Wednesday, May 8, 2024

মীনা: সাহস ও প্রেরণার প্রতীক-মাহবুবুর রহমান তুহিন

মীনা উজ্জ্বল, উচ্ছল, উদ্দীপনা ও উৎসাহের প্রতীক। প্রতিটি শিশুর কাছে মীনা একটি শক্তি সাহস ও প্রেরণার নাম; যে সব বাধা বিপত্তি ও প্রতিকূলতাকে পেছনে ফেলে শিক্ষার আলোর পথে ছুটে চলে। কারণ, শিক্ষাই তাকে দেবে কাঙ্খিত মুক্তি, পূরণ করবে অগুণতি স্বপ্ন। তার কথাই হল-

‘দিন বদলের বইছে হাওয়া

শিক্ষা আমার প্রথম চাওয়া’।

দক্ষিণ এশিয়ার  দেশগুলোতে বিভিন্ন সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে সচেতনতা তৈরি এবং শিশুদের জন্য শিক্ষামূলক একটি অনুষ্ঠানের অংশ হিসেবে ইউনিসেফের সহায়তায় এই কার্টুন ধারাবাহিকটি নির্মিত হয়ে থাকে। যেসকল সচেতনতা মীনা কার্টুনের মাধ্যমে তৈরির চেষ্টা করা হয়েছে তার মধ্যে আছে, বাল্যবিবাহ বন্ধ করা, স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা নির্মাণ ও ব্যবহারে উৎসাহিত করা, মেয়েদের স্কুলে পাঠানো, কমবয়সী মেয়েদের বিয়ে থেকে স্কুলকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া, যৌতুক বন্ধ করা, ছেলে-মেয়ে সমান পুষ্টি ও সুযোগ-সুবিধার দাবিদার, প্রয়োজনীয় ও সমঅধিকার পেলে মেয়েরাও অনেক কিছু হতে পারে তা বোঝানো, শহরের বাসায় বাসায় কাজে সাহায্য করে এমন মেয়েদের প্রতি সুবিচার ও তাদের যথাযথ শিক্ষা নিশ্চিত করা ইত্যাদি

মীনা দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন ভাষায় নির্মিত একটি জনপ্রিয় টিভি কার্টুন ধারাবাহিক। ১৯৯৩ সালে প্রথম এটি টেলিভিশনে প্রচারিত হয়। কার্টুন ধারাবাহিকের মূল চরিত্র ‘মীনা’ বাংলা ভাষায় নির্মিত কার্টুনগুলোর মধ্যে একটি অন্যতম জনপ্রিয় চরিত্র। বাংলাসহ ২৯টি ভাষায় মীনা তৈরি হয়েছে।  কার্টুনিট প্রচার করা হয় সার্কভুক্ত সাতটি দেশসমূহের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে। কার্টুন ছাড়াও কমিক বই ও রেডিও অনুষ্ঠান সম্প্রচারিত হয়েছে। এর স্রষ্টা বাংলাদেশের বিখ্যাত চিত্রশিল্পী মোস্তফা মনোয়ার। এই কার্টুনটির সূচনা সংগীতটি শিশুদের কাছে খুব প্রিয়।

কার্টুনের মূল চরিত্র মীনা নয় বছর বয়সের কন্যাশিশু। সে তার পরিবারের সঙ্গে একটি ছোট গ্রামে বাস করে। এ চরিত্রের মাধ্যমে শিশুদের অধিকার, শিক্ষা, সংস্কৃতি, বিনোদন এবঙ শারীরিক ও মানসিকভাবে বেড়ে ওঠার চিত্র ফুটে ওঠে। ’মীনা’ কার্টুনে একটি পরিবারের কাহিনী তুলে ধরা হয়েছে, যেখানে মীনা সময়মত স্কুলে যায়, বন্ধুদের সঙ্গে খেলাধুলা করে এবং পরিবারের বিভিন্ন কাজে সহযোগিতা করে। মীনা চরিত্রটি বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ভারত, নেপাল তথা দক্ষিণ এশিয়ার মেয়ে শিুশুদের প্রতিনিধিত্বকারী একটি বালিকা চরিত্র। ১৯৯৮ সাল থেকে প্রতিবছর ২৪ সেপ্টেম্বর ‘মীনা দিবস’ হিসেবে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়া, আফ্রিকা ও ইস্ট-এশিয়ার দেশসমূহে পালন করা হয়।

