Free Porn
xbporn

buy twitter followers
uk escorts escort
liverpool escort
buy instagram followers
Galabetslotsitesi
Galabetsondomain
vipparksitesigiris
vipparkcasinositesi
vipparkresmi
vipparkresmisite
vipparkgirhemen
Betjolly
Saturday, July 27, 2024

‘চা: যাহাতে নাহি মাদকতা দোষ, খেলে হয় চিত্ত পরিতোষ’

পথে হল দেখা। বহুদিন পর। দু’জনই আবেগাপ্লুত। আবেগে উত্তরণে প্রথম কথাই হল, এসো চা-খাই। কাজে-অবসরে দিনজুড়ে চা আমাদের চাওয়া-পাওয়া। চা সঞ্জিবনের গন্ধ মাদন ছড়িয় প্রাণে শিহরণ আনে, আন্দোলিত করে, অনুরণন তোলে।  শরীরকে সজীব ও সতেজ করে, অবসাদ ও অলসতা দূর করে, তৃষ্ণা মেটায়, প্রাণ জুড়ায়, মনকে চাঙা করে, দেহে প্রশান্তি আনে।

এক কাপ চায়ে জেগে ওঠে চেতনা, আবার সেই ধুমায়িত এক কাপ থেকেই আমরা পাই প্রেরণা। শিশির স্নাত শীতের সকাল কিংবা বৃষ্টি মুখর সন্ধ্যায় গরম এক কাপ চা’য়ে চুমুক, আহা!  সেই উষ্ণতার শিহরণ প্রাণে দোলা দিয়ে­ যায়। ক্লান্তি, আলস্য, প্রেম কিংবা বিদ্রোহ সর্বত্রই জড়িয়ে থাকা চা কখন, কিভাবে আমাদের নিত্যদিনের সঙ্গী হয়ে উঠলো, তার পেছনে রয়েছে বহু বছরের পুরনো ইতিহাস।

‘এক কাপ চা, কত গল্প বলে সকাল, বিকেল, সন্ধে বেলা…’। এ গানটির মতো চা নিয়ে আড্ডাপ্রিয় বাঙালির গল্পের যেন শেষ নেই। এ জন্যই কবি শামসুর রাহমান বলেছিলেন, ‘স্বাধীনতা তুমি চা-খানায় আর মাঠে ময়দানে, ঝড়ো সংলাপ’।‘এক কাপ চায়ে আমি তোমাকে চাই/ ডাইনে ও বাঁয়ে আমি তোমাকে চাই/ দেখা না দেখায় আমি তোমাকে চাই/ না-বলা কথায় আমি তোমাকে চাই…’ কবির সুমনের গাওয়া জনপ্রিয় এই গানটির সঙ্গে চায়ের রোমান্টিকতা ফুটে উঠে। আমাদের আটপৌরে জীবনেও চা অপরিহার্য অঙ্গ তারও প্রমাণ মেলে সুমনের আর একটি গানে- ‘ চেনা বাস, চেনা রুট, চেনা রুটি-বিস্কুট, চেনা চেনা চায়ের গেলাস’। সৈয়দ মুজতবা আলীর একটি গল্প ছিল, ‘অদ্ভুত চা খোর’? যেখানে চা খেতে না পেয়ে ট্রেনের এক যাত্রী শেষ পর্যন্ত চা-পাতি চিবিয়ে ,পানি দিয়ে গিলে ফেলে বললো ‘অন্তত জীবনটা বাঁচলো’।

নকুল কুমার বিশ্বাসের চা নিয়ে একটা গান আছে।

 

“চাচায় চা চায়, চাচী চ্যাঁচায়, চা চড়াতে চায় না চাচী চচ্চড়ি চুলায়।” গরম চায়ে চুমুকের তৃপ্তিতে জলের গানটিও কম নয়।

প্রাচীন গ্রিক মিথ অনুযায়ী চাঁদ ও নৈশব্দের দেবী ‘থিয়া’র নামানুসারে চায়ের ইংরেজি প্রতিশব্দ হয় ‘টি’। চীনে ‘টি’ এর উচ্চারণ ছিল ‘চি’ পরে তা হয় চা। এ থেকে বুঝা যায় – চা’য়ের সাথে চাঁদ, চা’য়ের রাত, চা’য়ের সাথে নিস্তব্ধতা নিঃসঙ্গতার এক নিবিড় সম্পর্ক প্রাচীনকাল থেকে বিদ্যমান।

চা-পাতা যেভাবে ইতিহাসের পাতায়:

চা কিন্ত আবিষ্কার হয়েছিল সাত সমুদ্র তের নদীর পাড় চীনে। সেখানে চায়ের ব্যবহার শুরু হয় ২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। তবে তা পানীয় হিসেবে নয়, সেসময় চায়ের পাতা ব্যবহার হতো কেক তৈরিতে। সেটাও আবার মৃতদের জন্য।

মধ্য চীনের ইয়াং লিং সমাধিস্তম্ভে প্রাচীনকালে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াতে যেসব নৈবেদ্য দেওয়া হতো তার মধ্যে পাতা দিয়ে তৈরি শুকনো কেক দেখা যেতো। এইসব পাতার মধ্যে থাকা ক্যাফেইন এবং থিয়ানিন প্রমাণ করে যে, সেগুলো প্রকৃতপক্ষে ছিল চা পাতা যা কি না মৃতদের সঙ্গে দিয়ে দেওয়া হতো তাদের পারলৌকিক জীবনের অনুষঙ্গ হিসেবে।

তবে চীনের প্রচলিত একটি পৌরাণিক গল্প মতে, ১৭ শতাব্দীতে সেখানে বাস করতেন শেন মং নামের এক কৃষক। ঘুরে বেড়িয়ে নতুন ফসল আবিষ্কার করা ছিল তার নেশা। তখন বর্তমান প্রচলিত খাদ্য শস্য যেমন- ধান, গম, যব ইত্যাদির প্রচলন ছিল না। শেন মং একদিন খাবার উপযোগী শস্য এবং লতাপাতা আবিষ্কারের জন্য বনে বনে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। অপরিচিত কোনো শস্য বা লতাপাতা পেলে সেগুলো চেখে দেখছিলেন। যদিও সবগুলোই খাবার উপযোগী ছিল না। এভাবে সারাদিন বিভিন্ন ফসল আবিষ্কার অভিযানে নিজের অজান্তেই শরীরে ৭২ এরও বেশি প্রকারের বিষ প্রবেশ করিয়ে ফেলেন।

