(প্রথম পর্ব)
সাগর রহমান
এলিসকে দেখলে যে কোন পুরুষের বুকে ‘সুখের মতো ব্যথা’ বেজে ওঠার কথা, জোড়া চোখ ওর দিকে ঘুরে যাবার কথা কম্পাস-কাঁটার মতো। এমন নিঁখুত সুন্দরীরা, আমি স্থির জানতাম, সিনেমার পর্দায় বাস করে, বাস্তবে এদের দেখা পাওয়া যায় না। অবশ্য এলিসের সঙ্গে প্রথমবার যখন দেখা হয়, ওর সেই নয়নকাড়া সৌন্দর্যের জন্য বিস্মিত হয়ে ওর দিকে চেয়ে থাকিনি। আমি অবাক হয়ে ওর মুখের দিকে চেয়েছিলাম, কারণ, নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে এলিস খানিকটা ভাঙা ইংরেজিতে বলেছিল, আমার নাম এলিস। এলিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ডের এলিস।
ম্যাকডোনাল্ডের স্টাফ রুমে ‘এলিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ডে’র নাম শুনতে পাবো ঘুণাক্ষরেও ভাবিনি। এখানে যারা কাজ করে, আমার সহকর্মীরা, তাদের মধ্যে এশিয়ান, আফ্রিকান, ইউরোপিয়ান পৃথিবীর নানান দেশের ছেলেমেয়ে আছে। সাদা-কালো-বাদামি-হলুদ-গোলাপি রঙের এক ঝাঁক ছেলে মেয়ে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ‘বান’ সেঁকে, তাতে লেটুস-টমেটো-শসা-পেঁয়াজ-চিজ-মাংস-মাছ-সস ঢুকিয়ে কাস্টমারের কাছে বিক্রি করে, কাজ করতে করতে দুষ্টুমি-ঝগড়া-চিৎকার-চেচাঁমেচি করে। আমাদের মধ্যে ভিন্নতা অবশ্য শুধু গায়ের রঙেই নয়, বলা-বসা-পরার কায়দা-কানুনেও। শুধু কাজের ফাঁকে যখন ‘ব্রেক টাইমে’ এই নানা দেশের নানারূপী ছেলেমেয়েরা নিজের খাবারের ট্রে হাতে এসে পাশাপাশি বসে, তাতে আড্ডার বিষয়বস্তুগুলো কেমন-কেমন করে যেন এক হয়ে যায়। সিনেমা, রাজনীতি, ধর্ম, আইফোন, গীবত এমন সব বিষয়ে পৃথিবীর সব ছেলেমেয়েরই বুঝি একই রকম আগ্রহ। কিন্তু গত দেড় বছর ধরে এখানে কাজ করছি আমি, কোনোদিনও আড্ডার বিষয়বস্তু হিসেবে ‘লিটারেচার’কে উঠে আসতে শুনিনি কারো মুখে।
তাই এলিস যখন নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে লুইস ক্যারোলের ‘এলিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড’-এর কথা তুলে আনল, আমি বেশ অবাক হয়েই ওর মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। আমার হাতে তখন ভাজা মুরগির টুকরো, টমেটো সসে মাখিয়ে নিয়ে মুখে ঢুকাতে গিয়ে থমকে গেলাম। সসের এক ফোঁটা টুপ করে ঝরে পড়লো টেবিলের ওপর।
আমি সাধারণত সকালের শিফটে কাজ করি। সেদিন শুরম্ন করেছিলাম সকাল আটটা থেকে। তখন দুপুর সাড়ে বারোটা বাজে। বহু আগে থেকেই খিদে টের পাচ্ছিলাম, কিন্তু এসময়টার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম আমি। দুপুরের এসময়টাতে ‘ব্রেক’ নিলে স্টাফ রুমটা মোটামুটি ফাঁকা পাওয়া যায়। বারোটার দিকে লাঞ্চের ভিড় শুরম্ন হয়ে যায়, কাস্টমার বাড়ার সাথে সাথে আমাদের ব্যস্ততা দ্বিগুণ হয়ে যায় মুহূর্তে। সব স্টাফই তখন ফ্লোরে। ম্যানেজাররা সাধারণত এসময়টাতে খাবারের বিরতি দিতে চায় না। আমি সকালে কাজ শুরম্ন করার দোহাই দিয়ে, খিদে লাগার কথা বলে-টলে কোনরকমে ম্যানেজ করি।
আমি খুব আলাপি ধরনের ছেলে নই। তারচেয়ে বড় কথা ইংরেজি লিখতে-টিখতে যাই পারি না কেন, বলতে গেলে এখনো মনে মনে ট্রান্সলেশান করে নিয়ে বলতে হয়। তাই বেশিরভাগ কলিগদের সাথেই মন খুলে আলাপ জমাতে পারি না। কিন্তু এসব ছাড়াও ফাঁকা স্টাফ রম্নমে একা-একা খেতে আসার পিছনে আরেকটা কারণ আছে।
দেশ ছেড়েছি বছর দুই হলো, কিন্তু আমার ভেতরে এখনো বাড়ির টান রয়ে গেছে পুরো মাত্রায়। চারপাশে উন্নত ঝাঁ চকচকে রাস্তা-ঘাট-দোকান-মানুষ দেখে মনে অবাক ভাব তো জাগেই না, বরংচ এখানকার সবকিছু কেমন মেকি-মেকি লাগে আমার কাছে। সুযোগ পেলেই ব্রিটিশ শান-শওকতকে দুই বেলা গালি-গালাজ করি, দুশো বছর আমাদের শুষে নিয়ে যে এসব ধন-সম্পদ বানিয়েছে এমন ধরনের যুক্তি গলা ফুলিয়ে বলে নিজের দেশের দৈন্যতা ঢেকে রাখার চেষ্টা করি। মাটির তলায় হুশ-হুশ করে চলতে থাকা ট্রেনে চলতে চলতে গুলিস্তানে জ্যামের জন্য মন কেমন করতে থাকে। মনে হতে থাকে, আহারে! যদি একটা রিকশায় হুড ফেলে আরামসে বসে থাকতে পারতাম কিছুড়্গণ!
