয়ে আঁকিবুকি করতে করতে বলত, “এই, তোমার কী মনে হয় বলো তো, ওনারা ফুলশয্যার রাতে প্রথমবার পরস্পরকে কীভাবে গ্রীট করতে পারেন?” তৃষার মুখে কৌতুকের হাসি। পার্থ চশমা খুলে রাখতে রাখতে বলত, “আঃ ছাড়ো না! তোমরা মেয়েরা না, পিএনপিসিটা আর ছাড়তে পারলেনা।” “আহা বলোই না তোমার কী মনে হয়!” এবার পার্থ একহাতে তার লাল টুকটুকে বৌয়ের পিঠ জড়িয়ে ধরে বলত, “নিশ্চয়ই বলেছিল আই হেট ইউ।” সারা পাড়ায় এ দম্পতির ঝগড়া কুখ্যাত। তৃষা নতুন জায়গায় এসে চট করে মিশতে পারেনা, তবে যে ক’টি মেয়ে-বৌয়ের সাথে তার আলাপ হয়েছে, তাঁরা সবাই একবাক্যে বলেছেন, “নতুন তো তুমি এ পাড়ায়, দেখো না কী হয়! তার ওপর আবার একেবারে মুখোমুখি বাড়ি! রক্ষে করো বাপু!”
যতদিন যাচ্ছে তৃষা তাঁদের কথার সত্যতা একেবারে হাড়ে-হাড়ে বুঝতে পারছে। মাঝে মাঝে তৃষা অবাক হয়ে ভাবে, এই যে তার আর পার্থের এতদিনের দাম্পত্য, একটা দিনও এমন যায়নি যেদিন পার্থ অফিস যাবার আগে তৃষাকে “আই লাভ ইউ” বলেনি। আর এই দম্পতি! একটা ভালোবাসার সম্ভাষণ তো দূরে থাক, সবসময় রণং দেহি মূর্তিতে আছেন তো আছেনই। তৃষা নিজের মা বাবা অথবা শ্বশুর-শাশুড়িকেও অবশ্য কখনও রোমান্টিক মুডে দেখেনি, তবে এই রাম-রাবণের যুদ্ধও তাকে কখনও দেখতে হয়নি। মাঝে মাঝে তৃষা অবাক হয়ে ভাবে, তখনকার দিনের মানুষরা কি কখনও ভালোবাসতনা? কিন্তু তা কী করে সম্ভব! মানুষ মাত্রেরই তো ভালোবাসার এবং ভালোবাসা পাবার অন্তর্নিহিত আকূতি থাকে! একবারও ভালোবাসার মানুষকে “আই লাভ ইউ” না বলে এঁরা থাকেন কী করে!
চলে গেল আরো তিনমাস। এর মধ্যে বরাকের জল অনেক গড়িয়ে গেছে। সারা পৃথিবীময় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে অশ্রুতপূর্ব মারণ ভাইরাস। তৃষাদের পাড়াও আর নিরাপদ নয়। পার্থের অফিস বন্ধ, ছ’ মাসের সন্তানসম্ভবা তৃষাকে নিয়েই সবার চিন্তা। শ্বশুরবাড়ি বাপের বাড়ি দুই থেকেই ঘন ঘন খবর নিচ্ছেন মায়েরা। হঠাৎ জানা গেল, উলটোদিকের বাড়ির গিন্নির শরীরে বাসা বেঁধেছে ভাইরাস! এম্বুলেন্স এসে তুলে নিয়ে গেল রোগীকে। তৃষা ভয়ে আতঙ্কে পার্থের বুকের মধ্যে থরথর কাঁপছিল। পার্থ তাকে অভয় দেয়।
যাই হোক, সে যাত্রা বেঁচে গেলেন ঝগড়ুটে গিন্নি (হয়তো ঝগড়া করার কোটা পূর্ণ হয়নি তাই)। বাড়ি ফিরে আসার পর এমন দোর্দন্ডপ্রতাপ মানুষটা কেমন যেন ঝিমিয়ে পড়েছেন। আগের মতো আর হাঁকডাক নেই, স্বামীর ওপর ঝাল ঝাড়া নেই, ছেলেদের ফোনে একহাত নেওয়া নেই, কিচ্ছু নেই। বাড়ি একেবারে নিস্তব্ধ। রান্নার জন্যে মাসি রাখা হয়েছে আর ঘরের কাজ সব কর্তাটিই করছেন। সারা পাড়া একটুখানি শান্তির মুখ দেখছে। এমন সময় হঠাৎ তৃষার একদিন বদহজম হয়ে খুব জ্বর এলো। পেটে বেশ ব্যথা, ওষুধ খেয়েছে কিন্তু বিছানা থেকে উঠতে পারছেনা। শুয়ে থেকে থেকে কেমন একটু ঝিমুনি এসছিল, হঠাৎ পার্থের দুপদাপিয়ে বারান্দা থেকে ঘরে ঢোকার শব্দে তৃষার চটকা ভাঙল। দেখল পার্থ বিরক্তির সাথে হাতের খবরের কাগজটা বিছানায় ছুঁড়ে ফেলে বলল, “ডিসগাস্টিং! একটু বোধহয় জোর এসছে গায়ে, অমনি আবার শুরু।” কপাল চেপে ধরে সোফায় বসে পড়ল পার্থ। তৃষা শুনতে পেল সেই পুরনো চিৎকার, “মিনসের কান্ড দেখো! অমন করে কেউ আলু ছাড়ায়! এক্ষুনি হাত কেটে টি.টি. লাগবে তারপর তোমার কোন্ পেয়ারের ডাক্তারকে এই লকডাউনে পাবে শুনি? বলছি আমি করে নিতে পারব, একটু তো ঝোলভাত! দেখি সরো বলছি!জীবনে রান্নাঘরের মুখও দেখেছিলে বুড়ো? আ মোলো যা! বলি সরবে?” এবার ভদ্রলোকের গলা তার চেয়েও এক পর্দা ওপরে, “যাও যাও। বিছানার শুয়ে চিঁ চিঁ করো গে! এখনও রাতে কাশির দমকে ঘুমোতে পারোনা আর এসছ রান্নাঘরে দরদ দেখাতে! যাও ঘরে যাও!”
তৃষার চমক ভাঙে পার্থের কথায়, “জ্বরটা কেমন বুঝছ এখন?” তৃষা সচকিত হয়, কপালে হাত দিয়ে বলে, “না….এখন বোধহয় তেমনটা নেই আর।” পার্থ বিছানায় উঠে এসে তৃষার গাল টিপে দিয়ে বলে, “ডিয়ার সুইটহার্ট! আমাকে একটু ম্যাগি করে দিতে পারবে? অনেকখানি বেলা হ’ল, খুব খিদে পেয়ে গেছে…ইউ নো আই মে হ্যাভ অর্ডারড সামথিং বাট সিনস্ দেয়ার ইস লকডাউন…প্লিজ সোনা, আই লাভ ইউ।” পার্থ টি.ভি.টা অন করে। তৃষা আস্তে করে উঠে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ায়। পার্থ বলে ওঠে, “ইউ আর ওকে না ডার্লিং?” তৃষা পেছন ফেরে, সামান্য হেসে বলে, “ইয়া, আই এম।”