সন্ধ্যায় একটি গাছের তলায় বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন মং। বিষক্রিয়া দ্রুত তার শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে। বসে বসে মৃত্যুর প্রহর গুণছেন। তারপর হঠাৎ কোথা থেকে যেন একটি অপরিচিত পাতা এসে মুখে পড়ল। অবচেতন মনে পাতাটি চিবতে লাগলেন। এবং সেই ভেষজ পাতার গুণে শরীর থেকে বিষক্রিয়া বিদায় নিল, পরিপূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠলেন তিনি।

চীনারা দাবি করে, সেই পাতাটি ছিল মূলত চা পাতা। আর এভাবেই হয় সর্বপ্রথম চা এর আবিষ্কার। কিন্তু সত্যি বলতে এটি নিছক গল্প মাত্র। বৈজ্ঞানিক মতে, বিষক্রিয়া কমানোর কোনো ক্ষমতা চায়ের নেই। কিন্তু গল্পটি থেকে বোঝা যায়, প্রাচীনকাল থেকেই চীনে চায়ের কদর কত বেশি! তখন চায়ের কাঁচা পাতা ব্যবহার হতো ওষুধ হিসেবে।

চীনে প্রায় ছয় হাজার বছর আগে চায়ের চাষ শুরু হয়। আরও সুনির্ধারিত ভাবে বলতে গেলে মিশরের ফারাওরা যখন গিজা পিরামিড তৈরি করেন, তারও দেড় হাজার বছর আগে থেকে চীনে চায়ের চাষ হয়। চমৎকার বিষয় হলো, সেই প্রাচীন কালের চা গাছ এবং এখনকার চা গাছের মধ্যে বিন্দুমাত্র কোনো তফাৎ নেই। তবে চা খাওয়ার রীতি তখন ছিল একদমই ভিন্ন। চা তখন ব্যবহার হত এক ধরনের শাক হিসেবে।

চা খাদ্য থেকে পানীয়ের রূপ পায় মাত্র পনেরশো বছর পূর্বে। চীনা সম্রাট শেন নং (Sin Nong)। প্রথম এই পানীয়টির স্বাদ গ্রহণ করেছিলেন। কোনো এক দিনে রাজ্য পরিদর্শনে বের হয়েছেন সম্রাট। পথিমধ্যে একটু বিশ্রাম নিতে থামল সবাই। সম্রাটের নির্দেশ অনুসারে খাওয়ার পানি ফোটানোর ব্যবস্থা করা হলো। হঠাৎ দমকা হাওয়ায় পাশের ঝোপ থেকে কিছু শুকনো পাতা উড়ে এলো। পড়বি পড় ওই পানিতে। কী আজব! নিমিষেই পানির রং পাল্টে বাদামি। এই দেখে সম্রাট সেই পাতার নির্যাস পানে আগ্রহী হলেন। আর পান করার পর তিনি পেলেন নতুন কিছু..। দেহমন চাঙা হয়ে উঠলো তার। সেদিনের উদ্ধারকৃত উদ্ভিদটিই আজকের চা গাছ, টি লিভস। বিজ্ঞানীদের দেয়া নাম ‘ক্যামেলিয়া সাইনেসিস’।

পানীয় হিসেবে চায়ের প্রস্তুত প্রণালীর ওপরও চলে দীর্ঘদিন গবেষণা। চা পাতাকে তাপ দিয়ে এক বিশেষ ধরনের কেক তৈরি করে, সেটিকে পাউডারের মত চূর্ণ করে গরম জলের সঙ্গে মিশিয়ে মো নামের এক ধরনের পানীয় তৈরির সংস্কৃতি চালু হয়। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই চায়ের জনপ্রিয়তা পুরো চীনে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে, চীনে একটি স্বতন্ত্র চা সংস্কৃতি গড়ে ওঠে। এমনকি গল্প ও কবিতার বিষয় হিসেবে চা স্থান পায়। চিত্রশিল্পীদের জন্য চা একটি শিল্পমাধ্যম হয়ে দাঁড়ায়। চায়ের উপর ফেনা তৈরি করে তারা অসাধারণ সব চিত্রকর্ম তৈরি করতেন, অনেকটা এখনকার কফির ওপরে যেমন ক্রিমআর্ট দেখা যায় তেমনটা।

খ্রিষ্টীয় নবম শতকে এক জাপানী সন্ন্যাসী সর্বপ্রথম জাপানে চা গাছ নিয়ে আসেন। চায়ে জাপানীরা এতই মজে গিয়েছিল যে তারা নিজস্ব চা উৎসবের আয়োজন করে। চতুর্দশ শতাব্দীতে মিং রাজবংশের শাসনামলে চীনের সেরা তিন রপ্তানি পণ্য ছিল পোর্সেলিন, রেশম ও চা।

চা-পাতা খুলল বাণিজ্যের খাতা

ষোড়শ শতকে ডাচরা প্রচুর পরিমানে চা চীন থেকে নিয়ে আসে। এর মধ্য দিয়ে ইউরোপে চায়ের ব্যাপক প্রচলন শুরু হয়। পৃথিবীব্যাপী চায়ের ব্যাপক বিস্তৃতির জন্য অনেকেই একজন পর্তুগিজ নারীকে কৃতিত্ব দেন, তিনি রানি ক্যাথেরিন অব ব্রাগানজা। রানি ক্যাথেরিন ছিলেন চায়ের অসম্ভব ভক্ত। ১৬৬১ সালে তার সঙ্গে ব্রিটেনের রাজা দ্বিতীয় চার্লসের বিয়ে হয়। এবং ব্রিটিশ রাজপরিবারে চায়ের প্রবেশ ঘটে।

এরপর বিশ্বব্যাপী ব্রিটিশরা বিশাল উপনিবেশ সৃষ্টি করার পাশাপাশি সেসব স্থানে চায়ের প্রচলনও ঘটায়। ইউরোপে চা এর জনপ্রিয়তা এতই বৃদ্ধি পায় যে, সপ্তদশ শতকে কফির থেকে ১০ গুণ বেশি দামে চা বিক্রি হতো বলে রেকর্ড রয়েছে! কিন্তু তখনো চীন ছাড়া অন্য কোথাও চায়ের চাষ হতো না। ইউরোপীয় বণিক শ্রেণির মধ্যে রীতিমত প্রতিযোগিতা লেগে যেত তারা কত বড় জাহাজে চীন থেকে চা আনতে পারে!