তবে এ বছর ২৪ সেপ্টেম্বর রবিবার হওয়ায় শ্রেণি কার্যক্রম ও ও দাপ্তরিক কাজের বিঘ্ন না ঘটার সুবিধার্থে ২৩ সেপ্টেম্বর শনিবার’ মীনা দিবস-২০২৩ উদযাপনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য (থিম) ‘স্মার্ট শিশু স্মার্ট বাংলাদেশ’ এবং প্রতিপাদ্য (স্লোগান) স্মার্ট বিদ্যালয় আর স্মার্ট শিক্ষা সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার দীক্ষা’।

মীনা’র মূল কথা হল-জীবনে বড় হতে হবে, বড় হবার স্বপ্ন দেখতে হবে এবং স্বপ্নগুলো অর্জন করার দিকে এগিয়ে যেতে হবে। জীবনে যা হবার আকাঙ্খা, যা অর্জনের ইচ্ছে, চেষ্টা এবং সাধনা থাকলে তাই অর্জন করা যায়। আজকের শিশুই একদিন সফল শিক্ষক হবে, একজন রাষ্ট্রপ্রধান হবে, প্রকৌশলী, চিকিৎসক, কর্মকর্তা হবে। এ জন্য স্বপ্ন দেখতে হবে। মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়। তবে একথা মনে রাখতে হবে একা বড় হওয়া যায় না। সফল হবার মন্ত্র হলো একে অন্যকে সহযোগিতা করতে হবে, অন্যের দুঃখ, কষ্ট. আনন্দ, বেদনার সাথী হতে হবে। মনে রাখতে হবে কামিনী রায়ের সেই কথা –

আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে

আসে নাই কেহ অবনী ‘পরে,

সকলের তরে সকলে আমরা,

প্রত্যেকে মোরা পরের তরে।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো- নিজের প্রতি যত্ন নিতে হবে। মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করতে হবে। কারণ আমরা জানি, ‘লেখাপড়া করে যে, গাড়ীঘোড়া চড়ে সে’। শিক্ষকদের কথা শুনতে ও মানতে হবে, বাবা-মাকে শ্রদ্ধা-ভক্তি করতে হবে। তাদের উপদেশ মেনে চলতে হবে। অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও বন্ধুত্বপূর্ণ হতে হবে। বন্ধুবৎসল, সৎ ও স্বতঃস্ফুর্ত হতে হবে। আনন্দ নিয়ে বাঁচতে হবে। মীনার পথ অনুসরণ করে চলতে হবে। মনে রাখতে হবে ‘পৃথীবকে গড়তে হলে সবার আগে নিজকে গড়ো।

নির্মাণ ইতিহাস

১৯৯১ থেকে ২০০০ সালকে দক্ষিণ এশিয়ার মেয়ে শিশুদের দশক ঘোষণা করেছিল জাতিসংঘ। জাতিসংঘ শিশু তহবিলের তত্ত্বাবধানে ডেনমার্কের সহযোগিতায় কার্টুনিটর যাত্রা শুরু হয়। ইউনিসেফের যোগাযোগ বিভাগের প্রধান কানাডীয় নিল ম্যাককির নির্দেশনায় ইউনিসেফের যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ শামসুদ্দিন আহমেদ পরিকল্পনা করেন। এ অঞ্চলের সব দেশের মানুষের কথা বিবেচনা করে মীনা নামটি প্রস্তাব করা হয়। ভারতের মুম্বাইয়ের রামমোহন প্রতিটি চরিত্রের পোশাক কী হবে, তাদের অবয়ব কী হবে, সেগুলো আঁকেন। মীনা কার্টুনের প্রথম পর্ব ‘মুরগিগুলো গুণে রাখ’ ফিলিপাইনে যুক্তরাষ্ট্রের অ্যানিমেশন স্টুডিও হানা বারবারায় তৈরি করা হয়। পরে মীনা কার্টুন মুম্বায়ের রামমোহন স্টুডিওতে তৈরি হয়। এখন বাংলাদেশেই মীনা কার্টুন তৈরি য়। কার্টুনের থিম গানের গায়িকা বলিউডের সুষমা শ্রেষ্ঠ।