এখানকার কাজকর্ম সবই যন্ত্রের মতো। বেশিরভাগ ম্যানেজারই অশিড়্গতি বর্বর-টাইপ, ভদ্রভাবে কথাবার্তাও বলতে পারে না। দেশে থাকলে এতদিনে দুয়েকটার নাক-টাক ফাটিয়ে দিতাম। কিন্তু এখানে নাক ফাটানোর প্রশ্নই আসে না। এখনো ইংরেজিটা গড় গড় করে বলতে পারি না বলে ঝগড়া-টগড়াও করতে পারি না। খুব শীঘ্রই এ কাজ ছেড়ে দেব এ ধরনের একটা প্রবোধের কারণে এখনো টিকে আছি এখানে। কর্মীদের জন্য ম্যাকডোনাল্ডের মূল মটো হচ্ছে: ‘দৌড়ের উপর থাক’। কাজ শুরম্ন করার পর থেকে এক সেকে-ও এখানে দাঁড়িয়ে থাকার উপায় নেই। নিদেন কোনো কাজ না থাকলে দেখা যাবে একজন ম্যানেজার এসে হাতে ন্যাকড়া ধরিয়ে দিবে। বার্গার বানানো ছাড়াও আমাদের প্রতিদিনকার অন্যতম কাজ যাবতীয় টেবিল-চেয়ার-যন্ত্রপাতি-ফ্লোর-দেয়াল ঘসাঘসি করে চকচকে রাখা। এক নাগাড়ে এসব করতে করতে আমার প্রায় দিনই কান্না পেতে থাকে, খাবারের বিরতিতে এসে সে মনোভাবটা কাটানোর জন্য আমি ফোনে দেশে কথা-টথা বলি, অনলাইনে প্রথম আলো খুলে খেলার খবরে চোখ বুলাই।
স্টাফরম্নমে সেদিন আর কেউ ছিল না তখন। খাবার খেতে খেতে ফোনের স্ক্রিনে প্রথম আলো পড়ছিলাম। তামিম ইকবাল কার সাথে যেন সেঞ্চুরি করেছে, সে বিষয়ে অšত্মত পাঁচ-ছয় ধরনের আর্টিকেল করেছে, বসে বসে সেসব পড়ছি, তার সাফে ফাও আসা পাঠকদের নানান ক্যাচালমূলক মšত্মব্যগুলোও। এমন সময় দরজা ঠেলে কেউ একজন ভেতরে ঢুকল। আমি ভেতরে ভেতরে শঙ্কিত হলাম। অযথা কারো সাথে ‘হাই-হ্যালো’ও করতে ইচ্ছে করছিল না তখন। তাই ইচ্ছে করেই চোখ তুললাম না আগন্তুকের দিকে।
এই আগন্তুকটিই ছিল এলিস। এসে বসল আমার ঠিক উল্টো দিকের চেয়ারে। নিজের খাবারের পেস্নট নামিয়ে রেখে ছোট্ট করে বলল, হ্যালো।
এবার আর চোখ না তুলে পারা গেল না। প্রতি উত্তরে ‘হ্যালো’ বলার আগেই সে আবার বলল, আজকে আমার প্রথম দিন এখানে। বাপরে, কী যে দৌড়াদৌড়ি চারদিকে!