ব্রিটিশরা প্রথমে রুপোর বিনিময়ে চীন থেকে চা নিয়ে আসতো। কিন্তু পরবর্তীতে বিনিময় মাধ্যম হিসেবে তারা আফিম ব্যবহার শুরু করে। এই বিষয়টি চীনে সমস্যা সৃষ্টি করে, কারণ প্রচুর মানুষ আফিমে আসক্ত হয়ে পড়ে তখন। এজন্য ১৮৩৯ সালের দিকে এক চীনা কর্মকর্তার নির্দেশে আফিম ভর্তি সকল ব্রিটিশ জাহাজ ধ্বংস করে দেওয়া হয়।

এই ঘটনা থেকেই মূলত ইতিহাসখ্যাত আফিম যুদ্ধের সূত্রপাত! চিং রাজবংশের সময় এ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। ১৮৪২ সালে ব্রিটিশরা চাইনিজদের হারিয়ে হংকং দখল করে নেয়। যুদ্ধে জিতে ব্রিটিশরা চীনাদের ওপর অন্যায়ভাবে নানা ব্যবসায়িক শর্ত আরোপ করে, যে কারণে দীর্ঘদিনের জন্য চীনের অর্থনীতিতে ধ্বস নেমে আসে।

চীনা একচেটিয়া বাজারে ভাঙ্গন

সপ্তদশ শতকে চীন এবং বৃটিশ সাম্রাজ্যের মধ্যে কূটনৈতিক এবং বানিজ্যিক সম্পর্কে ভাঙ্গন ধরলে বৃটিশদের চায়ের জন্য অন্যদেশের দিকে মনোযোগ দিতে হয়। ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি, যেটি বৈশ্বিক বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করতো তারা একজন স্কটিশ উদ্ভিদ বিজ্ঞানী রবার্ট ফরচুনকে নিয়োগ করলো যিনি বিশ্বের বিভিন্ন নমুনা সংগ্রহ এবং সেগুলো অভিজাতদের কাছে বিক্রির জন্য পরিচিত ছিলেন। তাকে দায়িত্ব দেয়া হলো গোপনে চীনে যাওয়ার জন্য এবং সেখান থেকে ভারতে চা গাছ পাচারের জন্য-উদ্দেশ্য সেখানে বিকল্প একটি চা শিল্প গড়ে তোলা। আশ্চর্যজনকভাবে তিনি, ২০ হাজার চা গাছ চীন থেকে দার্জিলিং –এ রপ্তানী করেন। তর্ক সাপেক্ষে অনেকেই মনে করেন, রবার্ট ফরচুনের এই গোপন কর্মকান্ডের ফলাফলের প্রত্যক্ষ ফলাফল হিসেবে ভারতকে চায়ের আবাসস্থল হিসেবে পরিণত করেছে।

চায়ের চাদরে আমেরিকার স্বাধীনতার সংগ্রাম

গণতন্ত্রের ফেরিওয়ালা আমেরিকার স্বাধীনতাসংগ্রাম শুরু ও চা-কে কেন্দ্র করে। অধিক শুল্কে চা কিনবে না বলে স্যামুয়েল অ্যাডামসের নেতৃত্ব বোস্টন বন্দর থেকে চায়ের পেটি ফেলা হয় সাগরে, যা থেকে আমেরিকার স্বাধীনতা সংগ্রামের সূত্রপাত। স্বাধীনতা সংগ্রাম চলাকালে বৃটেনে চা পান ছিল রাজভক্তির প্রকাশ আর আমেরিকায় তা ছিলো দেশদ্রোহীর পানীয়। অবশ্য উচ্চ শুল্ক আরোপের নেপথ্যে ছিল বিশ্বের প্রথম আন্তর্জাতিক লড়াইয়ের পুঁজি জোগাড়। ফরাসি ও ইংরেজদের উপনিবেশগুলো ধরে রাখাই ছিল যার উদ্দেশ্য। ইউরোপে ডাচ ব্যবসায়ীরা ১৬০৬ সালে প্রথমত যখন চা নিয়ে যায়, তখন এর বিবিধ বিশ্বায়নের রূপ তারা কল্পনাও করেনি। সম্ভবত চৈনিক এই পানীয়র বাজার পরীক্ষাই ছিল প্রথম উদ্দেশ্য। কিন্তু পরবর্তীতে এই চা হয়ে উঠে দারুণ গুরুত্বপূর্ণ।

দুধ চা?

ভাতে প্রচুর পরিমাণে জন্মানো চায়ের উদ্ভিদটি ছিল ক্যামেলিয়া সিনেনসিস অসামিকা নামে একটি উপ-প্রজাতির উদ্ভিদ। গ্রিন টি’র চেয়ে আসাম টি বেশি স্বাদযুক্ত কালো রং এর ছিল। সাধারণভাবে প্রাথমিক ইংলিশ ব্রেকফাস্টের অন্তর্ভূক্ত আসাম চা-এর রং কড়া থাকায় তা লোকজনকে দুধ সহকারে পান করতে প্ররোচিত করেছিল। বর্তমানে বৃটেনে সাধারণ ইংলিশ ব্রেকফাস্ট বা প্রাতঃরাশের সাথে দেয়া চা দুধ সহকারে পান করা হয়। কিন্তু ইউরোপ মহাদেশের অন্যান্য স্থানে চায়ের সাথে দুধ খুব কমই পরিবেশন করা হয়। তার কারণ মূরত, ইন্দোনেশিয়ার জাভা থেকে নেদারল্যান্ডসে চা যেতো-যা ছিল অনেক হালকা এবং তার সাথে দুধ যোগ করার প্রয়োজন হতো না-আর সে বিষয়টি ফ্রান্স, স্পেন এবং জার্মানিতে এই চা জনপ্রিয় করে তুলেছিল।

অথবা টোস্টের সাথে চা?