চরিত্র তৈরি

শামসুদ্দিন আহমেদ মীনা নামটি প্রস্তাব করেন। রফিকুন নবী প্রথম মীনা, রাজুকে আঁকেন। মুস্তাফা মনোয়ার একটি ল্যান্ডস্কেপ তৈরি করেন। প্রথম পর্বের দোকানদার ও মুরগি চুরি করে নিয়ে যাওয়া চোর চরিত্র তৈরি করেন শিশির ভট্টাচার্য। দোকানদারের মুখটিও তাঁর করা।

উপসংহারের আগে

দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় শাণিত মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন এবং প্রযুক্তির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করে সমস্যা সমাধানে প্রস্তুত আগামী প্রজন্ম গড়ে তোলার প্রত্যয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় কাজ করে যাচ্ছে। বর্তমান সরকার ২০৪১ সালের মধ্যে একটি উন্নত-সমৃদ্ধ স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে প্রাথমিক শিক্ষার ওপর সর্বাধিক গুরুত্বারোপ করেছে। এ লক্ষ্যকে সামনে রেখে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।

শিক্ষা চেতনাকে শাণিত করে, বুদ্ধিকে প্রখর করে, বিবেককে জাগ্রত করে। তাই আলোকিত ভূবনে নিজেকে আবিস্কার করতে হলে শিক্ষার আয়নায় সমাজকে সাজাতে হবে। সে জন্য বর্তমান সরকার শিক্ষার প্রতি সর্বোচ্চ গুরুত্বারোপ করেছে।

শেষ কথা

চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সরকার পুরোনো ধারার শিক্ষা আমূল বদলে এমন এক নতুন শিক্ষার বীজ বপনের কাজে হাত দিয়েছে, যা শিক্ষার্থীর মস্তিস্ক ও পিঠ থেকে মুখস্থবিদ্যার বোঝা ঝেড়ে ফলে তাদের কৌতুহল, জিজ্ঞাসা ও ভাবনার শক্তিকে জাগাবে ও নেতৃত্বের গুনাবলী তৈরিতে উপযোগী করে তুলবে। শিশু তার জানার পরিধি বাড়াবে, আপন ভূবন সাজাবে। সে নিজেই নানা চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করবে, তা মোকাবেলা করে অভীষ্ট গন্তব্য পৌঁছাবে। শিক্ষার আলোয় নিজেকে রাঙাবে। এই হোক মীনা দিবসের ব্রত। সব শেষে মীনার সেই অসম্ভব জনপ্রিয় গান গাই-

আমি বাবা মায়ের শত আদরের মেয়ে

আমি বড় হই, সকলের ভালবাসা নিয়ে

আমার দুচোখে অনেক স্বপ্ন থাকে

আমি পড়ালেখা শিখতে চাই।

যদি চারদেয়ালের মাঝে কাটে সারা জীবন

তাহলে থাকবো, শুধু বোঝা হয়ে

শিক্ষা আমায় মুক্তি দেবে

মুক্তি দেবে…

 

-মাহবুবুর রহমান তুহিন, সিনিয়র তথ্য অফিসার, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়।

 

 

- Advertisement -spot_img

আরো পড়ুন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisement -spot_img

সর্বশেষ খবর