শেষ বাক্যটা যতটা না আমার উদ্দেশ্যে, তারচেয়ে স্বগত বাক্য।
ওর দিকে তাকিয়ে বুঝলাম, এরিক আমার সাথে একই সেকশানে কাজ করে, আমরা দুজনে দুটি ভিন্ন ভিন্ন তাওয়ার উপরে মাংসের টুকরো ভাজি এ মেয়েটির কথাই বলেছিল আমাকে তখন। এরিক আফ্রিকান, ম্যাকডোনাল্ডে কাজ করে এত হাসি-খুশি থাকতে আমি আর কাউকে দেখিনি। ওর ভাষায়, ধুর ব্যাটা, আমি কি ম্যাকডোনাল্ডে টাকা কামাতে আসি, আসি নানান দেশি মেয়েদের সাথে ‘টাংকি’ মারতে। আসলেও তাই, আমাদের এখানে কাজ করতে আসা প্রায় সব মেয়েদের সাথেই এরিকের ‘নন-স্টপ’ দুষ্টুমি চলতেই থাকে। মেয়েরাও সারাড়্গণ বেহায়ার মতো ‘এরিক, এরিক’ বলতে অজ্ঞান। ও আজ সকালেই বলেছিল, আজ একটা নতুন মেয়ে কাজে আসবে, বস। দেখলে ফিট হয়ে যাবি।
জিজ্ঞেস করেছিলাম, কীভাবে জানলি?
এরিক চোখ টিপে বলেছিল, গতকাল ইন্টারভ্যু দিয়ে গেছে। তোর তো অফ ডে ছিল, তাই দেখতে পেলি না। জেফরিন আমাকে বলেছে ও আজ দুপুর থেকে কাজ শুরম্ন করবে।
জেফরিন আমাদের ফার্স্ট এসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার। নতুন স্টাফ নিয়োগ ওর দায়িত্বের অন্যতম অংশ।
কিন্তু এ মেয়েটাতো এখনো কাজ শুরম্ন করেনি। করলে ফ্লোরেই চোখে পড়তো। তবে ব্রেকে আসলো কেমন করে? তাও খাবারের ট্রে হাতে?
আমার চোখে-মুখে নিশ্চয়ই এ জিজ্ঞাসা ফুটে উঠেছিল। এলিস কী বুঝলÑ কে জানে, বলে উঠল, আমার কাজ শুরম্ন দুটা থেকে। আগে এসে এই খাবার কিনলাম। লাঞ্চ করে-টরে তারপর কাজে ঢুকবো। খাবার কিনতে গিয়েই দেখলাম কী ব্যস্ততা চারদিকে।
বলতে বলতে সে মুখের উপরে চলে আসা এক গোছা সোনালি চুল পেছনে সরিয়ে দিল। তারপর হাসল। তড়্গুনি আমার মনে ভারত চন্দ্র রায় গুণাকরের দুটো লাইন গুনগুন করে উঠলো,
কে বলে শারদ শশী, সে মুখের তুলা
পদতলে পড়ে আছে তার কতগুলা।
ইচ্ছে হচ্ছিল হ্যাংলার মতো ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি। ফ্রান্সের পটভূমিতে সুনীলের লেখা একটা বই পড়েছিলাম। তাতে ফরাসি সুন্দরীদের যে গুণগান গাওয়া হয়েছে, তারপর থেকে যে কোন সুন্দরী মেয়ে দেখলেই আমার মনে হয়Ñ এ নিশ্চয়ই ফরাসিনী।
অনেককেই দেখেছি, ভাষা এবং চেহারা দেখেই প্রায় নির্ভূলভাবে বলে দিতে পারে, কোন মেয়ে কোন দেশের। সে বিদ্যা আমি তখনো শিখিনি, তবে ইংরেজ এবং ইউরোপিয়ান এ দুজাতের মেয়েদের আলাদা করতে শিখেছি।
এলিসের ভাঙা ইংরেজি শুনে কোনোরকম বিদ্যা-টিদ্যা ছাড়াই বুঝতে পেরেছিলাম, সে ইউরোপিয়ান। এবং ওর দৈহিক সৌন্দর্য ও ‘ছবির দেশে, কবিতার দেশে’র সৌজন্য মনে হয়েছিল, ও নিশ্চয়ই ফরাসিনী।
এলিস আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে ততড়্গণে, আমার নাম এলিস। এলিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ডের এলিস। তুমি?
আমি নিজের নাম বললাম। এবং অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকার একটা কারণ পেয়ে গেলাম। আমার হাতে ধরে রাখা মুরগির টুকরোতে লাগানো টমেটো সসের এক ফোঁটা টুপ করে টেবিলে পড়ে গেল। সেদিকে অবশ্য আমার চোখ গেল না। নিজের অবাক হওয়া সামলাতে সামলাতেই জানতে পেলাম, এলিস ফরাসিনী।
আহা, মেয়েটি, উনে পিউর বিউটে… একটি নিখুঁত সৌন্দর্য।