১৬৫৭ সালে যখন লন্ডনে টমাস গ্যারাওয়ে নামে এক রোকের দ্বারা প্রথম খুচরা-ভাবে চা বিক্রি শুরু হয়, এটা কিছুটা দ্বিধা তৈরি করেছিল যে সবেচেয় ভালো উপায়ে তা গ্রহণ করার পদ্ধতি কী?

এটা ছিল তখন একটি বিলাসিতার পণ্য, সবার পক্ষে এর ব্যয় বহন সম্ভব ছিল না এবং প্রচন্ডভাবে তা সকলের কাম্য হয়ে ওঠে এবং তা কৌলীন্যের একটি প্রতীক হয়ে ওঠে। কিন্ত এটার ব্যবহারও সকলের জানা ছিল না।

কোন কোন সূত্রে দেখা গেছে, লোকজন পতা ভিজিয়ে রাখার চেষ্টা করেছ এবং সেগুলো খাচ্ছে, এমনকি সেগুলো টোস্টের ওপর দিয়ে মাখন মাখিয়ে দিয়ে খেতেও দেখা গেছে।

কফিকে ছাড়িয়ে চায়ের জয়জয়কার:

ঐতিহ্যগতভাবে তুরস্ক বিশ্বের বৃহৎ চা বাজারগুলোর মধ্যে অন্যতম। কৃষ্ণ সাগরের উপকূলের রিয অঞ্চলের উর্বর ভূমি থেকে অধিকাংশ টার্কিশ ব্ল্যাক টি আসে। তুর্কী কফিও বিশ্বজুড়ে বিখ্যাত, তবে তুরস্কে সবচেয়ে জনপ্রিয় পানীয় হলা চা।

চা যখন গৃহযুদ্ধের কারণ

বাঙালি মাত্রই চায়ের কাপে তুফান তোলায় এক্সপার্ট। কিন্তু ক’জন জানেন ভারতবর্ষের দীর্ঘতম গৃহযুদ্ধটি হয়েছিল চা-কে কেন্দ্র করেই? শ্রীলঙ্কার পাহাড়ি অঞ্চলে ব্রিটিশরা চায়ের গাছ খুঁজে পায় ঔপনিবেশিক কালে। কিন্তু স্থানীয় সিংহলিদের মধ্যে চা চাষের শ্রমিক না পেয়ে পার্শ্ববর্তী মূল ভূখন্ডে তামিলবাসীদের বসতি স্থাপন করে। এই নতুন বসতি স্থাপনার ইস্যুতে স্বাধীনতার পর থেকে রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধরত ছিল শ্রীলঙ্কা। হিন্দু তামিল আর বৌদ্ধ সিংহলীদের মধ্যে ২০০৯ পর্যন্ত সংঘর্ষের জেরে মারা গেছে দশ লাখের বেশি মানুষ, উদ্বাস্তুর সংখ্যা অগুনতি। একই ঘটনা ঘটেছিলো ভারতের সেভেন সিস্টার্সে। চায়ের আবাদ করতে গিয়ে স্থান অধীবাসীদের বাস্তু্চ্যুত করে সেখানে হতদরিদ্র শ্রমিকদের বসতি স্থাপন করেছিলো বৃটিশরা। যার পরিপ্রেক্ষিতে এ অঞ্চলে প্রাচীন তিব্বতি-বর্মি সমাজ বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিলো।

ঔপনিবেশিকরা তাদের ব্যবসার স্বার্থেই সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিয়েছে চা। তাই চা সব অর্থেই একমাত্র বৈশ্বিক পানীয়। কিন্তু চায়ের একচেটিয়া কর্তৃত্ব আর তাদের হাতে নেই। প্রাচীনতম বৃটিশ চা কোম্পনী টেটলি কিনে নিয়ে উপমহাদেশে বৃটিশ আভিজাত্যে এক নির্মম আঘাত হানে ভারতের টাটা কোম্পানী।

চায়ের দিবস আছে অনেকগুলো। একেক দেশে একেক তারিখ চা দিবস পালন করা হয়। ২০১৯ সালের ২১ মে, জাতিসংঘ এই দিনটিকে আন্তর্জাতিক চা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। এর আগে ২০০৫ সালের ১৫ ডিসেম্বর, নয়াদিল্লিতে প্রথম আন্তজার্তিক চা দিবস পালিত হয়।

ভারত সহ বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, কেনিয়া, মালাউই, মালয়েশিয়া, উগান্ডা এবং তানজানিয়ার মতো দেশগুলোতেও আন্তর্জাতিক চা দিবস পালন করে আসছে।

বাংলাদেশে চা-চাষ

বাংলাদেশ টি বোর্ডের তথ্য মোতাবেক  ২০২২  সালে দেশের ১৬৭টি চা বাগান থেকে রেকর্ড প্রায় ১০ কোটি কেজি  চা উৎপাদন হয় যার বেশিরভাগই দেশীয় বাজারে বিক্রি হয়। বলা হয় বাংলাদেশে চায়ের চাহিদার প্রায় সবটাই নিজস্ব উৎপাদন থেকে মেটানো হচ্ছে। বাংলাদেশে চায়ের চাষাবাদ প্রথম শুরু হয় ১৮৪০ সালে। চট্টগ্রামে কুন্ডুদের বাগান নামে সেই চা বাগান অবশ্য সফলতার মুখ দেখেনি। এরপর ১৮৫৪ সালে সিলেটের মালনিছড়ায় প্রথম বাণিজ্যিক চা বাগান প্রতিষ্ঠা করা হয়। তিন বছর পর সেই বাগান থেকে প্রথম বাণিজ্যিকভাবে চায়ের উৎপাদন শুরু হয়। পরের কয়েক বছরে হবিগঞ্জে এবং মৌলভীবাজারে আরও কয়েকটি চা বাগান তৈরি হয়।

ব্রিটিশ শাসনামলে তখন স্থানীয় বাজারে চায়ের খুব বেশি চাহিদা ছিল না। বাগানের উৎপাদিত বেশিরভাগ চা ব্রিটেন রপ্তানি হতো। এছাড়া তখন এই অঞ্চলে থাকা ব্রিটিশ বা ইউরোপীয় লোকজন চা খেতেন, স্থানীয় অভিজাত গোষ্ঠীও চা খেতে শুরু করেছিলেন।

বিবিসি জানায়, ব্রিটিশ শাসনামলে ১৯৪৭ সালে এই অঞ্চলে প্রায় ১৮ মিলিয়ন কেজির মতো চা উৎপাদিত হতো। তার প্রায় ১৫ মিলিয়নই রপ্তানি হতো, তিন মিলিয়ন কেজির মতো এখানে খাওয়া হতো। একাত্তর সালে এসে সেই উৎপাদন এসে দাঁড়ায় ৩১ মিলিয়ন কেজিতে। সুতরাং বোঝা যায় মানুষের মধ্যে চা খাওয়ার প্রতি আগ্রহ বাড়ছিল, চায়ের উৎপাদনও বাড়ছিল।

দেশ স্বাধীনের পূর্ব পর্যন্ত বাংলাদেশে শুধুমাত্র দুইটি জেলায় চা আবাদ করা হতো, একটি সিলেট জেলায় যা ‘সুরমা ভ্যালি’ নামে পরিচিত ছিল, আর অপরটি চট্টগ্রাম জেলায় যা ‘হালদা ভ্যালি’ নামে পরিচিত ছিল, যা বর্তমানে চট্টগ্রাম ভ্যালি করা হয়েছে।

চীনের ওপর নির্ভরশীলতা কাটাতে ব্রিটিশরা ভারতবর্ষের ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় চা চাষের পরিকল্পনা শুরু করে। আসামে চাষের একটি জাত আবিষ্কার করার পর ওই এলাকায় চা চাষে তারা বিশেষভাবে মনোযোগী হয়ে ওঠে। এভাবে দার্জিলিং, আসাম, সিলেটে তারা কয়েকটি চা বাগান প্রতিষ্ঠা করে।

কিন্তু সেসব বাজারে চা মূলত ব্রিটেনে রপ্তানি করা হতো। এছাড়া ভারতবর্ষে কর্মরত ব্রিটিশ ও ইউরোপীয়রা চা পান করতেন।

উনিশ শতকের শুরুর দিকে ভারতীয়রা ব্রিটিশদের মতো চা পানে আগ্রহী হয়ে ওঠে। বিশেষ করে উনিশ শতকের শুরুর দিকে অর্থনৈতিক মন্দা শুরু হলে ব্রিটিশ ভারতে উৎপাদিত মিলিয়ন মিলিয়ন পাউন্ড চা রপ্তানি আটকে যায়। তখন এসব চা স্থানীয় বাজারে বিক্রির চেষ্টা করে ব্রিটিশরা।

সেই সময় চায়ের গুণমান, স্বাস্থ্যগত উপকারিতা, স্বাদের নানারকম বিজ্ঞাপন দেয়া শুরু হয়। বড় বড় শহরগুলোয় চা পানের আলাদা দোকান তৈরি হয়ে ওঠে। তবে তখনো সেগুলো সমাজের উচ্চবিত্ত, অভিজাত শ্রেণী, বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক ছিল।

দেশে চায়ের চল

১৯৩০ এর মন্দায় যখন ভারতবর্ষে উৎপাদিত চায়ের রপ্তানি প্রায় বন্ধ হয়ে যায়, তখন এগুলো দেশীয় বাজারে বিক্রির আগ্রাসী উদ্যোগ শুরু করে কোম্পানিগুলো। তারা ব্যাপকভাবে বিজ্ঞাপন দিতে শুরু করে। গ্রামে, গঞ্জে, বাজারে চায়ের বিজ্ঞাপন প্রচার করা হয়।

ইতিহাসবিদ লিজ্জি কলিংহাম তার ‘দ্যা টেস্ট অব এমপায়্যার: হাউ ব্রিটেন’স কোয়েস্ট ফর ফুড শেপড দ্যা ওয়ার্ল্ড’ বইতে লিখেছেন, সেই সময় ছোট ছোট প্যাকেটে করে বিনামূল্যে চা বিতরণ করা হতো। কীভাবে চা খাওয়া হবে সেটাও তখন শিখিয়ে দেয়া হতো। কোন কোন স্থানে চায়ের সাথে দুধ বা চিনিও বিতরণ করা হতো।

বরগুনার বাসিন্দা নুরজাহান বেগম ব্রিটিশ, পাকিস্তানের আমল দেখেছেন। বিবিসি বাংলাকে  তিনি বলেছেন, “আমার ছোট বেলায় দেখেছি, লোকজন বাজারে এসে তাঁবু গেড়ে চা তৈরি করে মানুষজনকে বিনা পয়সায় খাওয়াতো। এরপর তাদের চা তৈরি করা শিখিয়ে দিয়ে বিনা মূল্যে চায়ের প্যাকেট দিয়ে দিতো। ”

এভাবে অনেকে চা খাওয়ার প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। কয়েক বছর পর তাদের বাড়িতেও চা খাওয়ার চল শুরু হয়। তবে তখন মূলত বাড়ির মুরুব্বিরা বা মেহমান এলে চা খাওয়া হতো। এভাবেই তার চোখের সামনে আস্তে আস্তে বাড়িতে ও বাজারে চা জনপ্রিয় হয়ে উঠতে থাকে।

বিশেষ করে ১৯৩০ থেকে ১৯৪০ সাল নাগাদ ভারতের ব্রিটিশ বিরোধী মনোভাব চাঙ্গা হয়ে ওঠে। মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী ব্রিটিশদের যেসব জিনিস বর্জন করতে আহ্বান জানান, তার মধ্যে চা-ও ছিল। কিন্তু চায়ের কোম্পানিগুলো চা-কে ভারতীয় একটি পানীয় হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করে।

চা গবেষক ইসমাইল চৌধুরী জানান, ১৯৪৭ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ১৮ মিলিয়ন কেজি চা উৎপাদিত হতো। তার মধ্যে ১৫ মিলিয়ন কেজি রপ্তানি হতো, বাকিটা দেশের বাজারে থাকতো।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর দেশে উৎপাদনের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ৩১ মিলিয়ন কেজিতে। তার বড় একটি অংশ দেশের চাহিদা মেটাতে ব্যবহার করা হতো। আশির দশকে কোষ ক্লোন প্রযুক্তি ব্যবহারের পর নতুন নতুন চা বাগান তৈরি হতে থাকে। চায়ের দাম কমে যাওয়ার কারণে দেশের মানুষের মধ্যেও চায়ের ব্যবহার বেড়ে যায়।

তিনি বলছেন, ”চা তো আসলে একটা নির্দোষ পানীয়। এতে কোন মাদকতা নেই, স্বাস্থ্যের জন্যও অনেক উপকারিতা আছে। ক্লান্তি কাটাতে সাহায্য করে, চাঙ্গা ভাব নিয়ে আসে। মানুষ যখন আস্তে আস্তে এটা উপলব্ধি করতে শুরু করলো, তখন থেকেই চায়ের জনপ্রিয়তা বাড়তে শুরু করে। আর দেশীয় বাজারে উৎপাদিত হওয়ায় দামও বেশি হয় না। এভাবে বাংলাদেশের গ্রামেগঞ্জে জনপ্রিয় একটি পানীয় হিসাবে চা ছড়িয় পড়ে।”

চায়ের বিপণন

জীবনটা ঠিক যেন এক কাপ চায়ের মতো, তার স্বাদ ঠিক তেমনটাই হবে যেমনটা আপনি সেটিকে বানাবেন। এরকম ভাবনা মানুষকে উদ্দীপ্ত করে চাকে সাধারণ নিত্যসঙ্গী করে তুলতে শুরু হয় আগ্রাসী প্রচারণা। এসব প্রচারণার সুফল পাওয়া যায় অতিদ্রুত।

হোসানাইন আহাম্মদ জাকি জানালেন, বিশ শতকের শুরু থেকে বাংলায় চা-সংস্কৃতির দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভের বিষয়টি বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ যদুনাথ সরকারের দৃষ্টি এড়ায়নি। ১৯১১ সালে তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থ ‘ইকোনমিকস অব ব্রিটিশ ইন্ডিয়া’তে তিনি লিখেছেন, ‘দ্য হেবিট অব ড্রিংকিং টি ইজ ভেরি রেপিডলি স্প্রেডিং, দ্য নম্বর অব ইটস কনজিউমার প্রোবাবলি ডাবলিং এভরি ফাইভ ইয়ার্স।’ গবেষণায় দেখা যায়, ক্রেতাদের এই চা-মুখী হওয়ার মূলে ছিল নানা ঢঙের নানা রঙের বিজ্ঞাপন।

‘হাতের মুঠোয় পৃথিবীকে ধরা-মহা পুণ্যবান
একালের বিজ্ঞাপন-কথা অমৃত সমান।’

ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়ের এই অমৃত বিজ্ঞাপন-কথার পরতে পরতে গড়ে উঠেছে চা-সাম্রাজ্য। যে কারণে প্রায় দুই শ বছর পর আজ অনেক অকিঞ্চিৎকর মহল্লা চিহ্নিত হয় অমুকের চায়ের দোকানের নামে। শুরুতে অভিজাতদের কেন্দ্র করেই বিজ্ঞাপনগুলো তৈরি হতো। ক্ষমতা, আধিপত্য ও সাংস্কৃতিক প্রভুত্বকে প্রকাশের প্রয়াস ছিল চায়ের বিজ্ঞাপনে।

‘এ মুসলিম রইস’ শিরোনামের একটি ছবি সেকালে খ্যাত হয়েছিল। সাদা কুর্তা ও লালরঙা ফেজ টুপি পরিহিত এক মুসলমান অভিজাত যুবকের ছবি ঠাঁই পেয়েছিল এনামেল বিলবোর্ডে। হাতে চায়ের কাপ। নিচে লেখা, ‘থাকলে মায়ের, বাপের আশীর্ব্বাদ/ভালো চা আর কাপড় যায় না বাদ’।

তখনকার দিনে ভারতবর্ষের লঞ্চ-স্টিমার ঘাটে, বড় বড় রেলস্টেশনে টি বোর্ড টাঙিয়ে দিয়েছিল চা-সংক্রান্ত নানা রকমের রঙিন ও চিত্তাকর্ষক বিজ্ঞাপনী ফলক। ভারতবর্ষের জনগণের মধ্যে প্রচলিত প্রায় সব প্রধান ভাষাতেই এসব ফলক লেখা হয়েছিল। ফলকের নকশা বা ছবি অবশ্য সবখানেই এক রকম থাকত। এসব ফলকের অনেকটিতে চা তৈরির কায়দা-কানুনের সচিত্র বর্ণনা থাকত। বিভিন্ন ভারতীয় উৎসবের সঙ্গে মিলিয়ে চায়ের বিজ্ঞাপন দেওয়াটা তখন একটা রেওয়াজ ছিল। ব্রিটিশদের সময়ে তৈরি করা চায়ের বিজ্ঞাপনের সেই আবেদন আজও তরতাজা। চা বিপণনের জন্য ১৯০৩ সালে গঠিত হওয়া ‘টি চেজ কমিটি’র নাম পরিবর্তিত হয়ে ১৯৩৭ সালে হয় ‘ইন্ডিয়ান টি মার্কেট এক্সপেনশন বোর্ড’।

কলকাতা থেকে প্রকাশিত গৌতম ভদ্রের লেখা ‘চায় গরম’ (২০১৪) নিবন্ধ থেকে জানা যায়, টি মার্কেট এক্সপানশন বোর্ড বিরাট আয়োজনে এক প্রচার দপ্তর খুলেছিল। সেখানকার আধিকারিক ছিলেন এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক প্রভু রেণু গুহঠাকুরতা। অ্যাসিস্ট্যান্ট পাবলিসিটি অফিসার ছিলেন কবি অজিত দত্ত। এই জুটি চায়ের প্রচারে বিরল মুনশিয়ানার পরিচয় দেন। প্রচারের নিত্যনতুন কৌশল প্রয়োগ করেছিলেন। ভারতীয় চায়ের বিজ্ঞাপনে ঠাঁই করে নিয়েছিল জাপানি গল্প-গাথা ও সংস্কৃতি। পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন নদীপথে চা পানের সপক্ষে প্রচার করে বেড়াত টি বোর্ডের নৌবহর। চিত্রশিল্পী অন্নদা মুনশিকে দিয়ে অজিত দত্ত দেশীয় লোকছড়ার আঙ্গিকে লেখা তাঁর বিজ্ঞাপনী বার্তার সঙ্গে মিলিয়ে তৈরি করেছিলেন অসাধারণ সব চিত্রকর্ম। যা নিঃসন্দেহে সমৃদ্ধ করেছে সেকালের বিজ্ঞাপন ভাবনাকে।

অভিজাতদের মধ্যেই থেমে থাকেনি চায়ের বিজ্ঞাপন। শহুরে মানুষের মধ্যে চা প্রচলনেই থেমে থাকল না বিজ্ঞাপন। শ্রমিক শ্রেণি থেকে শুরু করে গ্রামগঞ্জেও তা ছড়িয়ে যায়। বিশাল এক কেটলিশোভিত মোটরগাড়ি চায়ের সপক্ষে সুনিপুণ প্রচার চালিয়ে বেড়াত বাংলার বিভিন্ন মফস্বল শহরে। ভোক্তাকে যতই বোঝান হোক না কেন যে, চা তার জন্য বিভিন্নভাবে উপকারী; কিন্তু যতক্ষণ না সেই চা তার হাতের নাগালে আসছে, ততক্ষণ কিন্তু চা বিক্রি সহজ নয়। ডব্লিউ এইচ উকার্স-এর লেখা চা-বিষয়ক আকর গ্রন্থ ‘অল অ্যাবাউট টি’ শীর্ষক গ্রন্থ থেকে জানা যায়, ভারতজুড়ে চায়ের দোকান স্থাপন করা হয়। সিনেমা, ভারতীয় অর্কেস্ট্রা, গ্রামোফোন রেকর্ড ও আকর্ষণীয় ডেকোরেশনের মাধ্যমে চায়ের দোকানে ভোক্তা আকর্ষণের প্রয়াস চলে।

ভোক্তাদের মধ্যে বিতরণ করা হয় ছোট ছোট খামভর্তি চা। সেখানে লেখা থাকত, ‘ছয় কাপ চায়ের জন্য প্যাকেটের মধ্যে থাকা চা ফুটন্ত পানিতে ঢালুন। আট মিনিট সময় নিন। স্বাদের জন্য দুধ এবং চিনি যোগ করুন।’ দুধ যেহেতু বাঙালির প্রিয় পানীয়, তাই দুধের সঙ্গেই চা মেশানোর বন্দোবস্ত! উল্লেখ্য যে, ভারতবর্ষ বাদে বিশ্বের অন্য কোথাও দুধ চায়ের প্রচলন নেই বললেই চলে।
চায়ের বিজ্ঞানসম্মত উপকারিতা প্রচারেও তৎপরতা দেখা যায়। বিজ্ঞাপনের ভাষা ছিল, ‘যাহাতে নাহি মাদকতা দোষ, কিন্তু পান করে চিত্ত পরিতোষ’। ‘ইহা জীবনী শক্তির উদ্দীপক’। ‘ইহা নিম্নলিখিত রোগের আক্রমণ হইতে রক্ষা করে। ম্যালেরিয়া, টাইফয়েড, কলেরা, আমাশয়, প্লেগ, অবসাদ’। ‘অশান্তি-উদ্বেগের গ্লানি চা-ই দূর করে’। এমন কিছু বিজ্ঞাপনের দেখা পাওয়া যাবে শ্রীমঙ্গল চা জাদুঘরে। চা কোম্পানির পৃষ্ঠপোষকতায় ‘চা প্রস্তুত শিক্ষাপ্রণালি’ নামে ১৯০০ সালে গিরীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখা বই বাজারে আসে। বইটি থেকে জানা যায়, লেখক কাছাড়ের জিরিঘাট চা-বাগানে টি-মেকার হিসেবে কাজ করতেন।

এ রকম প্রচারগাড়িতে চায়ের প্রচারকাজ হতো। কোম্পানির লোকেরা ‘চা’-এর গুণাগুণ প্রচার করতেন এবং আগন্তুকদের পরিবেশন করা হতো বিনা মূল্যে চা। ছবিটি দেলওয়ার হাসান সম্পাদিত ‘ঢাকার বাণিজ্যিক ইতিহাস’ গ্রন্থ থেকে নেওয়া।

চা নিয়ে মৌলানা আবুল কালাম আজাদের রয়েছে এক দীর্ঘ চিঠি। যা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে ‘গুবার-এ-খাতির’-এ। তাঁর লেখা চিঠিগুলোর সংকলন এই পুস্তক। চা-সংক্রান্ত চিঠিটির একটা অংশে তিনি লিখেছেন, ‘চায়ের সুরুচি, উপাদেয়তা এবং মিষ্টত্বের সঙ্গে তামাকের উগ্র কটু স্বাদের সংমিশ্রণে আমি এক রকম জটিল উত্তেজক প্রস্তুত করেছি।…আপনারা বলতে পারেন, এমনিতেই তো চা খাওয়া খুব একটা সু-অভ্যাস নয়, তার সঙ্গে আরও একটি আপত্তিকর বস্তু যোগ করার দরকারটা কী? চা ও সিগারেটের এই জটিল মিশ্রণটি যেন শয়তানের সঙ্গে শয়তানের মিলনের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।…’

সাহিত্য মানুষের কথা বলে, জীবনের কথা বলে। সয়ম ও সমাজ সাহিত্য প্রতিফলিত হয় নিপুণ ও নিখুঁতভাবে। চা কিভাবে দৈনন্দিন জীবনকে প্রভাবতি করেছে তার চমৎকার রূপ এরকম..

৮০’র দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জাতীয় ছাত্রলীগের তৎকালীন নেতা রউফুন বসুনিয়ার স্মরণে বন্ধু কবি মোহন রায়হান লিখেছেন,

মধুর ক্যান্টিনে যাই
অরুনের চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে
বসু, তোমাকে মনে পড়ে যায়  ।

তোমার সেই সদা হাসিমাখা ফুল্ল ঠোঁট,
উজ্জ্বল চোখের দ্যুতি
সারাক্ষণ চোখে চোখে ভাসে
বুঝি এখনই সংগ্রাম পরিষদের মিছিল শুরু করার তাগিদ দিবে তুমি

কবি দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের জমায়েতে নিরীহ এক জমিদার চায়ের কাপ হাতে তোলেনি। ভয়ে নাকি অপরিচিত জিনিস চুমুক দেবার সঙ্কোচে, কে জানে! কবি উৎকণ্ঠিত হয়ে বলছেন, “ইউ ডোন্ট টেক টি?…বাট ইউ লুক লাইক আ জেন্টলম্যান’ বুঝুন অবস্থা। চা মানেই যেন ভদ্রলোকের পানীয়।

মধ্যবিত্তের কবি শাসসুর রহামন চা-কে এনেছেন একেবারে প্রাত্যহিক প্রয়োজনের করে। তাঁর কবিতায় চায়ের কাপের সঙ্গে অবধারিত খবরের কাগজ। ‘আজো ঘুম ভাঙলো সকাল ৭টায়/ চিরুনিতে কাঁচা-পাকা কিছু চুল উঠে এলো আজো/ধূমায়িত চায়ের কাপের সঙ্গে এলো খবরের কাগজ/ইচ্ছে হয় বিচানায় জলচর প্রাণীর মত সুনসান/আরও কিছু সময় কাটাই’ (ইচ্ছে হয় একটু দাঁড়াই)। আল মাহমুদের ‘কিছুই মনে নেই’ কবিতায় কঠিনতম বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েও  চায়ের কাপ জুড়িয়ে যাবার ভয়। আর শহীদ কাদরীর চা নাগরিক বোহেময়িানজিমের প্রতীক। ‘এবার আমি কবিতায় ‘চায়ের ধূসর কাপে’র মতো রেস্তোরাঁয় ভ্রমণের ক্লান্তি ঘোচানোর আকুতি তাঁর কবিতায়। মহাদেব সাহার চা বরং সে তুলনায় অনেক বেশি নির্মম, কাঠখোট্টা রকমের -‘মানুষের দুঃখ দেখে আমার তখন ভীষণ কান্না পেতো/এখন আমার আর সেই অনুভব ক্ষমতা নেই/মানুষের নিষ্ঠুরতা ও পাপ দেখেও আমি দিব্যি চায়ের দোকানে বসে/ হাসতে হাসতে চা খাই’ (তোমাকে ছাড়া)।

চায়ের আমেজ চুইয়ে পড়ছে উপন্যাসের পাতায়ও। শরৎচন্দ্রের ‘পরিণীতায়’ যেমন ললিতা গিরনিকে চায়ের পেয়ালা এগিয়ে দেয়, কিন্তু নিজে নেয় না।

দেশের একমাত্র চা নিলাম ঘর

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগেও নিলাম কেন্দ্রের মাধ্যমে বিশ্বের চায়ের বাজার নিয়ন্ত্রণ করতো ব্রিটিশরা। সেটা খোদ লন্ডন থেকেই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে লন্ডন নিলাম কেন্দ্র বন্ধ থাকায় ১৯৪৭ সালে বিকল্প নিলাম কেন্দ্র চালু করার চিন্তায় ১৯৪৯ সালের ১৬ জুলাই চট্টগ্রামের আগ্রাবাদে দেশের প্রথম চা নিলাম কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়। বন্দর নগরী হওয়াতে রপ্তানী প্রক্রিয়া সহজ বিবেচনায় চট্টগ্রামকে বেছে নেয়া হয়। মাঝে মুক্তিযুদ্ধের বছরটা বাদে আজ অবধি সেখানেই বসে নিলাস আসরের। ১৯৮৫ সাল থেকে সাপ্তাহিক ভিত্তিতে প্রতি মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। চা পাতা ও চা গুঁড়ো দুই ধরণের পণ্যের ওপর বছরে প্রায় ৪৫টি নিলাম হয়। টি ট্রেডার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ এই নিলাম পরিচালনার স্বীকৃত প্রতিষ্ঠান। পূর্ব বাংলা ব্রোকার্স লি, ন্যাশনাল ব্রোকার্স লি., ইউনিটি ব্রোকার্স লি, প্রোডিউস ব্রোকার্স লি., প্রোগ্রসিভ ব্রোকার্স লি., এবং কেএস ব্রোকার্স লি.-এই ৬টি প্রতিষ্ঠান পর্যায়ক্রমে নিলামে অংশ নিয়ে থাকে। সাধারণত চা-বাগানের মালিকরা চা উৎপাদন করে ব্রোকার হাউজের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বাজারে বিক্রি করে থাকে।

শেষ চুমুক

কুমার বিশ্বজিতের গান শুনেছি, ‘তুমি রোজ বিকেলে আমার বাগানে ফুল নিতে আসতে, জানি না তুমি ফুল না আমাকেই বেশি ভালোবাসতে’। সেই সুদূর কৈশরো আমিও পাশের বাড়িতে প্রায়শই যেতাম, বসতাম, চা খেতাম-   ‘এক কাপ চা মুখে তুলতেই মনে পড়ে যায় দরজার পাশে দাঁড়াতে এসে ভীরু লজ্জায়’। তোমার মুগ্ধতা ও চায়ের তৃষ্ণা বইবে নিরন্তর; পাশাপাশি।

-মাহবুবুর রহমান তুহিন, সিনিয়র তথ্য অফিসার, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়

 

 

- Advertisement -spot_img

আরো পড়ুন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisement -spot_img

সর্বশেষ খবর